হোম > মতামত

হাসিনার আমলে বাংলাদেশের সিকিমীকরণ

ড. সিরাজুল আই. ভুঁইয়া

বাংলাদেশের সিকিম মুহূর্ত

২০০৯ থেকে ২০২৩—দীর্ঘ দেড় দশক ক্ষমতায় থাকার সময় শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে এক অভূতপূর্ব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। সরকারি বয়ানে সম্পর্কটিকে বলা হয় ‘ঐতিহাসিক’ ও ‘অটুট,’ এবং তুলে ধরা হয় আঞ্চলিক সহযোগিতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে। কিন্তু এই চকচকে কথার আড়ালে ছিল এমন সব চুক্তি ও ছাড়, যা সমালোচকদের মতে বারবার বাংলাদেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে ভারতের প্রভাবকে সুদৃঢ় করেছে।

কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ জমি হস্তান্তর, ভারতীয় কোম্পানিগুলোর পক্ষে সুবিধাজনক জ্বালানি চুক্তি আর দিল্লির অনুকূলে তৈরি ট্রানজিট করিডর—সব মিলিয়ে এসব পদক্ষেপ বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে ধীরে ধীরে ক্ষয় করেছে, যা বাইরে থেকে অংশীদারত্বের মতো দেখালেও বাস্তবে তা ছিল নির্ভরশীলতার শৃঙ্খল।

এই চিত্র অনেককে মনে করিয়ে দেয় ১৯৭৫ সালে ভারতের হাতে সিকিমের বিলীন হওয়ার ইতিহাস। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ লিখেছেন, ‘ভারতের ছোট প্রতিবেশীদের প্রতি নীতি প্রায়ই সহযোগিতার মুখোশে নিয়ন্ত্রণের প্রয়াস’ (India After Gandhi)। ভারতীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সিকিমের প্রধানমন্ত্রী কাজী লেন্দুপ দর্জি (Lhendup Dorjee) ধাপে ধাপে রাজ্যের ক্ষমতা ছেড়ে দেন, অবশেষে সিকিম তার স্বাধীনতাই হারায়।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সেই প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। শেখ হাসিনার শাসনামলে দিল্লিকে দেওয়া একের পর এক ছাড়কে অনেকে ‘সিকিম মডেল’-এর সঙ্গে তুলনা করছেন—যেখানে অস্ত্রের জোরে নয়, বরং খণ্ড খণ্ড চুক্তি, নির্ভরশীলতার ফাঁদ আর নরম নেতৃত্বের মাধ্যমে সার্বভৌমত্ব ক্ষয়ে যায়।

এই নিবন্ধে তুলে ধরা হবে শেখ হাসিনার আমলে ভারতের পক্ষে নেওয়া ভূমি, জ্বালানি ও ট্রানজিট সম্পর্কিত সিদ্ধান্তগুলো এবং তা কীভাবে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। সিকিমের অন্তর্ভুক্তির সঙ্গে ঐতিহাসিক তুলনা টেনে এখানে দেখানো হবে কীভাবে কাঠামোগত নির্ভরশীলতা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করতে পারে। একই সঙ্গে, বাংলাদেশের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে নিজেদের অবস্থান পুনর্মূল্যায়ন ও স্বায়ত্তশাসন পুনরুদ্ধারের পদক্ষেপ।

আদানির ৯০০ একর : কৌশলগত টাইম বোমা

সবচেয়ে নজরকাড়া ছাড় হলো চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ভারতের আদানি গ্রুপকে ৯০০ একর জমি হস্তান্তর। এই ভূমি বাংলাদেশের কৌশলগত ‘চিকেন নেক’ এলাকায় অবস্থিত—চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মাঝের সরু করিডর, যা বঙ্গোপসাগরের পাশে এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিকটবর্তী। মূলত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ঘাঁটির জন্য নির্ধারিত এই স্থানকে পরে ভারত-নিয়ন্ত্রিত একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে (এসইজেড) রূপান্তর করা হয়।

চুক্তির শর্তগুলো ছিল অবিশ্বাস্য : জমির কোনো মূল্যায়ন হয়নি, বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে এবং শর্ত রাখা হয়েছে যে প্রয়োজনীয় উপকরণ ও যন্ত্রপাতির ৬৫ শতাংশ ভারত থেকে আমদানি করতে হবে ভারতের লাইন অব ক্রেডিটের আওতায়। এমনকি নির্মাণকাজের শ্রমিকও ভারত থেকে আনা হতো। ফলত বাংলাদেশ ‘প্রায় কোনো অংশীদারত্বই রাখে না,’ স্বীকার করেছেন বেজার এক কর্মকর্তা। অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব উল্লাহ প্রকল্পটিকে স্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করেছেন—‘বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের একখণ্ড ভূখণ্ড… আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য ভয়ংকর বিপজ্জনক।’

