হোম > মতামত

মার্কিন রাজনীতিতে ইহুদি লবির প্রভাব

এপস্টেইন ইস্যু

সুমাইয়া ঘানুশি

যুক্তরাষ্ট্রের কুখ্যাত যৌন অপরাধী জেফরি এপস্টেইন বন্দি থাকা অবস্থায় কারাগারে মারা গেলেও তাকে নিয়ে মার্কিন রাজনীতিতে উত্তাপ কমছে না। এপস্টেইন ইস্যু নিয়ে কয়েক মাস ধরে বিব্রতকর অবস্থায় ছিল ট্রাম্প প্রশাসন। এর কারণ, ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা ও যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদি লবি আইপ্যাকের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত এপস্টেইন মার্কিন রাজনীতিকদের ইসরাইলের পক্ষে রাখার জন্য নির্বাচনি অনুদানের ব্যবস্থা করে দেওয়ার নারী ঘটিত কেলেঙ্কারিতে জড়ানোর একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলেন। তার এই নেটওয়ার্কেও কাজ ছিল যৌনতার জন্য অভিজাত শ্রেণির লোকদের কাছে কমবয়সি মেয়ে সরবরাহ করা । এ জন্য এপস্টেইন যুক্তরাষ্ট্রে কুখ্যাত একজন যৌন অপরাধী হিসেবে সাজা পেয়ে কারাগারে থাকার সময়ই মারা যান। তার সঙ্গে ট্রাম্পেরও সম্পর্ক ছিল বলে অভিযোগ ওঠে। যদিও ট্রাম্প তা বরাবরই অস্বীকার করে আসছেন।

ওয়াশিংটনের অনেকেই আশা করেছিলেন, এপস্টেইনের বিষয়ে যাবতীয় তথ্য জনসম্মুখে আসা বন্ধ থাকবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। ফেডারেল তদন্তে এপস্টেইনের বিরুদ্ধে যেসব তথ্য উঠে এসেছে, তার স্বচ্ছতার জন্য বিষয়টি প্রকাশ্যে আনতে ট্রাম্পের সমর্থক এবং তার দল রিপাবলিকান পার্টি থেকেও চাপ বাড়ছিল। কয়েক সপ্তাহ ধরে এসব নথিপত্র প্রকাশের বিরোধিতা করার পর ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত এগুলো প্রকাশের পক্ষে মত দেন। এরপরই কংগ্রেস এপস্টেইনের বিষয়ে তদন্ত ফাইলগুলো জনসমক্ষে উন্মুক্ত করতে কংগ্রেস প্রস্তাব পাস করে।

এ পর্যন্ত যা কিছু সামনে আসছে, তা থেকে বোঝা যায়, অর্থ, রাজনীতি এবং যৌনতার একটি ত্রিভুজ নেটওয়ার্ক নিয়ে কাজ করতেন এপস্টেইন। আর এই নেটওয়ার্কের কেন্দ্র যুক্তরাষ্ট্রে নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যে ঘনিষ্ঠ মার্কিন মিত্র ইসরাইলে অবস্থিত। এপস্টেইনের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্যের নথিগুলো প্রমাণ করে, ইসরাইল কীভাবে মার্কিন রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে অর্থের পাশাপাশি নানা অনৈতিক পন্থার মাধ্যমে। ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা এবং যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদি লবি মার্কিন রাজনীতিকদের নিজেদের হাতের মুঠোয় রাখতে প্রয়োজনীয় সবকিছুই করত। এ জন্য শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, সারা বিশ্বের ইহুদি ধনকুবেররা অর্থ সরবরাহ করে থাকে ইসরাইলি গোয়েন্দা ও আইপ্যাককে।

এপস্টেইনের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাম মূলত সামনে আসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে। অভিযোগ রয়েছে, ট্রাম্প ও এপস্টেইন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুক্ত ছিলেন। যদিও ট্রাম্প বলেছেন, ২০০৮ সালে এপস্টেইন দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। ট্রাম্প আরো বলেন, তিনি এপস্টেইনের অপরাধমূলক কার্যকলাপ সম্পর্কে অবগত ছিলেন না।

