জুলাই বিপ্লব বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক প্রভাবশালী ও গভীর রূপান্তরকারী ঘটনা। দীর্ঘদিনের ফ্যাসিবাদী শাসনের কারণে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকট, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দলীয়করণ, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের যে চাপা ক্ষত সমাজে জমেছিল, সেই ক্ষতের ওপরেই আন্দোলন আঘাত করেছিল। এই আঘাত শুধু শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছিল না, বরং তা ছিল রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোকে প্রশ্ন করার এক সাহসী পদক্ষেপ। তাই বিপ্লব-পরবর্তী সময়টিকে অধিকাংশ বিশ্লেষক দেখছেন এক বিরল সুযোগ হিসেবে, যেখানে কাঙ্ক্ষিত সংস্কারের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে পুনর্গঠনের বাস্তব সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। দেশে টেকসই গণতান্ত্রিক সরকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সেই সম্ভাবনা কতটা বাস্তবে রূপ নেবে—সেটিই এখন মূল প্রশ্ন।
ইতিহাস বলে, যেকোনো গণআন্দোলন তার প্রকৃত সাফল্য অর্জন করে পরবর্তী সময়ের নীতিনির্ধারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক স্থাপনা দিয়ে। ২০২৪-এর জুলাই বিপ্লবও সেই নিয়মের বাইরে নয়। নির্বিচার হামলা ও বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়ে যে ছাত্র-যুবশক্তি ও সাধারণ মানুষ আন্দোলন সফল করেছিলেন, তারা মূলত প্রতিশ্রুতিহীন, অসম আচরণকারী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক নৈতিকতার দাবি তুলেছিলেন। এই দাবি এখন রূপ পেয়েছে কাঠামোগত রাজনৈতিক সংস্কারের আহ্বানে। সুতরাং প্রশ্ন হলো—নতুন উদ্যোগগুলো কি শুধুই সাময়িক উত্তেজনা প্রশমন করবে, নাকি রাষ্ট্রকে টেকসই পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে?
প্রথমত, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কারই টেকসই সরকারের ভিত্তি স্থাপন করে। গত কয়েক দশকে দলীয়করণের কারণে প্রশাসন তার পেশাদারিত্ব হারিয়েছে এবং রাষ্ট্রযন্ত্র একদলীয় স্বার্থের পক্ষে কাজ করেছে। এই প্রবণতা ভাঙা অত্যন্ত জরুরি। নিয়োগ ও পদোন্নতিতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, প্রশাসনকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আংশিক স্বাধীনতা দেওয়া এবং কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালনে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার বিধি কার্যকর করা জরুরি। একইভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জবাবদিহির আওতায় আনা এবং তাদের কাজের ওপর একটি নৈতিক কাঠামো আরোপ করা ছাড়া নাগরিকের নিরাপত্তা ও আস্থা পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়।
দ্বিতীয়ত, বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা পুনর্গঠনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। বিচারব্যবস্থার ওপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ দেশে ভয়, বৈষম্য ও অবিচারের পরিবেশ তৈরি করেছিল। এখন প্রয়োজন বিচারক নিয়োগে স্বচ্ছতা, আদালতের স্বাধীন বাজেট এবং বিচারপ্রক্রিয়ায় প্রযুক্তিগত উন্নয়ন। দীর্ঘসূত্রতা কমানো, জামিন ও বিচারপ্রক্রিয়া মানবিক করা এবং আইনজীবীদের পেশাদার নীতিমালা শক্তিশালী করা রাষ্ট্রকে দীর্ঘ মেয়াদে স্থিতিশীল করতে পারে। কারণ বিচারব্যবস্থা স্বাধীন না হলে, যেকোনো সরকারই স্বৈরাচারী প্রবণতার দিকে ঝুঁকে যেতে পারে।
তৃতীয়ত, নির্বাচনি ব্যবস্থার সংস্কারকে বলা যায় রাষ্ট্রের বৈধতার কেন্দ্রবিন্দু। বহু বছর ধরে নির্বাচন নিয়ে অভিযোগ, অনিয়ম, প্রশাসনের পক্ষপাত এবং রাজনৈতিক অর্থায়নের অস্বচ্ছতা জনগণের আস্থা নষ্ট করেছে। তাই নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, দলীয় প্রভাবমুক্ত নির্বাচনকালীন প্রশাসন গঠন, ইভিএম বা পেপার ব্যালট—যেটাই ব্যবহার করা হোক, তার নিরাপত্তা ও বিশ্বাসযোগ্যতা অপরিহার্য করা এবং রাজনৈতিক অর্থায়নে স্বচ্ছতা আনা এখন সময়ের দাবি। দলগুলোর অর্থায়নের উৎস প্রকাশ না করলে বা আর্থিক সীমারেখা মান্য না করলে, টেকসই নির্বাচন কখনোই সম্ভব নয়।
