ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ২০৩৫ সাল থেকে নতুন পেট্রোল ও ডিজেলচালিত গাড়ি বিক্রির ওপর আরোপিত ঐতিহাসিক নিষেধাজ্ঞা বাতিল করতে যাচ্ছে। মঙ্গলবার ইউরোপের সংকটে পড়া অটো শিল্পকে সহায়তার লক্ষ্যে প্রস্তাবিত একটি সংস্কার প্যাকেজের অংশ হিসেবে এই সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে জানা গেছে।
গত এক বছর ধরে ইউরোপীয় গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো এবং তাদের সমর্থকেরা নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার জন্য ব্রাসেলসে জোরালো লবিং চালিয়ে আসছে। চীনের তীব্র প্রতিযোগিতা এবং প্রত্যাশার তুলনায় ধীরগতিতে বৈদ্যুতিক যান (ইভি) গ্রহণের প্রেক্ষাপটেই এই চাপ বেড়েছে।
ইউরোপীয় কমিশন ২০৩৫ সালের পূর্ণ নিষেধাজ্ঞার বদলে ৯০ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ কমানোর একটি তুলনামূলকভাবে কম উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্য প্রস্তাব করতে পারে। সমালোচকদের মতে, এতে ইইউর সবুজ নীতির ক্ষতি হতে পারে এবং বিদ্যুৎচালিত গাড়িতে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হতে পারে।
ইউরোপীয় অটো লবি সংস্থা এসিইএ-এর প্রধান সিগরিড ডে ভ্রিস সোমবার ব্রাসেলসে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “এটি খাতটির ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মোড়। এখানে অনেক কিছুই ঝুঁকির মুখে।”
২০২৩ সালে নির্ধারিত ২০৩৫ সালের নিষেধাজ্ঞা ছিল ইইউর পরিবেশবান্ধব ‘গ্রিন ডিল’-এর অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। তবে শিল্পপতি ও ডানপন্থী রাজনীতিকদের চাপের মুখে এই নীতির ওপর চাপ বাড়ছে, কারণ ইইউ তার শিল্পখাতকে আরও শক্তিশালী করতে চাইছে।
ইউরোপীয় কমিশনের মুখপাত্র পাউলা পিনহো শুক্রবার বলেন, “কার্বন নিঃসরণ লক্ষ্যমাত্রায় আরও নমনীয়তার স্পষ্ট চাহিদা রয়েছে।” তিনি জানান, ব্রাসেলস “ভারসাম্য রক্ষার” চেষ্টা করছে।
গাড়ি নির্মাতাদের দাবি, ২০৩৫ সালের মধ্যে ইউরোপে শুধু বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রির লক্ষ্য এবং ২০৩০ সালের মধ্যবর্তী লক্ষ্যমাত্রা আর বাস্তবসম্মত নয়। তাদের মতে, উচ্চ প্রাথমিক মূল্য এবং ২৭টি সদস্য রাষ্ট্রের অনেক অংশে পর্যাপ্ত চার্জিং অবকাঠামোর অভাবে ভোক্তারা এখনও ইভির প্রতি আগ্রহী হচ্ছেন না।
এসিইএ-এর তথ্যমতে, ২০২৫ সালের প্রথম নয় মাসে ইউরোপে বিক্রি হওয়া নতুন গাড়ির মাত্র একটু বেশি ১৬ শতাংশ ছিল ব্যাটারিচালিত।
গাড়ি নির্মাতারা চান, রিচার্জযোগ্য ব্যাটারিযুক্ত হাইব্রিড বা ‘রেঞ্জ এক্সটেন্ডার’যুক্ত গাড়ির বিক্রি ২০৩৫ সালের পরও অনুমোদন দেওয়া হোক। জার্মানি এবং পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো এই প্রস্তাব সমর্থন করছে, যেখানে জার্মান গাড়ি কোম্পানিগুলোর বড় কারখানা রয়েছে।
অন্যদিকে, ইতালি কৃষিজ ফসল ও বর্জ্য থেকে উৎপাদিত বিকল্প জ্বালানির ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার পক্ষে। ডে ভ্রিস সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, “ইভিই প্রধান বিকল্প হবে, তবে সমাজ ও শিল্পের স্বার্থে রূপান্তর সফল করতে অন্য বিকল্পও থাকতে হবে।”
তবে ফ্রান্স, নর্ডিক দেশগুলো ও স্পেনের মতো রাষ্ট্রগুলো নির্ধারিত পথ থেকে সরে না আসার পক্ষে। তাদের মতে, এতে বৈদ্যুতিক গাড়িতে বিনিয়োগ করা কোম্পানিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
গত সপ্তাহে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের বৃহত্তম রাজনৈতিক গোষ্ঠীর প্রধান ম্যানফ্রেড ওয়েবার জানান, ২০৩৫ সালের নিষেধাজ্ঞা বাতিল করে গাড়ি নির্মাতাদের বহরের কার্বন নিঃসরণ ৯০ শতাংশ কমানোর শর্ত আরোপ করা হতে পারে। ইইউ সূত্র এএফপিকে জানিয়েছে, প্লাগ-ইন হাইব্রিড ও রেঞ্জ-এক্সটেন্ডার গাড়ি ২০৩৫ সালের পরও বিক্রির অনুমতি পেতে পারে।
এতে পরিবেশবাদীরা উদ্বিগ্ন। সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্লাগ-ইন হাইব্রিড গাড়ি প্রায় পেট্রোলচালিত গাড়ির মতোই দূষণ ছড়ায়। তবে ক্লিন ট্রান্সপোর্ট গ্রুপ ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট (টি অ্যান্ড ই)-এর পরিচালক উইলিয়াম টডস বলেন, কিছু ছাড় দিলে অটো শিল্প হয়তো বিতর্ক থেকে সরে আসবে।
ইউরোপীয় কমিশন অটো শিল্প সহায়তায় আরও পদক্ষেপ ঘোষণা করতে পারে, যার মধ্যে করপোরেট গাড়ি বহর ‘সবুজায়ন’ এবং ছোট ও সাশ্রয়ী ইভি উৎপাদনে উৎসাহ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। ফ্রান্স ‘ইউরোপীয় অগ্রাধিকার’ নীতির পক্ষে, যাতে সরকারি ভর্তুকি পাওয়া নির্মাতাদের ইউরোপের ভেতর থেকেই যন্ত্রাংশ সংগ্রহে বাধ্য করা হয়।
ইইউর তথ্যমতে, ইউরোপে মোট উষ্ণায়ন সৃষ্টিকারী নিঃসরণের প্রায় ২০ শতাংশ আসে সড়ক পরিবহন থেকে, যার ৬১ শতাংশই গাড়ির এক্সহস্ট থেকে নির্গত হয়।
এসআর