এখানেও সিকিমের সঙ্গে বিস্ময়কর মিল রয়েছে। অন্তর্ভুক্তির আগে সিকিমে ভারত সেনা মোতায়েন করেছিল, বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেছিল এবং নীতিনির্ধারণে হস্তক্ষেপ করেছিল ‘অর্থনৈতিক সহযোগিতা’র নামে। যেমন : গ্যাংটকে ভারতীয় নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলো সিকিমের সার্বভৌমত্ব ক্ষয় করেছিল, তেমনি মিরসরাই অঞ্চল হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের এক ভৌত ও কৌশলগত ঘাঁটি। অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বিশ্লেষক মেজর মোহাম্মদ মোস্তফা সতর্ক করেছেন—‘এই করিডর যদি বিপন্ন হয়, তবে বাংলাদেশের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়বে।’

রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে বিদ্যুৎ

ভারত শুধু ভূমিই নয়, জ্বালানির মাধ্যমে তার প্রভাবকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শক্তিশালী করেছে। বাংলাদেশ আদানির ঝাড়খণ্ড বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে অতিরিক্ত মূল্যে বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যা ঢাকাকে ভারতের ওপর নির্ভরশীল করে তুলেছে বিদ্যুতের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের জন্য। সুন্দরবনের কাছে ভারতের এনটিপিসির সঙ্গে গড়া রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিবেশ ধ্বংস ও অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতার জন্য তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে।

ভারতের লাইন অব ক্রেডিটের শর্ত অনুযায়ী বাংলাদেশকে কমপক্ষে ৬৫ শতাংশ উপকরণ ভারতীয় সরবরাহকারীদের কাছ থেকে কিনতে হয়েছে, ফলে দেশীয় কোম্পানিগুলোকে সম্পূর্ণরূপে বাইরে রাখা হয়েছে। বেজার এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন—‘আমাদের এমনকি প্রশ্ন করারও ক্ষমতা নেই, ওই অঞ্চলে কী ধরনের কার্যক্রম চালানো হবে।’

এ চিত্রও সিকিমের সঙ্গে মিল খুঁজে দেয়। অন্তর্ভুক্তির আগে ভারত সিকিমের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছিল বাণিজ্য রুট, শুল্ক আর মুদ্রাব্যবস্থার মাধ্যমে। লিও রোজ তার ক্ল্যাসিক গবেষণা দ্য পলিটিকস অব ভুটান, সিকিম, অ্যান্ড নেপালে লিখেছেন : ‘নির্ভরশীলতা হলো আধিপত্যের প্রথম ধাপ। একবার অর্থনৈতিক শিরাগুলো নিয়ন্ত্রণে এলে রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বও দর-কষাকষির বস্তু হয়ে যায়।’ ভারতের প্রতি বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে দেওয়া ছাড় এই ধারা হুবহু অনুসরণ করেছে।

ট্রানজিট ও কানেকটিভিটি

হাসিনা সরকার ভারতকে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহারের এক নজিরবিহীন সুযোগ দেয় ট্রানজিট ও কানেকটিভিটি প্রকল্পের মাধ্যমে। ফেনী নদীর উপর নির্মিত মৈত্রী সেতু সরাসরি ভারতের ত্রিপুরাকে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত করে। একই সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে ভারতকে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়া হয় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য। ভারতীয় মালবাহী পণ্য পরিবহনের জন্য রেল ও সড়ক করিডর খুলে দেওয়া হয়, যাতে ভারতের পরিবহন ব্যয় কমে যায় অথচ বাংলাদেশের কৌশলগত ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায়।

ভারতীয় নেতারা প্রকাশ্যে এ সাফল্য উদযাপন করেছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এ চুক্তিকে আখ্যা দেন ‘ঐতিহাসিক সাফল্য’ এবং ঘোষণা করেন যে এটি ‘ভারতের উত্তর-পূর্বকে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে যুক্ত করবে’—আসলে বাংলাদেশকে ভারতের প্রবেশদ্বারে পরিণত করে। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য এর পরিণতি হলো নিজস্ব পরিবহন করিডরের ওপর কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ হারানো।

