আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর নারী কর্মীদের প্রচারণার কৌশলকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে বিএনপি। দলটির মহিলা বিভাগকে নির্বাচনি প্রচারণার পাশাপাশি কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও সক্রিয় করা হয়েছে। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতসহ বিদেশি প্রতিনিধিদলের সদস্যরা নিয়মিত বৈঠক করছেন মহিলা জামায়াতের সঙ্গে।
বিএনপির প্রার্থী নির্বাচন এখনো চূড়ান্ত না হলেও সারা দেশে জামায়াতের নারী কর্মীরা পুরোদমে নির্বাচনি প্রচারণায় মাঠে নেমেছেন। বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, জামায়াতের নারী কর্মীরা বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা এবং বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদান বা ওয়েলফেয়ার পলিটিকসের মাধ্যমে দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে ভোট চাইছেন। অন্যদিকে, জামায়াতের মহিলা দলের নেত্রীরা দাবি করছেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে দলীয় প্রচারণার সময় তাদের কর্মীরা হয়রানি ও হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। একই অভিযোগ করেছেন দলের নেতারাও।
মহিলা জামায়াতের সেক্রেটারি নূরুন্নিসা সিদ্দিকা আমার দেশকে জানান, প্রতিদিন দলের কয়েক হাজার কর্মী নির্বাচনি প্রচারে নিয়োজিত আছেন। তারা উঠোন বৈঠক করছেন। নারীদের কাছে দলের প্রার্থীদের পরিচিত করছেন। এসব বৈঠকে ভোটারদের কাছে ভোট দেওয়ার গুরুত্ব তুলে ধরা হচ্ছে।
তিনি অভিযোগ করেন, নির্বাচনি প্রচারণার ক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন স্থানে তাদের কর্মীরা বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। তফসিল ঘোষণার আগে যদি দলীয় কাজে বাধা দেওয়া হয়, তাহলে নির্বাচন কমিশন কীভাবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করবে, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
অন্যদিকে, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান নার্গিস বেগম বলেছেন, অনেক আগে থেকেই মহিলা জামায়াতের কর্মীরা নির্বাচনি প্রচারণায় নেমেছেন। তারা প্রথমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তালিমের কথা বলতেন। এখন চাল, ডাল ও অর্থ বিতরণের মতো কাজ করছেন। যাকে আমরা ওয়েলফেয়ার পলিটিকস বলে থাকি, সেটি এখন জামায়াতের নারী কর্মীরা করছেন।
যশোর এলাকায় বিএনপির নির্বাচনি কাজ তদারকি করছেন নার্গিস বেগম। মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, জামায়াতের নারী কর্মীরা দিনের বিভিন্ন সময় নানাভাবে বিভক্ত হয়ে নির্বাচনি প্রচার চালাচ্ছেন। তাদের আর্থিক সুবিধা দেওয়ার এই রাজনীতির বিপরীতে আমরা কর্মীদের বলেছি, দান-খয়রাত নয়, বিএনপি ক্ষমতায় এলে গরিব মানুষের অভাব দূর হবে। সরকারিভাবে সে ধরনের কর্মসূচি নেওয়া হবে।
তিনি আরো বলেন, ওয়েলফেয়ার পলিটিকসের অংশ হিসেবে জামায়াতের নারী কর্মীরা গর্ভবতী মায়েদের চিকিৎসা সুবিধা দেওয়াসহ নানা ধরনের আর্থিক সম্পৃক্ত কাজ করছে। তিনি অবশ্য জামায়াতের মহিলা কর্মীদের বাধা দেওয়ার অভিযোগ নাকচ করে দেন।
জামায়াতের মহিলা কর্মীদের নির্বাচনি প্রচারণা জোরদার করার পর অনেক এলাকায় বিএনপির মহিলা কর্মীরাও মাঠে সক্রিয় হয়েছেন। বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির মৎস্যজীবীবিষয়ক সম্পাদক ও কক্সবাজার-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য লুৎফুর রহমান কাজল জানান, অতীতে তফসিল ঘোষণার আগে মহিলাদের নির্বাচনি প্রচারণা দেখা যায়নি। এবার জামায়াত আগে প্রচারণা শুরু করায় তার দলের মহিলা নেতাকর্মীরাও বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন। নির্বাচনি সভা-সমাবেশ ও উঠোন বৈঠক করছেন। তিনি অবশ্য এই প্রচারণাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। এতে ভোটাররা প্রার্থী সম্পর্কে আগে জানতে পারছেন। তাতে ভোটদানে তারা উৎসাহিত হবেন।
এদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে মহিলা জামায়াতের কর্মীদের ওপর হামলার ঘটনায় দলটির ভেতরে বেশ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। নোয়াখালী, নওগাঁ, ঝিনাইদহসহ কিছু এলাকায় মহিলা জামায়াতের সমাবেশে হামলা ও পণ্ড করার অভিযোগ করেছে দলটি। দলের সেক্রেটারি মিয়া গোলাম পরওয়ার বিবৃতিতে বিএনপিকে সতর্ক করে এ ধরনের হামলা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
জামায়াতের বাইরেও নারী কর্মীদের ওপর হামলার প্রতিক্রিয়া এসেছে। দলটির নেতাকর্মী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভিযোগ করেছেন, নারী কর্মীদের রক্ষায় সরব নয় জামায়াত। এ ব্যাপারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের এজিএস আয়েশা সিদ্দিকা মেঘলা গত বুধবার ফেসবুক স্ট্যাটাসে অভিযোগ করেন, জামায়াতের মহিলা কর্মীরা যখন আক্রমণের, কটূক্তির শিকার হন, তখন জামায়াতের অফিশিয়াল পেজ থেকে কোনো বিবৃতি যায় না। কোনো প্রতিবাদ হয় না।
তিনি আরো লেখেন, যারা নিজেদের দলের কিংবা নিজেদের মতাদর্শীয় দলের নারীদের জন্য প্রতিবাদ করতে পারে না, নারীদের নিরাপত্তা দিতে পারে না, তারা কীভাবে অন্য নারীদের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে?
