হোম > মতামত

গাজা প্রশ্নে ইসরাইলের পক্ষ নেওয়াই আসল কেলেঙ্কারি

বিবিসি ট্রাম্প বিতর্ক

ফয়সাল হানিফ

বিবিসির ডিরেক্টর জেনারেল আর নিউজের প্রধান পদত্যাগ করেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি বক্তৃতা বিভ্রান্তিকর এডিটিং করে প্রচারের কারণে যে তোলপাড় উঠেছে, তারই জেরে পদ ছেড়েছেন তারা। এই বয়ানের ধাপগুলো খুবই পরিষ্কার : একটি ভুল, তার পরিণতি, সবশেষে দায়বদ্ধতা। কিন্তু সাম্প্রতিক এই কেলেঙ্কারিটি উসকে দিয়েছিল কিন্তু একটি ভুল বিতর্ক।

খবরের শিরোনামে যদিও এখনো ওই এডিটিংয়ের ভুলটাকেই বড় করে দেখানো হচ্ছে, কিন্তু ব্রিটেনের গণসম্প্রচারের কেন্দ্রে সত্যিকারের যে সংকটটা দানা বেঁধেছে, সেটা আরো অনেক গভীর। এই সংকটের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো ইসরাইলের গাজাযুদ্ধ ইস্যুতে সততা আর সাহসিকতার সঙ্গে খবর পরিবেশনে তাদের ব্যর্থতা।

কিন্তু পরিহাস অত্যন্ত নির্মম। বিবিসি প্রবল নাড়া খেয়েছে তাদের সবচেয়ে ছোট একটা পাপের কারণে। কিন্তু তাদের যে বড় পাপ—ফিলিস্তিনিদের বাস্তবতা বিকৃতি করার যে পাপ—সেটার শাস্তি তারা পায়নি।

তাদের এই ব্যর্থতা পরিমাপযোগ্য। সেন্টার ফর মিডিয়া মনিটরিং মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ২০২৩-এর অক্টোবর থেকে ২০২৫-এর মে মাসের মধ্যে প্রকাশিত বিবিসির ৩৫ হাজারের বেশি সংবাদ আইটেম বিশ্লেষণ করেছে তারা। এই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গাজা নিয়ে বিবিসির কাভারেজে সবসময় ইসরাইলি দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। আর ফিলিস্তিনিদের কণ্ঠস্বরকে দূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।

তথ্যগুলো রীতিমতো ভয়াবহ। গবেষণার সময়টায় ফিলিস্তিনিদের মৃতের সংখ্যা ৪২ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ইসরাইলিদের এক একটি ঘটনা যে মনোযোগ পেয়েছে, ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুর ঘটনাগুলো মনোযোগ পেয়েছে সেই তুলনায় ৩৩ গুণ কম। ইসরাইলি নিহতের ঘটনায় ‘হত্যা করা হয়েছে’ শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে ২২০ বার। ফিলিস্তিনি নিহতের ঘটনায় করা হয়েছে মাত্র একবার। একইভাবে ফিলিস্তিনি নিহতের ঘটনায় ‘হত্যাযজ্ঞ’ শব্দটা যতবার ব্যবহার করা হয়েছে, ইসরাইলি নিহতের ঘটনায় সেটা হয়েছে ১৮ গুণ বেশি। বিভিন্ন ঘটনায় ইসরাইলি কর্মকর্তা আর ভাষ্যকারদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে ফিলিস্তিনিদের চেয়ে ১৮ গুণ বেশি।

এমনকি মানবিক দুর্ভোগ নিয়ে যখন রিপোর্ট করা হয়েছে, সেখানেও ফিলিস্তিনিদের পরোক্ষ ভিকটিম হিসেবে দেখানো হয়েছে। ঘরবাড়ি হারা, ক্ষুধার্ত, মৃতপ্রায়—এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এরা যে মানুষ এবং তাদের যে অধিকার, ইতিহাস আর এজেন্সি আছে, সেটা খুব কমই উল্লেখ করা হয়েছে। মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ প্রতিবেদনে ইসরাইলের বহু দশকের দখলদারিত্বের উল্লেখ আছে। মাত্র ২ শতাংশ রিপোর্টে ইসরাইলের বর্ণবাদী আচরণের উল্লেখ আছে। যদিও অধিকাংশ বড় মানবাধিকার সংস্থাগুলো ইসরাইলের বিরুদ্ধে এই শব্দগুলো ব্যবহার করেছে।

প্রাতিষ্ঠানিক পক্ষপাতিত্ব

সেন্টার ফর মিডিয়া মনিটরিং তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, বিবিসি বারবার ইসরাইল রাষ্ট্রের ভাষা আর ফ্রেমিংকে তাদের সংবাদে নিয়ে এসেছে। কিন্তু যারা দখলদারিত্বের শিকার, তাদের অবজ্ঞা করে গেছে। এটা পক্ষপাতদুষ্ট সাংবাদিকতা নয়। এই ইসরাইলের প্রতি প্রাতিষ্ঠানিক পক্ষপাতিত্ব। ‘ভারসাম্য’ বজায় রাখার অজুহাতে এই পক্ষপাতিত্ব তারা চালিয়ে গেছে।

