বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত লুৎফর রহমান। ব্যক্তিগত জীবনে আইনজীবী। তৃতীয়বারের মতো লন্ডন সিটির টাওয়ার হেমলেট্স কাউন্সিলের নির্বাচিত নির্বাহী মেয়র হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন। তিনবারই নির্বাচিত হয়েছেন তার ব্যক্তিগত ক্যারিশমা দিয়ে। পরাজিত করেছেন লেবার পার্টি ও কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থীকে। টাওয়ার হেমলেট্স কাউন্সিলে দুই সংসদ সদস্যই লেবার পার্টি থেকে নির্বাচিত হন। কিন্তু স্থানীয় সরকারে ব্যক্তির কাছে বারবার পরাজিত হচ্ছেন লেবার পার্টি ও কনজারভেটিভ পার্টির মতো বড় দলের প্রার্থীরা।
স্থানীয় সরকার পরিচালনায় অভিজ্ঞ লুৎফর রহমান জানিয়েছেন, সংস্কারের জন্য বাংলাদেশের বর্তমান সরকার সহযোগিতা নিতে চাইলে বিনা খরচে সব রকম সহযোগিতা দিতে তিনি প্রস্তুত। এজন্য তিনি বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে এক পয়সাও দাবি করবেন না। তার টিম নিয়ে সব রকমের সহযোগিতা দেবেন।
টাওয়ার হেমলেট্স কাউন্সিল ভবনে তার দফতরে আমার দেশ-এর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এই প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। এসময় ব্রিটেনে স্থানীয় সরকার কীভাবে কাজ করে, সেটারও বিষদ বর্ণনা দেন তিনি। তার বর্ণনায় আরও উঠে আসে ব্রিটেনে সংসদ সদস্যরা স্থানীয় সরকারের আওতাধীন কোনো কাজে হস্তক্ষেপ করেন না। এমন হস্তক্ষেপের সুযোগও একেবারেই নেই। সংসদ সদস্যরা রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারের কাজ তদারকি ও আইনকানুন তৈরি করেন। স্থানীয় সরকার স্বাধীনভাবে কাজ করে ব্রিটেনে। স্থানীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে শিক্ষা, পুলিশ, হাউজিং, রাস্তাঘাট, আবাসন ব্যবস্থা, কমিউনিটি সেবা, বর্জ্য নিষ্কাশনসহ সেবা খাতের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো।
সিলেটের কৃতী সন্তান লুৎফর রহমান ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশি ও মুসলিম হিসেবে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত মেয়র হয়েছিলেন। তার আগে আর কোনো ইমিগ্র্যান্ট মুসলিম ও অশ্বেতাঙ্গ সরাসরি ভোটে মেয়র হতে পারেননি। পুরো ব্রিটেনে তখন মাত্র ১৩টি কাউন্সিল ছিল সরাসরি ভোটে মেয়র নির্বাচন পদ্ধতি। বাকি সব কাউন্সিলে মেয়র নির্বাচিত হন কাউন্সিলরদের ভোটে। লুৎফর রহমান যে বছর মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন, তখন ১৩টি কাউন্সিলের ১২টিতেই ছিলেন শ্বেতাঙ্গ মেয়র। একমাত্র লুৎফর রহমান ছিলেন অশ্বেতাঙ্গ। তখন টেলিগ্রাফ পত্রিকা ব্রিটেনের সেরা ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির মধ্যে লুৎফর রহমানকে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। একসময় লেবার পার্টি করতেন। তবে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। এখন তার নিজস্ব গ্রুপ নিয়ে টাওয়ার হেমলেটস কাউন্সিলে একটি দল গঠন করেছেন। শুধু তিনি নন, তার মনোনীত কাউন্সিলর প্রার্থীরাও সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হন।
প্রশ্ন : আপনি তো একাধিকবার নির্বাচিত মেয়র। ব্রিটেনে স্থানীয় সরকারের দায়িত্বের আওতায় কী কী রয়েছে?
লুৎফর রহমান : লোকাল গভর্নমেন্টের কাজের যে এরিয়া রয়েছে, সেটা রান করার দায়িত্ব লোকাল গভর্নমেন্টের। স্থানীয় কমিউিনিটির অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে থাকে লোকাল গভর্নমেন্ট। লুৎফর রহমানের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন লন্ডনে আমার দেশের আবাসিক সম্পাদক ওলিউল্লাহ নোমান।
আমার দেশ : এ দায়িত্ব গুলো কী কী?
