‘প্রতিটি জেলায় স্টেডিয়াম অকুপাই করে রেখেছে ফুটবল। যেখানে ফুটবলের কাজ নেই, সেখানেই স্টেডিয়াম অকুপাই করে রেখেছে। ফুটবলারদের ব্যবহার খুব খারাপ, এটা আমি সরাসরি বলতে চাই। কারণ, ক্রিকেট একটা ডিসিপ্লিনড খেলা, আভিজাত্যের খেলা এটি। এখানে অনেক নিয়মকানুন আছে। ক্রিকেটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষজন একটু ভদ্র স্বাভাবিকভাবেই, আভিজাত্যেও ইস্যু আছে এখানে। আমার আবার একটু সমস্যা আছে। আমি আবার অত ভদ্র না.. যদি ফুটবল মারপিট করে, তাহলে আমিও মারপিট করব, নো প্রবলেম, যে যেমন, তার সঙ্গে তেমন করতে হবে।’
এই মন্তব্য আসিফ আকবরের। দেশের জনপ্রিয় এই গায়কের নতুন পরিচয় এখন তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালক। গত রোববার রাজধানীর এক হোটেলে বিসিবি আয়োজিত এক ক্রিকেট সম্মেলনে বক্তব্য রাখার সময় আসিফ আকবর এই মন্তব্য করেন।
ফুটবল এবং ফুটবলারদের নিয়ে আসিফের এই মন্তব্য বিশ্লেষণ করার আগে আসুন তার সংজ্ঞা দেওয়া ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেটের জনাকয়েক ‘ভদ্র’র সঙ্গে খানিকটা পরিচিত হই।
রুবেল হোসেন : ধর্ষণ মামলার অভিযোগে তাকে ২০১৫ সালে জেলে যেতে হয়েছিল। নিজ বাসায় এই ধর্ষণ করেছিলেন বলে তার একসময়ের প্রেমিকা থানায় মামলা ঠুকেছিল।
শাহাদাত হোসেন রাজীব : অল্পবয়সি গৃহকর্মীকে পিটিয়ে এবং আগুনে ছ্যাঁকা দেওয়ার মামলায় জেল খাটতে হয়েছিল নিজেকে নায়ক দাবি করা এই পেসারের।
আরাফাত সানি : প্রেমে বিশ্বাসঘাতকতা এবং আর্থিক প্রতারণার অভিযোগ এনে মামলা ঠুকেন তার প্রেমিকা। ঢাকা জেলে চক্কর কাটতে হয়েছিল তাকেও।
আল-আমিন : শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে বিশ্বকাপের আসর থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। স্ত্রী নির্যাতন এবং ভরণপোষণ না দেওয়ার মামলায় আদালত, থানা-পুলিশে হাজিরা দেওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে তার।
নাসির হোসেন : অন্যের বউকে ভাগিয়ে নিয়ে সংসার করার মামলা এখনো চলছে তার বিরুদ্ধে।
সাব্বির রহমান : চট্টগ্রামে হোটেল কক্ষে এমন নাজুক অবস্থায় এই ক্রিকেটারকে পাওয়া গিয়েছিল যে, বিসিবি তাকে সেই ‘দুর্ঘটনার’ জন্য ১২ লাখ টাকা জরিমানা করেছিল। এই ‘ভদ্রলোক’ আবার কিশোর এক ক্রিকেট ভক্তকে সাইটস্ক্রিনের পেছনে নিয়ে থাপ্পড় মারার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন!
সাকিব আল হাসান : জগদ্বিখ্যাত ক্রিকেটার। কিন্তু ক্রিকেট এবং ক্রিকেটের বাইরে এমন কোনো বিষয় নেই যেখানে তিনি বিতর্ক তৈরি করেননি। মাঠের আম্পায়ারকে চরমভাবে অপমান করেছেন। ঔদ্ধত্য দেখিয়েছেন।
- তাহলে কী পেলাম আমরা?
