আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন সরকারের আমলে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স’ নীতির অংশ হিসেবে বদলি, তদন্ত ও পুনর্গঠনের আশায় ছিলেন রেলের সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তবে বাস্তবতা হলো, যাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ, তারাই এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল দপ্তরে।
অভিযোগ রয়েছে, এসব কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরে একক আধিপত্য বজায় রেখে রেলের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প ও সিদ্ধান্তে প্রভাব খাটিয়ে আসছেন। রেলের ভেতরে গড়ে তুলেছেন স্বজনপ্রীতির বলয় ও কমিশন নির্ভর সিন্ডিকেট।
রেলওয়ের একাধিক সূত্র বলছে, আলোচনায় সবচেয়ে বেশি যে তিন কর্মকর্তার নাম উঠে আসছে তারা হলেন-মেকানিক্যাল বিভাগের জেডিজি (উন্নয়ন-রোলিং স্টক) মো. সাদরুল হক, পদ্মা রেল লিংক প্রকল্পের প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী তাবাসসুম বিনতে ইসলাম এবং অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) এ এম মো. সালাহ উদ্দিন।
নাম প্রকাশে এক কর্মকর্তা বলেন, একই জায়গায় দীর্ঘদিন থেকে গেলে যে স্বার্থের সংঘাত ও দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়, তা সাদরুল হকের ক্ষেত্রে প্রকটভাবে দেখা যাচ্ছে। অথচ বদলির আদেশ বাস্তবায়ন হয় না।
পদ্মা রেল লিংক প্রকল্পের প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী তাবাসসুম বিনতে ইসলামের বিরুদ্ধে রয়েছে পদোন্নতিতে অনিয়ম, অর্থ পাচার ও নিম্নমানের কোচ গ্রহণে জোরপূর্বকতা চালানোর অভিযোগ। রেল মন্ত্রণালয় ও একটি চীনা নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশে ১০০টি ব্রডগেজ কোচ কেনা হয়, যা ছিল মানহীন। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ কোচ গ্রহণে আপত্তি জানালেও তাবাসসুম তাদের বদলি ও হয়রানি করেন। পরবর্তীতে জোর করে কোচগুলো রেলের বহরে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। একাধিক কর্মকর্তা অভিযোগ করেন, এসব লেনদেনে চীনা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঘুষ বাবদ শত কোটি টাকা তাবাসসুমের বেনামি অ্যাকাউন্টে গিয়েছে। পাশাপাশি, তিনি গত ১৫ বছরে সরকারি খরচে অন্তত ৩৫ বার বিদেশ সফর করেছেন, যার অনেকগুলো ছিল আলোচনার বাইরে।
অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) এ এম মো. সালাহ উদ্দিনের পরিচয় আরো আলোচিত। তিনি সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের ভাগিনা এবং ছাত্র রাজনীতিতে আওয়ামী লীগপন্থী এক নেতার ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এ রাজনৈতিক সম্পর্কই তাকে বারবার বদলির পরও আগের পদে বহাল থাকতে সাহায্য করেছে।
সূত্র জানায়, বদলির আদেশ পাওয়ার পরও তিনি নানা অজুহাত দেখিয়ে দাপ্তরিকভাবে যোগদান করেননি নতুন কর্মস্থলে। পরিবর্তে পুরনো দপ্তরেই প্রভাব বিস্তার করে যাচ্ছেন।
রেলের সাধারণ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে এই অনিয়ম ও পক্ষপাতিত্ব নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে। ‘বৈষম্যবিরোধী রেলওয়ে ফোরাম’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম থেকে তারা ১৩ দফা দাবি উত্থাপন করেছেন। তাদের অন্যতম প্রধান দাবি হলো-শুধু বদলি নয়, যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে স্বচ্ছ তদন্ত ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।
এই বিষয়ে অভিযুক্ত তিনজনকে কল দেওয়া হয়। ক্ষুদে বার্তাও পাঠানো হয়। কিন্তু তারা কোনো উত্তর দেননি।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সম্প্রতি চট্টগ্রামে পরিদর্শন করেন। এই বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে, তিনি জানিয়েছিলেন, কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে, দুর্নীতি থাকলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে রেলের এক সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এভাবে শুধু বদলির নাটক করে প্রকৃত পরিবর্তন আনা যাবে না। যাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ, তারাই যদি বহাল থাকে, তাহলে নতুন সরকারের ‘পরিবর্তনের বার্তা’ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে।
রেল খাতে গত এক যুগে ধাপে ধাপে গড়ে উঠেছে একধরনের ‘অভ্যন্তরীণ সাম্রাজ্য’। বদলির নামে চলছে প্রহসন, পক্ষপাতিত্ব আর ক্ষমতার অদৃশ্য হাত। রেলপথে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনতে হলে বদলি নয়, প্রয়োজন দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ তদন্ত এবং কার্যকর শাস্তি—এমনটাই বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
এডি/জেডেএম