লুৎফর রহমান : এডুকেশন, কমিউনিটি সেফটি, হাউজিং, ইয়থ সার্ভিস (ইয়াং পিপল রিলেটেড বিষয়গুলো), সোশ্যাল সার্ভিসেস ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা (পুলিশ) লোকাল গভর্নমেন্টের দায়িত্ব। সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের দায়িত্ব হলো, যেমন হেলথ। তবে স্বাস্থ্যবিষয়ক কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারের সঙ্গে সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট পার্টনারশিপে কাজ করে। ৮০ শতাংশ হেলথ ইস্যুর দায়িত্ব সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের। ২০ শাতংশ হেলথ ইস্যুর দায়িত্ব লোকাল গভর্নমেন্টের। যেমন কমিউনিট হেলথ ইস্যুগুলো স্থানীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে। যেগুলো সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট করে না, সেগুলোর বাজেট সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট থেকে লোকাল গভর্নমেন্টকে দিয়ে দেয়।
আমার দেশ : যুক্তরাজ্যে দুই মডেলের মেয়র পদ্ধতি রয়েছে। এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য কী?
লুৎফর রহমান : দুই মডেলের লোকাল গভর্নমেন্ট রয়েছে যুক্তরাজ্যে, এটা ঠিক। একটা মডেল হলো লিডার অ্যান্ড কেবিনেট। লিডারকে সিলেক্ট করেন মেজরিটি কাউন্সিলর যে পার্টি থেকে বিজয়ী হন তারা। অর্থাৎ কাউন্সিলররা সিলেক্ট করেন লিডার কে হবেন। আরেকটা মডেল হলো, ডাইরেক্টলি ভোটে নির্বাচিত করা হয়। নির্বাচিত নির্বাহী মেয়রের এক্সিকিউটিভ পাওয়ার রয়েছে। কাউন্সিল রান করেন উইথ হিজ কেবিনেট। তবে নির্বাহী ক্ষমতা থাকে মেয়রের হাতে।
আমার দেশ : লন্ডন সিটিতে কয়টি কাউন্সিলে সরাসরি ভোটে ইলেকটেড মেয়র রয়েছেন?
লুৎফর রহমান : লন্ডন সিটির জন্য একজন ইলেকটেড মেয়র রয়েছেন। এটাকে বলা হয় ‘সিটি অব লন্ডন মেয়র’। ৩২টি কাউন্সিল বা বার নিয়ে সিটি অব লন্ডন। এই ৩২টির মধ্যে পাঁচটি কাউন্সিলে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত নির্বাহী মেয়র পদ্ধতির লোকাল গভর্নমেন্ট। বাকিগুলো লিডার অ্যান্ড কেবিনেট সিস্টেম।
আমার দেশ : নির্বাহী মেয়র হিসেবে আপনার রেসপন্সিবিলিটি কী?
লুৎফর রহমান : প্রত্যেক কাউন্সিল বাউন্ডারির মধ্যে বসবাসকারী নাগরিকদের দেখাশোনার দায়িত্ব হচ্ছে কাউন্সিলের। ইলেকটেড মেয়র হিসেবে এই রেসপন্সিবিলিটি এখন আমার। আমার কেবিনেট ও কাউন্সিলদের সঙ্গে নিয়ে এই দায়িত্ব পালন করতে হয়।
আমার দেশ : শুরুর দিকে আপনি বলেছিলেন, এডুকেশনের দায়িত্ব লোকাল গভর্নমেন্টের। এক্ষেত্রে কী কী দায়িত্ব আপনারা পালন করেন।
লুৎফর রহমান : এভরিথিং। আর্লি অ্যাজ, অর্থাৎ একটা বাচ্চার যখন তিন বছর, তখন থেকে প্রি-নার্সারি শুরু হয়। এই প্রি-নার্সারি থেকে শুরু করে এ লেভেল পর্যন্ত সব দায়িত্ব কাউন্সিলের।
আমার দেশ : এটা তো বুঝলাম, শিশুশ্রেণি থেকে এ লেভেল পর্যন্ত কাউন্সিল বাচ্চাদের দায়িত্ব পালন করে। স্কুলগুলো কোন সংস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত—স্থানীয় সরকার, নাকি সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট?
