চব্বিশের বিপ্লবে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ–ভারতের সম্পর্কের টানাপোড়েন যেভাবে তীব্র হয়েছে, তার সরাসরি প্রভাব পড়েছে দুই দেশের সীমান্ত, ভ্রমণ ও চিকিৎসা খাতে। কূটনৈতিক উত্তেজনা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুই দেশের নাগরিকদের বাগবিতণ্ডা এবং অনানুষ্ঠানিকভাবে রোগী ভর্তি ও হোটেলে থাকার নিয়মে পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশি নাগরিকরা এখন আর ভারতকে নিরাপদ মনে করছেন না। ফলে ভারতের পরিবর্তে এখন থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, তুরস্ক, মালয়েশিয়া ও চীন দ্রুত বাংলাদেশিদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
ভারত, ভুটান, নেপালসহ তিন দেশ ভ্রমণে ব্যবহৃত হয় বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম লালমনিরহাটের বুড়িমারী স্থলবন্দর ইমিগ্রেশন চেকপোস্টটি। তবে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে নানা ইস্যুতে টানাপোড়েনের কারণে লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী স্থলবন্দর ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট দিয়ে আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে পাসপোর্টধারী যাত্রীর সংখ্যা।
জানা গেছে, চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশিরা এখন আর ভারতকে নিরাপদ গন্তব্য বলে মনে করছেন না। বিকল্প হিসেবে তারা এখন থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, তুরস্ক, চীন ও মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলোতে যাচ্ছেন। ভিসা প্রাপ্তি, সেবার মান ও খরচসহ বিভিন্ন ইস্যু এসব বিকল্প দেশ বেছে নেওয়ার পেছনে প্রধান কারণ বলে জানা গেছে। বিশেষ করে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, চীন (কুনমিং) এবং মালয়েশিয়া দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে চিকিৎসাসেবায়।
চিকিৎসা, পর্যটনসহ বিভিন্ন কাজে বাংলাদেশিদের কাছে ভারতের সবচেয়ে বড় বিকল্প হয়ে উঠছে থাইল্যান্ড। গত কয়েক মাসে থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ ইন্টারন্যাশনাল হাসপাতালে বাংলাদেশি রোগী ২০ শতাংশ বেড়েছে বলে জানা গেছে। একইভাবে ব্যাংককের ভেজথানি হাসপাতাল, ব্যাংকক হাসপাতাল, কাসেম রাদ হাসপাতাল, সম্মিতিজ সুখুমভিট হাসপাতাল ও এশিয়া কসমেটিক হাসপাতালে বাংলাদেশি রোগী এখন প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সাধারণত প্রতি বছর ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নেন প্রায় ২০ লাখ বিদেশি রোগী, যার ৬০ শতাংশই বাংলাদেশি। তবে গত ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যা ৮০ শতাংশ কমে গেছে। অর্থাৎ, এসব হাসপাতালে বিদেশি রোগীর সংখ্যায় বড় ধরনের ধস নেমেছে।
বুড়িমারী স্থলবন্দর ইমিগ্রেশন পুলিশের ইনচার্জ আশরাফুল ইসলাম বলেন, ৫ আগস্টের পর ভারত গমনগামী যাত্রী পারাপার একেবারেই কমে গেছে। বুড়িমারী ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট দিয়ে আগে প্রতিদিন ৪০০-৬০০ যাত্রী পারাপার হলেও এখন তা কমে গিয়ে ৬৫-৭০ তে নেমে এসেছে বলে জানান তিনি।
এদিকে বুড়িমারী স্থলবন্দরের অপর একটি সূত্র জানায়, বন্ধ্যত্ব, ক্যানসার, হৃদরোগ, লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট, কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট, অর্থোপেডিকস্, নিউরোলজি ও চোখের চিকিৎসায় রোগীরা বেশি বিদেশে যান। এক্ষেত্রে তারা কলকাতা ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের একাধিক শহর, চেন্নাই, ব্যাঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ, মুম্বাই ও দিল্লির হাসপাতালগুলো বেছে নিতেন। সেখানে চিকিৎসা করাতে গিয়ে প্রতি বছর দেশের বড় অঙ্কের অর্থ বাইরে চলে যেত। তবে গত এক বছর ধরে এর ব্যত্যয় ঘটছে। এখন আর বাংলাদেশিরা চিকিৎসার জন্য ভারতে যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন না। এ কারণে বাংলাদেশি রোগীনির্ভর ভারতের কিছু হাসপাতালের ব্যবসায় চরম মন্দা ভাব দেখা দিয়েছে।
বুড়িমারী স্থলবন্দরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট আশিকুর রহমান পরাগ বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়লে নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে গত বছরের ৫ আগস্ট ভারত সরকার ট্যুরিস্ট, বিজনেস ও স্টুডেন্ট ভিসা বন্ধ করে দেয়। সীমিত পরিসরে মেডিকেল ভিসা চালু রাখলেও নানা শর্ত জুড়ে দিয়ে ভিসাপ্রাপ্তি কঠিন করে দেয়। এ ছাড়াও দুই দেশের মধ্যকার তিক্ত সম্পর্কের কারণে ভারতগামী যাত্রীর সংখ্যা হ্রাস পায়।
ভারতে চিকিৎসা নেওয়া লালমনিরহাট শহরের আবদুল গফুর বলেন, আগে প্রতি মাসে ফলোআপের জন্য ভারতে যেতাম কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর ভারতকে আর নিরাপদ মনে করি না। এখন থেকে থাইল্যান্ডে গিয়ে চেকআপ করাব।
ভারতে চিকিৎসা নেওয়া অপর এক রোগীর স্বজন রোহান শেখ বলেন, ভারতে যে ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া থাকবে তার কাছেই চিকিৎসা করাতে হবে। অন্যথা হলে বাংলাদেশি যাত্রীকে আটকে রাখছে ভারতীয় ইমিগ্রেশন।
তিনি আরো বলেন, ভারতের ভিসা জটিলতার কারণে বুড়িমারী ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট দিয়ে ভারত, ভুটান ও নেপালের পাসপোর্টধারী যাত্রী পারাপার একেবারেই কমে এসেছে। এতে ভারতীয় হাসপাতালগুলো বড় ধরনের ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি।
সূত্রমতে, বাংলাদেশিদের বিপাকে ফেলার ছক কষতে গিয়ে নিজেরাই বিপাকে পড়েছে ভারত। এছাড়া বাংলাদেশি পর্যটক প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসায় বিপাকে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গের হোটেল, রেস্তোরাঁগুলোও। এ পরিস্থিতিতে দেশের মাটিতেই তৈরি হোক আন্তর্জাতিক মানের আধুনিক হাসপাতাল। তাতে স্বল্প খরছে দেশেই উন্নত চিকিৎসা পাবেন বাংলাদেশের মানুষÑএমনটি মনে করছে সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ মহল।
এদিকে ভিসা জটিলতার কারণে বুড়িমারী ইমিগ্রেশনে রাজস্ব আয় কমলেও স্বাভাবিক রয়েছে বন্দরের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম ও রাজস্ব আয়। বন্দরসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে। প্রতিদিন প্রায় ২৬০-৩৫০ গাড়িতে চলে আমদানি-রপ্তানির কার্যক্রম।