তারপরও ডানপন্থিদের উসকানি এবং সত্য বিকৃতির প্রচেষ্টা বন্ধ হয়নি। বিবিসির কাভারেজের ব্যাপারে ইসরাইলের অভিযোগ নিয়ে দুই বছর আগে আমি লিখেছিলাম। তারা অভিযোগ করেছিল, ‘বিবিসির কাভারেজকে দেশের অভ্যন্তরীণ সাংস্কৃতিক যুদ্ধে নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।’ পক্ষপাতিত্বের প্রতিটি অভিযোগই ব্রিটেনের ডানপন্থি রাজনীতিবিদ আর পণ্ডিতরা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। তারা এই সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানটিকে স্থায়ীভাবে একটা সতর্কতার মধ্যে রাখতে চায়।

গত বছরের পুরোটাতেই বিবিসি ঠিক এটাই করে গেছে। যার কণ্ঠস্বর যত চড়া, তাদের বিবিসি তুষ্ট করে গেছে। নিজেদের সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়ায়নি বা সত্য প্রকাশের দায়িত্বটা পালন করেনি।

বিবিসি নিউজের সিইও দেবোরাহ টার্নেস এবং ডিরেক্টর জেনারেল টিম ডেভির পদত্যাগও এই বৈপরীত্যটাকেই সামনে এনেছে। পদত্যাগের নোটে টার্নেস তার নিউজরুমের পেশাদারিত্বের প্রশংসা করে জোর দিয়ে বলেছেন, বিবিসি নিউজের বিরুদ্ধে সম্প্রতি প্রাতিষ্ঠানিক পক্ষপাতিত্বের যেসব অভিযোগ উঠেছে, সেগুলো ভুল।

কিন্তু টার্নেসের নিজের স্টাফদের স্বীকারোক্তিগুলো দেখলে বোঝা যায়, তার এই দাবি কতটা ফাঁপা বুলি। ২০২৪-এর নভেম্বরে বিবিসির শতাধিক কর্মী অভ্যন্তরীণ একটি চিঠিতে সই করেছিলেন। ওই চিঠিতে বিবিসির বিরুদ্ধে দ্বিমুখীনীতির অভিযোগ করা হয়। বলা হয়েছে, ইসরাইলকে তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য দায়বদ্ধতার মুখোমুখি করতে প্রতিষ্ঠানটি ব্যর্থ হয়েছে।

এই উত্তেজনাটা এক বছর আগেই মাথাচাড়া দিয়েছিল। ২০২৩-এর নভেম্বরে এক ক্রাইসিস মিটিংয়ে টার্নেস তার স্টাফদের বলেছিলেন, ‘আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে যে, এই সবকিছুর শুরু হয়েছে ৭ অক্টোবর।’ ড্রপ সাইটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাংবাদিকদের মধ্যে তীব্র বাদানুবাদের পর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে না এনে টার্নেসের ওই মন্তব্য বরং ক্ষোভ আরো বাড়িয়ে দেয়। অথচ সাংবাদিকদের অনেকেই মনে করেছেন, শুধু হামাসের হামলার দৃষ্টিকোণ থেকে গাজা যুদ্ধকে ফ্রেমিং করার অর্থ হবে ফিলিস্তিনিদের বহু দশকের উচ্ছেদ ও ইসরাইলি দখলদারিত্বের সব অতীততে মুছে দেওয়া।

সাংবাদিক ওয়েন জোনস বলেছেন, বিবিসির স্টাফরা একটা ভয়ের সংস্কৃতির বিবরণ দিয়েছে। সেখানে এমন একটা সম্পাদকীয় পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে, যেখানে ফিলিস্তিনবিরোধী পক্ষপাত নিয়ে উদ্বেগ জানানোর অর্থই হলো নিজের ক্যারিয়ার শেষ করে দেওয়া। তারা বলেছেন, অভ্যন্তরীণভাবে যেসব অভিযোগ দেওয়া হতো, সেগুলো হয় অগ্রাহ্য করা হতো, অথবা উ পর্যায় থেকে নাকচ করা হতো।

ক্ষোভের যন্ত্র

যখনই বিবিসি ইসরাইলের কর্মকাণ্ডকে প্রকৃত অর্থে ফ্রেম করার চেষ্টা করেছে, তখনই ক্ষোভের যন্ত্র জ্বলে উঠেছে। সরকার হাত গলিয়েছে। ট্যাবলয়েডগুলো হইচই শুরু করেছে। বিবিসি এমনিতেই বহু বছর ধরে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে তাই আবার তারা রক্ষণাত্মক নিরপেক্ষ অবস্থানে ফিরে গেছে। ট্রাম্পের তথ্যচিত্র নিয়ে যে ক্ষোভ, সেটা সাংবাদিকতার সততা নিয়ে নয়। এটা ক্ষমতার খেলা। একটা সরকারি সম্প্রচার যন্ত্রকে এখানে শৃঙ্খলায় আনার প্রশ্ন উঠেছে, যেটা এখনো নিয়মমাফিক জনগণের কাছে জবাব দেওয়ার কথা, বিলিয়নারদের মালিকানার মিডিয়ার কাছে নয়। এটা শব্দের যুদ্ধ, যেখানে সাংবাদিকতার শব্দাবলিকেই অস্ত্র বানিয়ে তোলা হয়েছে।