লুৎফর রহমান : স্কুলের বিল্ডিংয়ের দায়িত্ব আমাদের (লোকাল গভর্নমেন্টের)। স্কুলের জমির দায়িত্ব আমাদের। বিল্ডিং প্রোভাইট করা, বিল্ডিংয়ের নার্সি করা, নেইস করা—এগুলো আমাদের দায়িত্ব। ইন্ডিভিজ্যুয়ালি এডুকেশন সিস্টেম রান করে গভর্নমেন্ট বডি। কিন্তু স্কুলশিক্ষকদের বেতন-ভাতা দেয় লোকাল গভর্নমেন্ট। প্রধান শিক্ষকসহ স্কুলে যারা শিক্ষকতা করেন, তারা সকলেই কাউন্সিলের স্টাফ। তাদের বেতন-ভাতা যায় কাউন্সিলের তহবিল থেকে। সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট শুধু এডুকেশন সিস্টেম তৈরি করে দেয়।
আমার দেশ : আপনার কাউন্সিলে কতজন শিক্ষকের বেতন-ভাতা দেন?
লুৎফর রহমান : টাওয়ারহেমলেট্স কাউন্সিলে স্কুলের ছয় হাজার এমপ্লয়ি রয়েছেন। তাদের হায়ার অ্যান্ড ফায়ারের রেসপন্সিবিলিটি কাউন্সিলের। সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের এখানে কোনো হাত নেই।
আমার দেশ : স্কুলে ভর্তির প্রক্রিয়া কী? স্কুল নিজেই কি ভর্তির দায়িত্ব পালন করে?
লুৎফর রহমান : স্টুডেন্টদের অ্যাডমিশন রেসপন্সিবিলিটি কাউন্সিলের। স্কুলে ভর্তির জন্য কাউন্সিলের নির্ধারিত এডুকেশন অফিসে আবেদন করতে হয়। কাউন্সিল নিজস্ব পলিসি অনুযায়ী ঠিক করে দেয় কে কোথায় ভর্তির সুযোগ পাবেন। কাউন্সিল থেকে মনোনীত স্কুলে যায় আবেদনকারীর তথ্য। যেমন একটা বাচ্চা প্রাইমারি স্কুল থেকে যাবে সেকেন্ডারি স্কুলে। সেকেন্ডারি স্কুলের জন্য আবেদন করতে হয় কাউন্সিলের নির্ধারিত এডুকেশন দফতরে। কাউন্সিল পলিসি অনুযায়ী নির্ধারণ করে দেয় বাচ্চা কোন স্কুলে সেকেন্ডারিতে যাবে। কাউন্সিলের অ্যাডুকেশন অফিসাররা এগুলো মেইনটেইন করেন। কোনো স্টুডেন্ট যদি তার ফার্স্ট চয়েস স্কুল না পায়, তখন আপিল করবে কাউন্সিলের নির্ধারিত দফতরে। সরাসরি কোনো স্কুলে যাওয়ার সুযোগ নেই। কাউন্সিলের অ্যাডুকেশন সার্ভিস ডিপার্টমেন্ট আছে। তারা এটা লুক আফটার করেন।
আমার দেশ : ব্রিটেনে নাগরিকদের বাসাও বরাদ্দ দেয়। এটা তো কাউন্সিলের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এ বিষয়ে যদি কিছু বলতেন।
লুৎফর রহমান : কাউন্সিল হোমস আছে। আমরা বলি সোশ্যাল হোম্স। যারা বাড়ি কিনতে পারেন, তারা তো নিজের বাড়িতে থাকেন, কিন্তু অনেক মানুষ আছেন যারা বাড়ি কেনার মতো টাকা অ্যাফর্ড করতে পারেন না। এ ধরনের নিম্ন আয়ের মানুষকে পাবলিক সেক্টরের বাড়ি প্রোভাইড করার দায়িত্ব কাউন্সিলের। এজন্য কাউন্সিলের ফান্ড আছে। সরকার থেকেও নির্ধারিত কিছু ফান্ড দেওয়া হয়। কাউন্সিলের নিজস্ব আছে ২৬ হাজার। এছাড়া হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে। তারা পাবলিক বডি। তারাও হাউজিং প্রোভাইড করেন কাউন্সিলের সঙ্গে শেয়ারিংয়ের ভিত্তিতে। তবে এটারও একটা প্রক্রিয়া রয়েছে। যারা সোশ্যাল হাউজিংয়ের জন্য আবেদন করার যোগ্য, তারা নির্ধারিত ক্রাইটেরিয়া মেইনটেইন করে আবেদন করেন। তারপর আবেদন যাছাই-বাছাই করে একটা ওয়েটিং লিস্ট তৈরি করা হয়। ওয়েটিং লিস্টে যারা অন্তর্ভুক্ত হন, তারা হাউজিংয়ের নিয়ম অনুযায়ী বিটিং করতে থাকেন। প্রতি সপ্তাহে কয়েকটা বাড়ি আসে বিটিংয়ের জন্য। বিটিংয়ের মাধ্যমে নির্ধারিত হয় কে আগে পাবেন। যারা বরাদ্দ পাবেন, তারা কাউন্সিলকে ভাড়া দেবেন।
আমার দেশ : টাওয়ার হেমলেট্স কাউন্সিলে বর্তমানে ওয়েটিং লিস্টে কত আবেদন আছে?