চতুর্থত, মানবাধিকার রক্ষা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা যেকোনো টেকসই সরকারের অপরিহার্য উপাদান। রাষ্ট্রের বিরোধিতা করলেই রাষ্ট্রদ্রোহ, এই প্রবণতা বহু বছর ধরে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল। ফলে সাংবাদিকতা, গবেষণা ও সমালোচনামূলক রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সংকুচিত হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতি বদলাতে হলে দমনমূলক আইনের সংস্কার বা বাতিল, পুলিশি হয়রানি রোধে কঠোর নির্দেশনা এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করা দরকার। মানুষ তখনই সরকারকে দীর্ঘসময় সমর্থন করে, যখন তারা ভয় ছাড়াই কথা বলতে পারে।
পঞ্চমত, রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি এবং সরকারি ব্যয়ব্যবস্থার সংস্কার দেশের সামাজিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। দুর্নীতি দেশের উন্নয়নকে স্তব্ধ করে দিয়েছে এবং সাধারণ মানুষের জীবনের মান নিম্নগামী করেছে। রাজস্ব বোর্ডকে যুগোপযোগী করা, করজাল বিস্তৃত করা, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতা পুনর্মূল্যায়ন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো-টলারেন্স নীতি বাস্তবায়ন—এসব ছাড়া অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার সম্ভব নয়। একটি টেকসই সরকার অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা ও ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত না করলে তার বৈধতা দ্রুত প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
ষষ্ঠত, স্থানীয় সরকারকে সত্যিকারভাবে ক্ষমতায়ন না করলে টেকসই শাসনব্যবস্থা বাস্তবায়নের সুযোগ কমে যায়। কেন্দ্রীয় ক্ষমতার ওপর অতিনির্ভরতা এবং ইউনিয়ন, পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের সীমিত বাজেট তাদের উন্নয়ন ও জবাবদিহির ক্ষমতাকে দুর্বল করে। জনগণের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোকেই শক্তিশালী করে প্রকৃত গণতন্ত্রের ভিত্তি তৈরি করা সম্ভব।
তবে সংস্কারগুলো বাস্তবায়নের পথে যে জটিলতা রয়েছে, তা উপেক্ষা করলে ভুল হবে। প্রথম ও সবচেয়ে বড় বাধা হলো রাজনৈতিক প্রতিরোধ। দীর্ঘদিন ধরে সুবিধাভোগী গোষ্ঠী, প্রশাসনের মধ্যকার দলীয়করণকৃত অংশ এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের অপ্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার কেন্দ্রগুলো সংস্কারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে। তাই সংস্কারের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক ঐকমত্য—স্বল্পমেয়াদি স্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া।
দ্বিতীয়ত, সমাজের মধ্যেও একটি সংস্কার-প্রতিরোধী মনস্তত্ত্ব রয়েছে। বহু বছর ধরে সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রকে ‘ভয়’ করে এসেছে। এই সংস্কৃতি দ্রুত বদলে ফেলতে হলে নাগরিক শিক্ষা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, বিতর্কের সংস্কৃতি এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
তৃতীয়ত, সংস্কারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে একটি উদার, দায়িত্বশীল ও অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক পরিবেশ প্রয়োজন। যদি সংস্কার শুধু আন্দোলনোত্তর উচ্ছ্বাসে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন আবার ফিরে আসবে। টেকসই শাসনব্যবস্থা তৈরি করতে হলে রাষ্ট্রকে নিয়ম, প্রতিষ্ঠান, পদ্ধতি ও ন্যায়পরায়ণতার ভিত্তিতে দাঁড়াতে হবে—ব্যক্তিনির্ভরতা বা দল নির্ভরতার ওপর নয়।
সবশেষে বলা যায়, জুলাই বিপ্লবের পর নেওয়া বা নেওয়ার দাবি ওঠা সংস্কারগুলো দেশের রাজনৈতিক নতুন যাত্রার সূচনা করতে পারার মতো শক্তিশালী সম্ভাবনা বহন করে। কিন্তু সম্ভাবনা বাস্তবতা হয় তখনই, যখন তা ধারাবাহিক প্রচেষ্টা, দায়িত্বশীল প্রয়োগ এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার মাধ্যমে অনুসৃত হয়। টেকসই সরকার শুধুই স্থিতিশীল সরকার নয়; বরং এমন একটি কাঠামো, যেখানে জনগণ নিরাপদ, সম্মানিত ও ক্ষমতাবান বোধ করে। যেখানে রাষ্ট্রের লক্ষ্য হলো নাগরিকের সেবা আর নাগরিকের দায়িত্ব রাষ্ট্রকে জবাবদিহির আওতায় রাখা।
ইতিহাস এ জাতিকে বহু সুযোগ দিয়েছে—কিছু কাজে লেগেছে, কিছু হারিয়ে গেছে। জুলাই বিপ্লব আরেকটি নতুন সুযোগ এনে দিয়েছে। এই সুযোগ কতটা কাজে লাগানো যায়, সেটিই নির্ধারণ করবে—বাংলাদেশ কি সত্যিই একটি টেকসই, অংশগ্রহণমূলক ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রের দিকে এগোতে পারবে, নাকি আবার অসমাপ্ত ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির দিকে হাঁটতে বাধ্য হবে।
লেখক : প্রকাশক ও কলামিস্ট