শেষ হলো ৩ দিনের উৎসব

‘পানিখেলা’য় মেতেছিল রাখাইন তরুণ-তরুণীরা

আনছার হোসেন, কক্সবাজার
প্রকাশ : ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৯: ৫৭

কক্সবাজারে রাখাইন সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী ‘পানিখেলা’ উৎসব শেষ হয়েছে, যে উৎসবকে তারা ‘সাংগ্রেং’ বা ‘জলকেলি’ উৎসব নামেই পরিচয় দেয়।

রাখাইন বর্ষবরণের এই ৭ দিনের হলেও শেষ তিনদিনে থাকে আনন্দময় ও উৎসবমুখর ‘পানিখেলা’। স্থানীয় অধিবাসীরা এই উৎসবকে বছরের পর বছর ধরে পানিখেলা নামেই চিনে এসেছে।

বিজ্ঞাপন

নানা প্রজাতির ফুল আর রংবেরঙের কাগজে সাজানো প্যান্ডেলে পানিভর্তি ড্রাম নিয়ে নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোষাক পরে অপেক্ষায় থাকেন রাখাইন তরুণীরা। নানা সাজে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে নেচে-গেয়ে দলবেঁধে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ছুটে আসেন রাখাইন তরুণরা। প্যান্ডেলে পৌঁছে রাখাইন তরুণরা তাদের পছন্দের তরুণীকে পানি ছুঁড়ে মারে। প্রতিউত্তরে তরুণীরাও তরুণদের লক্ষ্য করে পানি ছুড়ে মারে। এভাবে পানি ছিটানোর এই খেলা চলতেই থাকে।

পানি খেলা 1

রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষের বিশ্বাস এই ‘পানি’ মঙ্গলের। এই ‘মঙ্গল পানি’ পুরোনো বছরের সব ব্যথা, দুঃখ-যন্ত্রণা, বেদনা, গ্লানি, অপ্রাপ্তি আর অসঙ্গতি ধুয়ে মুছে দেবে। তাই মঙ্গল পানিতে মাতোয়ারা হয়ে থাকেন রাখাইন তরুণ-তরুণীসহ সব বয়সের মানুষ। এই পানি খেলাতেই অনেক রাখাইন তরুণ-তরুণী নিজেদের পছন্দের মানুষকেও খুঁজে নেন। এই পানি খেলা থেকে সম্পর্কের শুরু হয়ে পরিণয়ে শেষ হয়েছে এমন অনেক গল্প আছে কক্সবাজারের রাখাইন পল্লীগুলোতে।

রাখাইন পঞ্জিকা অনুসারে ১৩৮৬ রাখাইন বর্ষ শেষ হয়েছে বুধবার (১৬ এপ্রিল)। বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) থেকে শুরু হয়েছে ১৩৮৭ রাখাইন বর্ষ। আর এই বর্ষ বিদায় ও বরণে কক্সবাজারের রাখাইন সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী তিন দিনের ‘জলকেলি উৎসব’ই ছিল তাদের বর্ষবরণের আয়োজন।

পানি খেলা 2

কক্সবাজারের রাখাইন পল্লীগুলোতে স্বাভাবিক নিয়মেই রাখাইন বর্ষবিদায় ও বরণ উৎসব পালিত হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। সামাজিক নিয়মানুসারে সাত দিনের ‘সাংগ্রেং’ উৎসব শুরু হয় ১৪ এপ্রিল।

আর শেষের তিন দিনের ‘পানিখেলা’র মধ্যদিয়ে শনিবার (১৯ এপ্রিল) এই উৎসব শেষ হয়েছে।

উৎসব চলা কালে সরেজমিনে দেখা যায়, বাঁশ-বেত দিয়ে বানানো অস্থায়ী প্যান্ডেলে থরে থরে সাজানো ছিল পানিভর্তি ড্রাম। তার পাশে ফুল আর কাগজের তৈরি নকশা। প্রতিটি প্যান্ডেল যেন একেকটি শিল্পকর্ম। তরুণরা ঢাক-ঢোল বাজিয়ে ছুটে যাচ্ছিলেন এক প্যান্ডেল থেকে আরেক প্যান্ডেলে। তরুণীরা পানির ছোঁয়ায় তরুণদের জবাব দিচ্ছেন হাসিমুখে। এই ‘পানিখেলা’ যতটা না ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা, ততটাই সামাজিক উৎসব।