লুৎফর রহমান : ওয়েটিং লিস্টে এখন আছে ২৩ হাজার আবেদন। কিন্তু তাদের মধ্যে সবার বাড়ি এখনই দরকার নেই। ওয়েটিং লিস্টে যারা আছেন প্রয়োজন অনুযায়ী বিটিং করে পাঁচ-ছয়-সাত বছর পর পাবেন। কারণ অনেক অ্যাপ্লিকেন্ট রয়েছেন, যাদের এখনই বাড়ি দরকার নেই। যেমন অনেকে কাউন্সিল হাউসে আছেন। কিন্তু তাদের পরিবারের সদস্যসংখ্যা বেড়ে গেছে। আগে দুই বেডরুম ছিল। এখন তিন অথবা চার বেডরুম প্রয়োজন। তাদের ধারাবাহিকভাবে দেওয়া হয়।
আমার দেশ : সোশ্যাল সার্ভিসে কাউন্সিল কী দায়িত্ব পালন করে থাকে?
লুৎফর রহমান : বয়স্ক যারা আছেন, অসুস্থ আছেন, তাদের সোশ্যাল সার্ভিস প্রয়োজন হয়। কাউন্সিল থেকে এ ধরনের মানুষকে সোশ্যাল কেয়ার দেওয়া হয়। তাদের জন্য ওয়েলফেয়ার, লুখ আফটার করা, সাপোর্ট দেওয়া—এগুলো কাউন্সিলের দায়িত্ব। অনেক ইয়াং বাচ্চা আছে, যাদের বিভিন্ন রকম অসুস্থাতা রয়েছে। এ ধরনের বাচ্চাদের (শিশু-কিশোর) তাদের সাপোর্ট লাগে। এই সাপোর্ট কাউন্সিল থেকে প্রোভাইড করা হয়।
আমার দেশ : এই সোশ্যাল সার্ভিস খাতে আপনার কাউন্সিলের বছরে কত খরচ হয়?
লুৎফর রহমান : সোশ্যাল কেয়ারের জন্য বছরে ২৫০ মিলিয়ন পাউন্ড বাজেট রয়েছে, যা শুধু এই কেয়ার খাতে খরচ করা হয়। এই প্যাকেজ হচ্ছে মানুষের ঘরে গিয়ে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য।
আমার দেশ : আমরা যতটুকু জানি হোম কেয়ারের জন্য কিছু চার্জ করা হয়। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?
লুৎফর রহমান : আমি যখন প্রথম মেয়র হয়েছিলাম, তখন সবার জন্য ফ্রি হোম কেয়ার চালু করেছিলাম কাউন্সিলের বাজেটে। মাঝে আমি ছিলাম না। এই সময়ে আবারও চালু করা হয়েছিল চার্জ। আগামী এপ্রিল থেকে আবার ফ্রি হোম কেয়ার চালু হবে এই কাউন্সিলে। সারা দেশের মধ্যে এই কাউন্সিলেই প্রথম ফ্রি কেয়ার সার্ভিস চালু করেছিলাম। আবারও চালু করতে যাচ্ছি। এজন্য খরচ হবে ৫০৬ মিলিয়ন পাউন্ড।
আমার দেশ : রাস্তাঘাট মেরামত ও পরিচ্ছন্নতার দায়িত্ব কারা পালন করে?