ভদ্রলোকের খেলায় অভদ্র এবং অভদ্রতার উদাহরণও আছে প্রচুর। ধর্ষণ, শিশু গৃহকর্মী নির্যাতন, অন্যের বউ ভাগিয়ে নিয়ে যাওয়া, সাংসারিক যন্ত্রণা নির্যাতন, শেয়ার কেলেঙ্কারি, জুয়াড়িদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা, আম্পায়ারের সঙ্গে অভদ্র আচরণ। এসব কাণ্ড কিন্তু করেছেন জেন্টেলমেন্স গেমের কিছু ‘জেন্টেলমেনরাই’!
উপরে যে নামের সঙ্গে উদাহরণগুলো দেখলেন, এটাই সব নয়Ñসংখ্যাটা আরো আছে। বলবো, আসিফ বাকিগুলো?
‘ভদ্রলোকদের’(!) এসব অসভ্য আচরণের উদাহরণগুলো একটু দূরের ছবি। ক্রিকেটের সাম্প্রতিক ছবিগুলো কি দেখেছেন আসিফ আপনি? না দেখলে একটু মনে করিয়ে দিই। পুরো দেশের ক্রিকেট এখন টালমাটাল নারী ক্রিকেটারদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগে। যাদের বিরুদ্ধে এই যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে তাদের প্রায় সবাইকে আসিফ আকবর চেনেন, জানেন বা অন্তত নাম শুনেছেন। যে মঞ্চে দাঁড়িয়ে এদিন আসিফ ফুটবলের ‘কুৎসা সংগীত’ গাইলেন, সেই মঞ্চের সামনের সারিতে এমন একজন উপস্থিত ছিলেন যার বিরুদ্ধে নাতনির বয়সি ক্রিকেটারদের যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে!
প্রিয় আসিফ, আপনার উচিত হবে আগে এই যৌনশিকারি, মানসিক বিকারগ্রস্ত ক্রিকেটার এবং ক্রিকেট কর্তাদের আচরণ ঠিক করা। তারপর আপনি অন্য ফেডারেশনের আচরণ ঠিক করার দায়িত্ব নিয়েন।
জুয়াড়ির সঙ্গে সংশ্রব, ম্যাচ ফিক্সিং, স্পট ফিক্সিং, পাওয়া পরিশোধ না করা, জোচ্চুরি, বিসিবিকে ধান্দাবাজির ব্যবসাকেন্দ্রে পরিণত করাÑএমন অনেক কালো দাগ লেগে আছে আমাদের ক্রিকেটের গায়েও। যে দাগটা আরো গাঢ়, আরো কালো হয়েছে নারী ক্রিকেটারদের ওপর সর্বশেষ যৌন হয়রানির অভিযোগে।
সাদা পোশাকেও ক্রিকেট খেলা হয়। জানেন তো, সাদায় দাগ লাগলে সেটা অনেক বেশি দৃশ্যমান হয়। নিজের দাগ না মুছে অন্যের দাগ খোঁজাকে নিবুর্দ্ধিতা বলে!
ফুটবল- ক্রিকেট যখন সাম্প্রতিক সম্প্রীতিতে যখন একজোট হয়ে অনেক সমস্যার সমাধান খুঁজছে তখন ফুটবলকে নিয়ে আপনার এমন হেয় করা মন্তব্য সেই সুসম্পর্ক, সৌহার্দের বন্ধনের সুতোকে নরম করে দিল।
দুঃখিত আসিফ, আপনার গান এবং আপনাকে ভালোবাসি। কিন্তু ফুটবল এবং ফুটবলারদের নিয়ে করা আপনার এই মন্তব্য সম্পর্ক গড়া নয় বরং বিভাজন তৈরি করবে। আপনার কাজ তো সংস্কার করা এবং সম্প্রীতির সম্পর্ক গড়া। ফুটবলের যদি কোনো সমস্যা থাকে তাহলে সেটা ফুটবল ফেডারেশনকেই করতে দেন। আপনি আপনার কাজ করুন। তাতেই ক্রিকেট জিতবে এবং ফুটবলও হাসবে। ঠিক যেমন এই দেশটা আমাদের সবার, ফুটবল-ক্রিকেটও তাই। দুটোই আমাদের।