কূটনৈতিক তৎপরতায় মহিলা জামায়াত
এদিকে নির্বাচনি প্রচারণার পাশাপাশি কূটনৈতিক তৎপরতায় সক্রিয় করা হয়েছে জামায়াতে ইসলামীর মহিলা বিভাগকে। বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নিয়েছেন মহিলা জামায়াতের নেত্রীরা। সর্বশেষ ২০ অক্টোবর দলটির মহিলা বিভাগের ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডেপুটি চিফ বাইবা জারিনার আমন্ত্রণে ঢাকার ইইউ কার্যালয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ ও বৈঠকে মিলিত হয়েছেন। এসময় বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, রাজনীতিতে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ, নারী সমাজের অধিকার সুরক্ষা, কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নে নারীর ইতিবাচক ভূমিকা নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা হয় বলে মহিলা জামায়াতের নেত্রীরা জানিয়েছেন।
এর আগে বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুকের সঙ্গে বৈঠক করেন মহিলা জামায়াতের নেত্রীরা। ব্রিটিশ হাইকমিশনার নারীর ক্ষমতায়ন এবং তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেন। এতে জামায়াতের মহিলা বিভাগের নেত্রীরা তাদের চিন্তাভাবনা এবং অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন।
গত ২১ জুলাই জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানসহ শীর্ষ নেতাদের পাশে বসে মার্কিন দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সের সঙ্গেও বৈঠক করেন দলটির মহিলা বিভাগের নেত্রীরা। মহিলা বিভাগের কূটনৈতিক তৎপরতার বিষয়ে জানতে চাইলে নূরুন্নিসা সিদ্দিকা বলেন, দলের কোন বিভাগ কখন কী দায়িত্ব পালন করবে, তা সাংগঠনিক সিদ্ধান্তের বিষয়। তবে বিদেশি রাষ্ট্রদূত ও সংস্থাগুলো জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ নিয়ে জানতে চাইছে। আমরা এখন তাদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করছি। তারা দেখছে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিতে যথেষ্ট নারীর অংশগ্রহণ আছে। তারা যোগ্য ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রস্তুত। তারা বিভিন্ন বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান জানতে চাইছে এবং আমাদের জবাবে তারা সন্তুষ্ট বলে মনে হচ্ছে।
নির্বাচনে নারী প্রার্থী দেওয়া নিয়ে আলোচনা
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী সরাসরি নারী প্রার্থী দেবে কি নাÑতা নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা আছে। জামায়াতে ইসলামীর ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানিয়েছে, এ ব্যাপারে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। তবে প্রার্থী দেওয়া হবে না, এমন সিদ্ধান্তও হয়নি। নির্বাচনে রাজনীতিতে জামায়াতের মহিলা বিভাগের তৎপরতায় কেন্দ্রীয় নেতারা সন্তুষ্ট। তারা মনে করেন, নারী কর্মীরা নির্বাচনে বিজয়ী হতে গেম চেঞ্জারের ভূমিকা পালন করতে পারে।
নির্বাচনে নারী প্রার্থী দেওয়া হবে কি না এ বিষয়ে জানতে চাইলে নূরুন্নিসা সিদ্দিকা জানান, এ ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বর্তমান পরিবেশ পরিস্থিতিতে নারী প্রার্থী দেওয়া যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের। নারীদের বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়।
তিনি বলেন, ডাকসু নির্বাচনে নারী প্রার্থীরা সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন। সমাজে নারীদের ব্যাপারে মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। যদি পরিস্থিতি অনুকূল হয় নারী প্রার্থী দিতে সমস্যা নেই বলে মনে করেন তিনি।
স্থানীয় নির্বাচনে নারী প্রার্থীদের অংশগ্রহণ
জামায়াতে ইসলামী ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসনে দু’জন নারী সদস্য দিয়েছিল। ২০০১ সালের সংসদে সংরক্ষিত আসনে দলটির নারী সংসদ সদস্য ছিলেন চারজন। তবে সংসদ নির্বাচনে কখনও জামায়াত নারী প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়নি। সরাসরি নির্বাচনে জামায়াতের নারী প্রার্থীরা অংশ নিয়েছিলেন ২০০৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে। এই নির্বাচনে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১২ জন নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর ২০১৪ সালে চতুর্থ উপজেলা পরিষদ ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচনে মহিলা বিভাগ থেকে ৩৬ জন নির্বাচিত হন।
জামায়াতে ইসলামীর কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, আগামী দিনে নির্বাচনি রাজনীতিতে নারী নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর ব্যাপারে তারা আরো বেশি মনোযোগ দেবেন। দুটি উপজেলা নির্বাচনে তাদের সাফল্যের হার ছিল সন্তোষজনক। ফলে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ জামায়াতকে শক্তিশালী করবে বলে তারা মনে করেন।