লুৎফর রহমান : রাস্তাঘাট মেরামত, রাস্তায় লাইটিং—এগুলো আমরা করে থাকি। পরিচ্ছন্নতার দায়িত্বও কাউন্সিলের। প্রতি সপ্তাহে বাসাবাড়ি থেকে ওয়েস্ট কালেক্ট করা হয়। রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্ন রাখা—সবই কাউন্সিল করে থাকে। কিছু রাস্তা রয়েছে, যেগুলোর দায়িত্ব মেয়র অব লন্ডনের। এগুলো বড় রাস্তা। ছোট রাস্তাগুলোর সবই কাউন্সিলের দায়িত্ব। রাস্তার সেইফটি, মেরামত, লাইটিং—এগুলো সব আমাদের দায়িত্ব।
আমার দেশ : কাউন্সিলের অধীনস্থ এলাকায় মার্কেটগুলোর দেখাশোনার দায়িত্ব কোন সংস্থার?
লুৎফর রহমান : অধীনস্থ এরিয়ার সব মার্কেটের দায়িত্ব কাউন্সিলের। মার্কেটের দোকান থেকে আমরা ভাড়া পাই। মেইনটেইনেন্স আমরা করি। রাষ্ট্রীয় ডিফেন্স সিকিউরিটি ছাড়া বাকি সবকিছুর রেসপন্সিবিলিটি আমাদের।
আমার দেশ : লোকাল বাস সার্ভিস ও গ্যাস বিদ্যুৎ কারা দেখাশোনা করেন?
লুৎফর রহমান : বাস সার্ভিস আমাদের দায়িত্বে নয়। এই দায়িত্ব সিটি অব লন্ডন মেয়রের। গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর দায়িত্ব। এগুলো মনিটরিং করে সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট।
আমার দেশ : কাউন্সিলের দায়িত্ব পালন ও নাগরিক সেবা দিতে যেসব খরচ হয়, সেটার কীভাবে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স বা অ্যাকাউন্টিবিলিটি নিশ্চিত করা হয়?
লুৎফর রহমান : কাউন্সিলের ডাইরেক্ট স্টাফ সাড়ে পাঁচ হাজার এবং স্কুলের স্টাফ ছয় হাজার। সব মিলে নিয়ারলি ১২ হাজার স্টাফ রয়েছে। কাউন্সিলের দায়িত্ব তাদের পারফরম্যান্স মনিটর ও অ্যাকাউন্টিবিলিটি মেইনটেইন করা। এক্সিকিউটিভ মেয়র হিসেবে আমার কেবিনেট আছে। সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট টিম আছে। আমরা সমন্বিতভাবে ডে টু ডে ম্যানেজমেন্ট করে থাকি। কাউন্সিলের কেবিনেট মেম্বার যারা রয়েছেন, তারা মনিটর করেন। সিনিয়র ডাইরেক্টর যারা আছেন, তারা মনিটর করেন। এক্সিকিউটিভ মেয়র হিসেবে আমি এসব ওভার সি করি।
আমার দেশ : উন্নয়ন কাজের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের জন্য কি সরকারের কোনো মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হয়?
লুৎফর রহমান : কাউন্সিলের যত রকমের ডেভলপমেন্ট কাজ রয়েছে, সবগুলোর প্ল্যানিং অথরিটি আমরা (কাউন্সিল)। কাউন্সিলের একটি স্ট্র্যাটেজিক ডেভেলপমেন্ট কমিটি রয়েছে। এই কমিটি উন্নয়নমূলক কাজের প্ল্যান অনুমোদন করেন। বিজনেসের লাইসেন্স অথরিটি কমিটি রয়েছে। তারা লাইসেন্সের বিষয়গুলো দেখাশোনা করেন। মোর ইমপোর্টেন্ট হলো, টাওয়ার হেমলেট্সের ল্যান্ড ভ্যালু অনেক হাই। ঢাকায় যেমন গুলশানের ল্যান্ড ভ্যালু, এর চেয়ে আরও বেশি এই কাউন্সিলের ল্যান্ড ভ্যালু। কারণ আমরা ইন এ সিটি বার। কেউ যদি এখানে একটি বিল্ডিং তৈরি করতে চান, কাউন্সিলের কাছে আগে যেতে হবে। পারমিশন নিতে হবে কাউন্সিল থেকে। আর কাউন্সিলের পারমিশন পেতে হলে প্রাইভেট ডেভেলপার কাউন্সিলকে একটি অংশ দিতে হয়।
আমার দেশ : এই যে বললেন, এখানে বিল্ডিং তৈরি করতে হলে কাউন্সিলকে একটি অংশ দেওয়া লাগে, এটা কেমন করে হয়?
