বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে বেগম খালেদা জিয়া (১৫ আগস্ট ১৯৪৫ – ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৫) স্মরণীয় হয়ে থাকবেন আপসহীনতা, দৃঢ়তা এবং ব্যক্তিগত ত্যাগের এক বিরল প্রতীক হিসেবে। শতাধিক বছরের উপমহাদেশীয় রাজনৈতিক ইতিহাসে তিনি এমন একজন রাজনীতিক, যিনি প্রবল প্রতিকূলতা, ব্যক্তিগত কষ্ট ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মুখেও প্রতিপক্ষের সঙ্গে ন্যূনতম আপসে যাননি।
১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সেনা অভ্যুত্থানে শহীদ হওয়ার পর অল্প বয়সেই তিনি বিধবা হন—যা ছিল সে সময়কার আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ভূরাজনীতির জটিল বাস্তবতার অংশ। এরপর দীর্ঘদিন ধরে তিনি সরাসরি বৈদেশিক প্রভাববলয়ের চাপের মধ্যেই রাজনীতি করেছেন।
১৯৮০-এর দশকে সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে তাঁর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯৮৬ সালের বিতর্কিত ও পাতানো নির্বাচনে আওয়ামী লীগসহ বহু রাজনৈতিক শক্তি অংশ নিলেও তিনি সেই নির্বাচনি প্রক্রিয়াকে বৈধতা দিতে অস্বীকৃতি জানান।
স্বৈরাচার পতনের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে, ভোটের ঠিক দুই দিন আগে ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১, ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউয়ে আয়োজিত এক বিশাল জনসভায় তিনি যে বক্তব্য দেন, “আমাদের হাতে স্বাধীনতার পতাকা, অন্যদের হাতে গোলামির শৃঙ্খল” । আজও বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম স্মরণীয় উক্তি হিসেবে তার সেই কথা উদ্ধৃত হয়।
তিনি ১৯৯১–১৯৯৬ এবং ২০০১–২০০৬ মেয়াদে দুই দফা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এই দুই মেয়াদেই আন্তর্জাতিক ক্ষমতার ভারসাম্য, বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাবশালী শক্তিগুলোর চাপ তাঁকে নানাভাবে মোকাবিলা করতে হয়েছে। মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধে বাংলাদেশ সেনা পাঠানোর অনুরোধ তিনি প্রত্যাখ্যান করেন (সূত্র:The New York Times, April 2003; Bangladesh Ministry of Foreign Affairs briefing)। একইভাবে, ‘ওয়ার অন টেরর’-এর অংশ হিসেবে মার্কিন প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী কঠোর নিরাপত্তা কাঠামো আরোপে তিনি সম্মতি দেননি—যা পরবর্তী সময়ে তাঁর রাজনৈতিক জীবনে বড় মূল্য আদায় করে নেয়।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থার পর থেকে তাঁর জীবনে শুরু হয় দীর্ঘ নিপীড়ন ও বিচ্ছিন্নতার অধ্যায়। একের পর এক মামলায় তাঁকে কারাবন্দি করা হয়। বার্ধক্য ও গুরুতর অসুস্থতার মধ্যেও কারাবন্দি অবস্থায় তিনি যথাযথ চিকিৎসা পাননি বলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করে। গৃহবন্দি অবস্থাতেও তাঁকে বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি দেওয়া হয়নি।
২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে আপসের নানা চাপ থাকা সত্ত্বেও তিনি সেই পথে হাঁটেননি। অসুস্থ শরীর নিয়েও তিনি তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান থেকে সরে দাঁড়াননি, যা তাঁর সমর্থক-সমালোচক উভয়ের কাছেই তাঁকে এক অনমনীয় রাজনৈতিক চরিত্রে পরিণত করেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে এমন ব্যক্তিগত দৃঢ়তা, একজন রাজনৈতিক নেত্রীর ক্ষেত্রে, অত্যন্ত বিরল। রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থেকেও তিনি যে নৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন, ইতিহাসে তাঁর মূল্যায়ন সেখানেই সবচেয়ে স্পষ্ট হবে।