কংগ্রেসের ওভারসাইট কমিটির ডেমোক্র্যাটরা গত সপ্তাহে তিনটি ইমেইল চেইন প্রকাশ করেছে, যার মধ্যে আছে এপস্টেইন এবং ম্যাক্সওয়েলের মধ্যে চিঠিপত্র। ম্যাক্সওয়েল বর্তমানে যৌনকর্মী পাচারের জন্য ২০ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করছেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ ট্রাম্পের কথা উল্লেখ করেছেন, যার মধ্যে ২০১১ সালে পাঠানো একটি ইমেলও আছে, যেখানে এপস্টেইন ম্যাক্সওয়েলকে লিখেছিলেনÑ‘আমি চাই তুমি বুঝতে পারো, যে কুকুরটি ঘেউ ঘেউ করেনি সে ট্রাম্প, (ভিকটিম) তার সঙ্গে আমার বাড়িতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছে।’

আমেরিকান অভিজাত শ্রেণির সঙ্গে এপস্টেইনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কারণ অভিজাতদের ভোগ-বিলাসের উপকরণ সরবরাহ করতেন তিনি। ফলে তার নজরে পড়ার অর্থ ছিল তার পেছনের নেটওয়ার্কের নজরে আসা। এপস্টেইন ইসরাইলি গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের সঙ্গে দীর্ঘ সময় যুক্ত ছিলেন। আমেরিকান অভিজাতরা বুঝতে পেরেছিল, তিনি এমন কিছু দিতে পারেন, যা কোনো প্রেসিডেন্টও দিতে পারেন না : ভোগ এবং একটি বিদেশি লবির পৃষ্ঠপোষকতা। অভিজাতদের এই নৈতিক পচনের কারণে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা এপস্টেইন ও ইহুদি লবির জন্য সহজ হয়ে পড়েছিল।

২০০৮ সালে ১৪ বছর বয়সি এক কিশোরীর বাবা-মা ফ্লোরিডায় পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন, এপস্টেইন তার পাম বিচের বাড়িতে তাদের মেয়েকে যৌন নির্যাতন করেছেন। এ ঘটনায় তদন্তকালে তার পুরো বাড়িতে কমবয়সি মেয়েদের ছবি পাওয়া যায়। একজন নাবালিকাকে যৌনকর্মে প্ররোচনার অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এই অপরাধে তাকে যৌন অপরাধী হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়। তবে প্রসিকিউটরদের সঙ্গে চুক্তির ফলে বড় ধরনের জেলের সাজা থেকে রক্ষা পান এপস্টেইন।

এগারো বছর পর আবার এপস্টেইনের বিরুদ্ধে যৌনতার জন্য অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের একটি নেটওয়ার্ক চালানোর অভিযোগ আনা হয়। বিচারের অপেক্ষায় থাকা অবস্থায় ২০১৯ সালে তিনি কারাগারে মারা যান। এ দুটি ফৌজদারি তদন্তে বিপুল পরিমাণ নথিপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে, যার মধ্যে আছে ভুক্তভোগী এবং সাক্ষীদের সাক্ষাৎকারের প্রতিলিপি এবং তার বিভিন্ন ভবন ও স্থাপনায় অভিযান চালিয়ে জব্দ করা জিনিসপত্র।

এপস্টেইনের ব্রিটিশ সহযোগী এবং সাবেক বান্ধবী গিসলাইন ম্যাক্সওয়েলের বিরুদ্ধেও একটি পৃথক তদন্ত হয়েছিল, যাকে ২০২১ সালে যৌনতার জন্য মেয়েদের পাচারের ষড়যন্ত্রের জন্য এপস্টেইনের সঙ্গে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। বান্ধবী গিসলাইন ম্যাক্সওয়েল হচ্ছেন দীর্ঘদিন ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে কাজ করা রবার্ট ম্যাক্সওয়েলের মেয়ে।

সাবেক ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী এহুদ বারাকের সঙ্গেও এপস্টেইনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এবং তিনি বারাকের বিনিয়োগ দেখাশোনা করতেন। এহুদ বারাক অনেক বারই এপস্টেইনের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, এমনকি পতিতাবৃত্তির জন্য শিশু সংগ্রহের অভিযোগে এপস্টাইন দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরও।