লুৎফর রহমান : এখানে একটি উদাহরণ দিলেই পরিষ্কার হয়ে যাব। যেমন আপনি যদি এখানে একটি বিল্ডিং তৈরি করতে চান—১০০ ফ্ল্যাট হলে ৩৫ শতাংশ কাউন্সিলকে দিতে হবে।
আমার দেশ : এটা কি কাউন্সিলের জমির ক্ষেত্রে, নাকি প্রাইভেট জায়গায় করলেও দিতে হয়?
লুৎফর রহমান : প্রাইভেট জমিতেও কেউ যদি বিল্ডিং করতে চায়, কাউন্সিলকে একটি অংশ দিতে হবে। যেমন আপনি যদি এখানে নিজের জমিতে একটি বিল্ডিং করেন, যে বিল্ডিংয়ে ৯টির বেশি ফ্ল্যাট হবে, একটি নির্ধারিত অংশ কাউন্সিলকে দিতে হবে।
আমার দেশ : ব্যবসা-বাণিজ্যের বিজনেস ট্যাক্স কি কেন্দ্রীয় সরকার নেয়, নাকি কাউন্সিলকে দিতে হয়?
লুৎফর রহমান : ব্যবসা করতে হলে ট্যাক্স দিতে হয়। এই ট্যাক্সের ৭০ শতাংশ কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিলে যায়। ৩০ শতাংশ আসে কাউন্সিলের তহবিলে।
আমার দেশ : কাউন্সিলের উন্নয়ন খরচ, স্কুল পরিচালনা ও নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন কোথা থেকে আসে?
লুৎফর রহমান : উন্নয়ন খরচ ও অন্যান্য দায় মেটানোর জন্য সরকার থেকে প্রতি বছর একটি বরাদ্দ আসে। বছরে প্রায় ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন পাউন্ড পাওয়া যায় সরকারি গ্রান্ট। কাউন্সিলের বাজেট ছয় বিলিয়নের ওপরে। বাকিগুলো কালেকশন করা হয় কাউন্সিল ট্যাক্স ও বিজনেস রেট থেকে। এদিক থেকে আমরা লন্ডনের একটি ধনী কাউন্সিল। এই কাউন্সিলের অধীনে কেনারি ওয়ার্ফ হচ্ছে এখন একটি বিজনেস এরিয়া। এখান থেকে একটা হিউজ অ্যামাউন্ট বিজনেস রেন্ট পাওয়া যায়। এছাড়া আরও যত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে, সেগুলো থেকেও আসে।
আমার দেশ : আপনি যে ট্রানজেকশনের কথা বললেন, এগুলো নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে যারা রয়েছে, তাদের কীভাবে জবাবদিহির মধ্যে রাখা হয়? কারণ আমাদের বাংলাদেশে যেখানেই টাকা-পয়সার বিষয় রয়েছে, সেখানেই দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। আপনার এখানে দুর্নীতি ঠেকানোর জন্য কী পদ্ধতি রয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে কী ব্যবস্থা রয়েছে?