এখানেও সিকিমের উপমা অনিবার্য। অন্তর্ভুক্তির আগে ভারত সিকিমের বহির্বিশ্ব যোগাযোগ ও প্রতিরক্ষা নিয়ন্ত্রণ করেছিল বিভিন্ন চুক্তির মাধ্যমে। রাজনৈতিক বিজ্ঞানী সুরজিত ভট্টাচার্য মন্তব্য করেছিলেন—‘সিকিম সার্বভৌমত্ব হারায় ১৯৭৫ সালে নয়, বরং বহু বছর আগেই, যখন এর রাস্তা, টেলিগ্রাফ ও প্রতিরক্ষা ভারতের হাতে চলে যায়।’ বাংলাদেশের পরিবহন শিরা-উপশিরাগুলো ভারতের জন্য উন্মুক্ত করা সেই ধীর আগ্রাসনেরই প্রতিচ্ছবি।

আদানির বাইরেও ভূমি দখল : কৃষকদের উচ্ছেদ

আদানিকে আনুষ্ঠানিকভাবে দেওয়া ৯০০ একরের বাইরে শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে আরো ৭০০ একর উর্বর কৃষিজমি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। স্থানীয় কৃষকরা প্রতিবাদ করলেও, কর্তৃপক্ষ তা দমন করে ভারতের প্রতি হাসিনার প্রতিশ্রুতির কথা তুলে ধরে। গবেষণা সংগঠন ‘নয়া দালান’-এর মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘মানুষ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি যে তাদের দেশের এত বিশাল অংশ বিনামূল্যে অন্য এক দেশের দখলে যাবে।’

বিদেশি প্রতিশ্রুতির নামে কৃষকদের উচ্ছেদ স্মরণ করিয়ে দেয় সত্তরের দশকের শুরুর সিকিমের অস্থিরতাকে, যখন স্থানীয় অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে রাজতন্ত্রকে দুর্বল করা হয়েছিল। সার্বভৌমত্ব শুধু পতাকা ও সীমান্তে সীমাবদ্ধ নয়; এটি নাগরিকদের জমি ও জীবিকার সুরক্ষার বিষয়। যখন একটি সরকার নিজস্ব জনগণের চেয়ে বিদেশি দাবিকে অগ্রাধিকার দেয়, তখন সার্বভৌমত্ব ভেতর থেকেই ফাঁপা হয়ে পড়ে।

কূটনৈতিক ও নিরাপত্তাছাড়

এই ছাড়ের বেশির ভাগই হয়েছে শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির মধ্যে বন্ধ দরজার বৈঠকে। সংসদের কোনো পরামর্শ নেওয়া হয়নি, জনগণকেও অন্ধকারে রাখা হয়েছে। এমনকি বাংলাদেশি কর্মকর্তারাও স্বীকার করেছেন যে ভারতের নিয়ন্ত্রিত প্রকল্পগুলো তারা পর্যবেক্ষণ করার কোনো ক্ষমতা রাখেন না। বেজার এক কর্মকর্তা সোজাসাপ্টা বলেছেন—‘এ ধরনের প্রকল্প যেকোনো স্বাধীন দেশের জন্য আত্মঘাতী। আমরা এটি এগিয়ে নিতে পারি না।’

এই গোপনীয়তা মনে করিয়ে দেয় পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ভারতের সঙ্গে সিকিমের চুক্তিগুলোর কথা—চাপের মুখে স্বাক্ষরিত ও সিকিমের জনগণের কাছ থেকে গোপন রাখা হয়েছিল সেগুলো। ইতিহাসবিদ নিতাশা কৌল তার In-dia, Sikkim and the Making of a Borderland গ্রন্থে লিখেছেন—‘সিকিমকে দখল করা হয়নি সামরিক অভিযানে, বরং চুক্তির মাধ্যমে, যা গোপনে স্বাক্ষরিত হয়েছিল এবং নিঃশব্দে কার্যকর করা হয়েছিল।’ বাংলাদেশের জন্য বিপদ একই ধাঁচে—সহজে প্রভাবিত করা যায় এমন নেতৃত্বের মাধ্যমে স্বাক্ষরিত গোপন চুক্তি, যা জনসমালোচনা থেকে আড়াল থাকে এবং দেশকে কাঠামোগত অধীনতায় আবদ্ধ করে।