বিবিসি একটা ভুল কারণে শাস্তি পাচ্ছে। এটা সম্পাদনার ভুলের জন্য তারা নেতৃত্ব হারিয়েছে। অথচ গাজা প্রশ্নে তাদের যে সম্পাদকীয় ব্যর্থতা, সেটার দায়বদ্ধতা থেকে তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। ব্রিটেনের ডানপন্থি মিডিয়াগুলোয় অভিবাসীদের যে দশা হয়েছে, এখানেও অনেকটা সেটাই ঘটছে। সম্প্রচার মাধ্যমগুলোয় সূক্ষ্ম বিষয় বা ভুলগুলোর কোনো জায়গা নেই। তাদের মাথা নত করে থাকতে হবে।

এই পদত্যাগের বিষয়টি কোনো ইঙ্গিত দিচ্ছে না, দিচ্ছে একটা প্রস্তাবনা। প্রতিটি কেলেঙ্কারির ঘটনা ট্যাবলয়েডগুলোকে সাপ্তাহখানেকের জন্য চাঙা রাখে। আসল ইস্যুগুলো ধামাচাপা পড়ে যায়। রাজনৈতিক ক্ষমতার সামনে প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবিসির যে আত্মসমর্পণ, সেই ইস্যুটিও এখানে চাপা পড়ে যাচ্ছে।

সান-এর সাবেক সম্পাদক ডেভিড ইয়েল্যান্ড যেমনটা বলেছেন, বিবিসির শীর্ষপর্যায়ে যারা কার্যকরভাবে একটা অভ্যুত্থান সাজিয়েছেন, তাদের টার্গেট কয়েকজন ব্যক্তি মাত্র নয়। তাদের চূড়ান্ত পুরস্কার হবে পুরো করপোরেশনটাকেই তছনছ করে দেওয়া। ব্রিটেনের ডানপন্থি এবং সেখানকার আরো সাহসী হয়ে ওঠা কট্টর ডানপন্থিদের ব্যাপারে যে জনসেবার সাংবাদিকতা, এই সাংবাদিকতার যেসব অভ্যন্তরীণ শত্রু রয়েছে, তাদের জন্য সেটা হবে এক বিরাট বিজয়।

বিবিসি একটা সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। সামনের রাস্তায় তাদের সামনে আছে সেলফ-সেন্সরশিপ, অন্যকে তুষ্ট করা এবং ফাঁপা ক্ষমা চাওয়ার পথ। অন্য পথটাতে আছে জনগণ, যাদের সেবা দেওয়ার জন্যই এই প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়েছিল। সেই পথে আছে দর্শক, যারা অন্য বিষয়গুলোর সঙ্গে এমন রিপোর্টিং দেখতে চায়, যেখানে ফিলিস্তিনিদের মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে, সমস্যা হিসেবে নয়।

ট্রাম্পকে নিয়ে তৈরি তথ্যচিত্রে হয়তো এডিটিংয়ের ভুল হয়েছে, কিন্তু গাজার গল্পটা নিয়ে যে ভুল করা হচ্ছে, সেটা চলে আসছে দীর্ঘ সময় ধরে। বিবিসি যদি এখনো তাদের নিজেদের মূলমন্ত্র—‘এক জাতি অন্য জাতির সঙ্গে শান্তির ভাষায় কথা বলবে’—এটাতে বিশ্বাস করে, তাহলে সেই শান্তির শুরুটা সততা দিয়েই হতে হবে।

আর সততার শুরু হয় একটা ঘোষণা দিয়ে : আমরা ভুল করেছি, ফিল্ম এডিটিংয়ে নয়, বরং যেভাবে গল্পটা বলা হয়েছে, সেখানে ভুল হয়েছে। আর তারপর তাদের পুরো জনগোষ্ঠীর গল্পটা বলা জারি রাখতে হবে।

মিডল ইস্ট আই অবলম্বনে জুলফিকার হায়দার

প্রধান উপদেষ্টার সম্মতি সত্ত্বেও প্রজ্ঞাপনে কালক্ষেপণ

চুক্তি, আধিপত্যবাদ না অংশীদারত্ব

হাসিনার বিচার নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভূমিকম্প প্রস্তুতি

রাজনীতিতে নির্বাচনি হাওয়া

‘তাজ স্টোরি’ সিনেমা এবং হিন্দুত্ববাদের রাজনীতি

ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল কেন মাধবদী

স্বৈরশাসকদের প্রতি নয়াদিল্লির সমর্থন

যুদ্ধের নীরব অস্ত্র যৌন নিপীড়ন

ভূমিকম্পে সতর্কতা ও করণীয়