লুৎফর রহমান : বছরে একবার অডিট হয়। প্রতি বছর একটি স্বাধীন অডিট কোম্পানির মাধ্যমে সব অডিট করা হয়। আমাদের কাউন্সিল অডিট করেন পৃথিবীর সেরা ১০টি অডিট কোম্পানির একটি। কেন্দ্রীয় সরকার এই কোম্পানিকে অ্যাপোয়েন্ট করে থাকে। এক মিলিয়ন পাউন্ড অডিট কোম্পানিকে দিতে হয়। এই কোম্পানি বছরে একবার আমাদের অ্যাকাউন্টস অডিট করে থাকে। অডিটে বুক ব্যালেন্স হতে হবে। কম-বেশি হলে জবাবদিহি করা লাগে আমাদের। অডিটের সময় সব ফাইন্যান্সিয়াল রেকর্ড পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়ে থাকে। এছাড়া কাউন্সিলের অভ্যন্তরীণ অডিটর রয়েছেন। বছরের মধ্যে প্রতি তিন মাস পরপর একটি অডিট রিপোর্ট এক্সিকিউটিভ মেয়রকে দিতে হয়। এটি মেয়রের কেবিনেটে উত্থাপন করা লাগে। কেবিনেট তখন পরীক্ষা করে দেখে, এখানে কোনো ইস্যু আছে কি না। অতএব, করাপশনের সুযোগ নেই বললেই চলে। আর অভিযোগ উঠলে এটা তদন্তের জন্য কাউন্সিলের নিজস্ব কমিটি রয়েছে। কেবিনেটে আলোচনা করে কমিটিকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারা তদন্ত করে প্রতিবেদন পেশ করেন। এছাড়া এটা এক্সটার্নাল অডিটরকেও জানাতে হয়। জবাবদিহির জন্য তিনটি পদ্ধতি রয়েছে—১. বিরোধী দলের কাউন্সিলর যারা আছেন তারা এবং পজিশনের যারা আছেন, তাদের নিয়ে একটি কমিটি রয়েছে। তারা মনিটর করেন। ২. অডিট কমিটি রয়েছে। অডিট কমিটিতে ইন্ডিপেনডেন্ট মানুষ বসেন। তাদের দায়িত্ব ফাইন্যান্সিয়াল ম্যাটার চেক করা, স্ত্রুটিনাইজ করা এবং সুপারিশ পেশ করা। ৩. ফাইনালি অডিট করে এক্সটার্নাল অডিট কোম্পানি।
আমার দেশ : আপনার কাউন্সিলের অধীনে কতটি সংসদ আসন রয়েছে? সংসদ সদস্যরা কি কাউন্সিলের কাছে হস্তক্ষেপ করেন?
লুৎফর রহমান : টাওয়ার হেমলেট্স কাউন্সিল এরিয়ায় তিনটি সংসদ আসন রয়েছে। তারা তাদের দায়িত্ব পালন করে। এমপির দায়িত্ব আইন প্রণয়ন ও সরকারের কাজ মনিটর করা। এমপির কখনো স্থানীয় সরকারের কাজে কোনো রকমের হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। কোনো এমপি কখনো হস্তক্ষেপও করেন না। তাদের দায়িত্ব রাষ্ট্রীয় বিষয় নিয়ে। তারা বড় জিনিস নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। স্থানীয় সরকারের দায়িত্ব স্থানীয় বিষয়ে তদারকি করা।
আমার দেশ : কোনো কাজের অনুমোদনের জন্য কি ডিসি বা অন্য কোনো দফতরে যেতে হয়?
লুৎফর রহমান : না। কোনো কাজের জন্য অন্য কোনো দফতরে যেতে হয় না। লোকাল গভর্নমেন্টের দায়িত্বের আওতায় যেসব বিষয় রয়েছে, সেগুলোর জন্য অন্য কোনো দফতরে যাওয়া লাগে না।
আমার দেশ : বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার সংস্কারে কোনো রকমের সহযোগিতা করার আগ্রহ আছে কি আপনার?
লুৎফর রহমান : বাংলাদেশ সরকার যদি চায়, আমরা স্থানীয় সরকার সংস্কারের জন্য সহযোগিতা করতে সব সময় প্রস্তুত রয়েছি। আমাদের এই কাউন্সিল স্থানীয় সরকার পরিচালনায় এক্সপার্টিজ রয়েছে। আমি চাই এই এক্সপার্টিজ দিয়ে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে।
আমার দেশ : ব্যস্ততার মাঝেও আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
লুৎফর রহমান : আপনাকে এবং আপনার মাধ্যমে আমার দেশ কর্তৃপক্ষ বিশেষ করে সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে শ্রদ্ধা ও ধন্যবাদ জানাতে চাই। নতুন করে আবার আমার দেশ শুরু হচ্ছে শুনে আনন্দিত হলাম।