বাংলাদেশের সিকিম মুহূর্ত

১৯৭৫ সালে সিকিমের পতন এবং শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশের দেওয়া ছাড়গুলোর মধ্যে মিল ভীতিকর। উভয় ক্ষেত্রেই দেখা যায় নির্ভরশীলতা ও অসম চুক্তির মাধ্যমে সার্বভৌমত্বের ক্ষয়।

সিকিম : নির্ভরশীলতা থেকে অন্তর্ভুক্তি

সিকিমের যাত্রাপথ একটি সতর্কসংকেত। ১৯৫০ সালের ভারত-সিকিম চুক্তির মাধ্যমে রাজ্যটি প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্রনীতি ও যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ ভারতের হাতে ছেড়ে দেয়, হাতে রাখে শুধু আনুষ্ঠানিক অভ্যন্তরীণ স্বায়ত্তশাসন। পরবর্তী দুই দশকে ভারত আরো গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে সিকিমের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ, বাণিজ্য রুট একচেটিয়া করা এবং স্থানীয় রাজনৈতিক মিত্র তৈরির মাধ্যমে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিলেন কাজী লেন্দুপ দর্জি, যিনি দিল্লির পৃষ্ঠপোষকতায় রাজতন্ত্রকে দুর্বল করেন এবং ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার পক্ষে কাজ করেন। সত্তরের দশকের শুরুতে রাজনৈতিক অস্থিরতাকে কাজে লাগিয়ে ভারত ১৯৭৫ সালে গণভোটের আয়োজন করে, যা বহু ইতিহাসবিদের মতে ছিল সুপরিকল্পিত প্রক্রিয়া, গণতান্ত্রিক নয়। এর ফলেই সিকিম সার্বভৌমত্ব হারিয়ে ভারতের ২২তম রাজ্যে পরিণত হয়। ইতিহাসবিদ লিও রোজ (১৯৭৭) মন্তব্য করেছিলেন—‘নির্ভরশীলতা কখনো নিরপেক্ষ নয়; এটি সবসময় নিয়ন্ত্রণের পূর্বসূত্র।’ এভাবে ধাপে ধাপে চুক্তি থেকে পূর্ণ অন্তর্ভুক্তি পর্যন্ত যাত্রা দেখায় কীভাবে সামরিক আক্রমণ ছাড়াই সার্বভৌমত্ব হারানো যায়।

বাংলাদেশ: একই গতিপথের প্রতিধ্বনি

শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ যে পথ অনুসরণ করেছে, তা সিকিমের গতিপথের সঙ্গে উদ্বেগজনক সাদৃশ্য বহন করে। ২০০৯ সাল থেকে হাসিনা সরকার ‘বন্ধুত্ব’ ও ‘আঞ্চলিক সংহতি’র নামে ভারতের ওপর অর্থনৈতিক ও কৌশলগত নির্ভরশীলতা গভীরতর করে তোলে। অতিরিক্ত মূল্যে বিদ্যুৎ কেনার আদানি চুক্তি বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তাকে ভারতের সরবরাহের সঙ্গে বেঁধে ফেলে। মিরসরাইয়ের ৯০০ একর জমি আদানিকে দেওয়া, যা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ‘চিকেন নেক’ অঞ্চলে—অর্থনীতিবিদ মাহবুব উল্লাহর ভাষায় হয়ে ওঠে ‘বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের একখণ্ড ভূখণ্ড’। একই সঙ্গে মৈত্রী সেতু এবং চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে বাংলাদেশ ট্রানজিট করিডর উন্মুক্ত করে, যা ভারতের জন্য কৌশলগত সুবিধা তৈরি করে অথচ বাংলাদেশকে দেয় সামান্যই প্রতিদান। সব মিলিয়ে এসব পদক্ষেপ সিকিমের প্যাটার্নেরই প্রতিধ্বনি—অর্থনৈতিক সহযোগিতার নামে দেওয়া ছাড়, যা শেষ পর্যন্ত সার্বভৌমত্ব ক্ষয় করে।

বাংলাদেশের সিকিমীকরণ

সিকিম ও বাংলাদেশের তুলনা ভারতের আঞ্চলিক কূটনীতির এক অভিন্ন কৌশল তুলে ধরে : খোলাখুলি আগ্রাসনের বদলে চুক্তির মাধ্যমে আধিপত্য বিস্তার। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ভাবনি সেন গুপ্ত এই বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করেছিলেন এভাবে—‘ভারত আক্রমণ করে দখল করে না; ভারত চুক্তির মাধ্যমে দখল করে।’ সিকিম ও বাংলাদেশ উভয় ক্ষেত্রেই ভারত বলপ্রয়োগ নয়, বরং নরম নেতৃত্ব ও অসম চুক্তিকে হাতিয়ার করেছে।

বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন থাকলেও ভূমি, জ্বালানি ও ট্রানজিট খাতে এর সার্বভৌমত্ব ইতোমধ্যেই ফাঁপা হয়ে গেছে। স্বাধীনতার আসল অর্থ—বাহ্যিক চাপমুক্ত হয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা—গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সিকিমের অভিজ্ঞতা যদি পথপ্রদর্শক হয়, তবে শেখ হাসিনার শাসনামলে ভারতের সঙ্গে করা এসব চুক্তি শুধু সাময়িক ভারসাম্যহীনতা নয়; বরং দীর্ঘমেয়াদি অধীনতার কাঠামো তৈরি করছে।

নীতিগত তাৎপর্য

বাংলাদেশের এখনই জরুরি ভিত্তিতে এসব চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। একবার সার্বভৌমত্ব ক্ষয় হলে তা দৃঢ় পদক্ষেপ ছাড়া সচরাচর পুনরুদ্ধার করা যায় না। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে সুযোগ রয়েছে এসব চুক্তি বাতিল বা আবার আলোচনার মাধ্যমে সংশোধন করার, এর আগে যে এগুলো স্থায়ী নির্ভরশীলতার কাঠামোয় রূপ নেবে।

অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব উল্লাহ সতর্ক করে দিয়েছেন—‘এ ধরনের প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগে শুধু অর্থনৈতিক দিক দেখলেই চলবে না—জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টিকেও বিবেচনায় নিতে হবে।’ সিকিমের শিক্ষা স্পষ্ট : ছোট রাষ্ট্রগুলো অংশীদারত্বের ভ্রান্ত ধারণায় গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ সমর্পণ করতে পারে না, কারণ ভারসাম্যহীন অংশীদারত্ব আসলে আধিপত্য ছাড়া আর কিছু নয়।

সিকিম থেকে পাওয়া সতর্কবার্তা

শেখ হাসিনার আমলে ভারতের কাছে দেওয়া ছাড়গুলো বাংলাদেশকে বিপজ্জনক অবস্থানে ফেলেছে। মিরসরাইয়ের কৌশলগত জমি, জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা এবং ট্রানজিট করিডর—সব মিলিয়ে এমন এক নির্ভরতার কাঠামো তৈরি করেছে, যা দেশের সার্বভৌমত্বকে দুর্বল করছে। সিকিমের পরিণতি একটি ঐতিহাসিক সতর্কবার্তা : একবার ধাপে ধাপে ছাড় দেওয়া হলে তা সহজে ফিরিয়ে আনা যায় না।

আজ বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে সেই জায়গায়, যেখানে সত্তরের দশকের শুরুতে সিকিম ছিল। প্রশ্ন হলো—বাংলাদেশ কি তার সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধার করবে, নাকি নির্ভরশীলতার সেই পথে এগোবে, যা ভবিষ্যতে অধীনতার ঝুঁকি ডেকে আনবে?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন : ‘স্বাধীনতা মানুষের আত্মার চিরন্তন আহ্বান।’ বাংলাদেশকে সেই আহ্বানে সাড়া দিতে হবে, সার্বভৌমত্ব ক্ষয়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে—যতক্ষণ না দেরি হয়ে গেছে।

লেখক : যুক্তরাষ্ট্রের সাভানা স্টেট ইউনিভার্সিটির ব্যবসা, সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগের অধ্যাপক।

সরকারের মধ্যে একমাত্র সেনাপ্রধানের সাথে সুসম্পর্ক চুপ্পুর

নতুন মুক্তি ও বিজয়

নির্বাচন-পূর্ব শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনের উপায়

সুদানে আরেকটি গাজা তৈরি করছে ব্রিটেন

ইনকিলাব মঞ্চ ও ইতিহাসের দায়

বিপ্লবী হাদি আমার পরমাত্মীয়

বাংলার মুক্তিযুদ্ধ

বিজয়ের কৃতিত্ব ছিনতাই

বিজয় ও পরাজয়ের সমীক্ষা

বাংলাদেশ বেতারের ৮৫ বছর : মুক্তিযুদ্ধ থেকে গণঅভ্যুত্থান