ড্রপ সাইট নামে একটি প্রতিষ্ঠানের তদন্তে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়েছে। এতে দেখা গেছে, এপস্টেইন ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। অন্যদিকে, আউটলেটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এপস্টেইন তার ম্যানহাটনের বাড়িতে সিনিয়র ইসরাইলি গোয়েন্দা কর্মকর্তা ইয়োনি কোরেনকে দীর্ঘ সময় ধরে আতিথেয়তা দিয়েছিলেন।

এছাড়া এপস্টেইন ইসরাইল এবং মঙ্গোলিয়ার মধ্যে একটি নিরাপত্তা চুক্তিতে মধ্যস্থতা করতে সাহায্য করেছিলেন, সিরিয়া যুদ্ধের সময় রাশিয়ার সঙ্গে একটি ব্যাকচ্যানেলে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা এবং ইসরাইল ও আইভরি কোস্টের মধ্যে একটি নিরাপত্তা চুক্তিতে সহায়তা করেছিলেন। এগুলো কোনো সামাজিক সুবিধা ছিল না, বরং এগুলো ছিল রাষ্ট্রীয় স্তরের পরিষেবা। আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির (আইপ্যাক) সঙ্গেও এপস্টেইনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। একসঙ্গে তারা ইসরাইলেল স্বার্থে মার্কিন রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের পক্ষে কাজ করেছে।

শুধু ২০২৪ সালের মার্কিন নির্বাচনে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট উভয় দলের ৩৬১ জন প্রার্থীকে আইপ্যাক ৫৩ মিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ ব্যয় হয়েছিল। এগুলো অনুদান ছিল না, এগুলো ছিল মার্কিন রাজনীতিকদের আইপ্যাকের নিয়ন্ত্রণে রাখার একটি কৌশল।

তবে, বর্তমানে আইপ্যাকের কংগ্রেসকে নিয়ন্ত্রণ করার এই কৌশল অকার্যকর হয়ে পড়ছে। ২০২৩ সালে আইপ্যাকের বার্ষিক সম্মেলনে ২৪ জন ডেমোক্র্যাট কংগ্রেস সদস্য উপস্থিত ছিলেন। এ বছর ৩৩ জনের মধ্যে মাত্র ১১ জন গিয়েছিলেন, ফ্লাইট বুক করার পর শেষ মুহূর্তে সাতজন সদস্য নিজেদের নাম প্রত্যাহার করেন।

ভোটারদের মধ্যেও ইহুদি লবি সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে তরুণ এবং ডেমোক্র্যাট সমর্থক ব্লকগুলো ইসরাইলপন্থি লবিং গ্রুপগুলোর সমর্থিত প্রার্থীদের প্রত্যাখ্যান করছেন। আরব আমেরিকান ইনস্টিটিউটের জরিপগুলো থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, ইসরাইলি লবির অনুদানে এখন ভোট আনার চেয়ে ভোট কমানোর সম্ভাবনা বেশি। টাকার কার্লসন, মার্জোরি টেলর গ্রিন এবং থমাস ম্যাসির মতো রিপাবলিকান নেতারাও এখন প্রকাশ্যে ইসরাইলি লবিকে আক্রমণ করেন। এটি স্পষ্ট করে দেয়, যুক্তরাষ্ট্রে রাজনীতিতে আইপ্যাকের একসময়ের বিপুল প্রভাব ক্রমেই উধাও হয়ে যাচ্ছে।

মিডল ইস্ট আই থেকে ভাষান্তর : মোতালেব জামালী

স্বৈরশাসকদের প্রতি নয়াদিল্লির সমর্থন

যুদ্ধের নীরব অস্ত্র যৌন নিপীড়ন

ভূমিকম্পে সতর্কতা ও করণীয়

ভূমিকম্পের মাত্রা যদি আরেকটু বেশি হতো!

পাহাড়ে নতুন ষড়যন্ত্র

বিনোদনের বিপ্লব ও জেন-জি সংস্কৃতি

বামপন্থা ও স্বৈরাচার

রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান সম্ভব?

রুনা লায়লা : এক সুরলোকে যাওয়ার দরজা

শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড ও ভারতের দ্বিধা