কক্সবাজারে রাখাইন সম্প্রদায়ের নারী নেত্রী মাটিং টিন রাখাইন সাংবাদিকদের জানান, ১৪ এপ্রিল চন্দনমিশ্রিত পানি দিয়ে বুদ্ধস্নানের মধ্যদিয়ে শুরু হয় ৭ দিনের এই উৎসব। এলাকাভিত্তিক রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকজন বিহার ও ঘরে থাকা বৌদ্ধ মূর্তি স্নান করিয়ে এই উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেন। উৎসবের দ্বিতীয় দিন ১৫ এপ্রিল শোভাযাত্রার মাধ্যমে বিহার প্রাঙ্গণে জড়ো হন রাখাইনরা। ওখানে ঠান্ডা শরবত পান এবং পঞ্চশীল গ্রহণ করে সবার মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করা হয়। পঞ্চশীল হলো রাখাইন সম্প্রদায়ের একটি ধর্মীয় রীতিনীতি পালন।

তার মতে, ১৬ এপ্রিল তৃতীয় দিন রাখাইন শিশু-কিশোররা একে-অপরকে পানি নিক্ষেপ করেছে। আর উৎসবের শেষ ৩ দিনের জলকেলি বা পানিখেলা শুরু হয় বৃহস্পতিবার থেকে। কক্সবাজার শহরের রাখাইন পল্লীগুলোতে ২০টি প্যান্ডেলে তিন দিনের এই পানিখেলা চলেছে। একই সঙ্গে কক্সবাজার জেলার দ্বীপ উপজেলা মহেশখালী, কক্সবাজার সদরের চৌফলদন্ডী, সীমান্ত উপজেলা টেকনাফ ও রামু উপজেলার রাখাইন পল্লীতেও একই ধরনের উৎসব হয়েছে।

কক্সবাজার রাখাইন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিচালক মংছেনলা রাখাইন জানান, তিন দিনের জলকেলি উৎসব রাখাইন অধিবাসীদের মাঝে ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয়। এই তিনদিন রাখাইন পল্লীগুলো ঘিরে উচ্ছ্বাস ও আনন্দময় পরিবেশ বিরাজ করে। রাখাইনদের সাথে অন ধর্মের মানুষের অংশগ্রহণে সবার মাঝে তৈরি হয় সম্প্রীতির এক মিলনমেলা।

কক্সবাজার শহরের ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধ মন্দির অগ্গমেধা ক্যাং পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মংহ্লা মি রাখাইন সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের এই উৎসবে শুধু পানি খেলা নয়, আছে রাখাইনদের ঐতিহ্যবাহী খাবার, সবার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ, শুভেচ্ছা বিনিময় আর মঙ্গল কামনার রীতি। তাই এই জলকেলি উৎসবের জন্য আমরা সারাবছর অপেক্ষায় থাকি।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের মিডিয়া ফোকাল পয়েন্ট ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্র্যাফিক) মো. জসিম উদ্দীন চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, রাখাইনদের জলকেলি উৎসব কক্সবাজারের জন্য অত্যন্ত জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী একটি উৎসব। এটি একটি ধর্মের মানুষের হলেও অন্য ধর্মের মানুষের আনা-গোনায় এটি সম্প্রীতির একটি বন্ধন তৈরি করে।

তিনি জানান, জেলার যেখানেই অনুষ্ঠান হয়েছে সেখানে পোশাকধারী পুলিশের টহল ও অবস্থান ছিল। সাদা পোশাকেও ছিল নজরদারি। যাতে এই উৎসব ঘিরে যেন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে।

এমএস

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত