নির্মল বায়ুর রাজশাহী শহর এখন ধুলার নগরী

মঈন উদ্দিন, রাজশাহী
প্রকাশ : ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৮: ৪৪
আপডেট : ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ১০: ৫৯

এক সময় ভোরবেলা পদ্মাপাড়ে হাঁটলেই রাজশাহীর বাতাসে পাওয়া যেত এক অন্যরকম প্রশান্তি। ২০১৬ সালে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক পরিবেশ পর্যবেক্ষণ সংস্থা আইকিউএয়ার রাজশাহীকে বিশ্বের নির্মল বাতাসের শহর হিসেবে ঘোষণা করে।

কিন্তু মাত্র নয় বছরের মাথায় সেই একই প্রতিবেদনে রাজশাহীর নাম উঠেছে সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর তালিকার শীর্ষে। অর্থাৎ, যে শহর এক সময় ছিল স্বচ্ছ আকাশের প্রতীক, সেখানে এখন শ্বাস নেওয়াই ঝুঁকিপূর্ণ।

বিজ্ঞাপন

জানা যায়, গত ২১ অক্টোবর শহরটির বায়ুমান সূচক রেকর্ড করা হয় ১৬৭, যা আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী অস্বাস্থ্যকর। একই

দিন খুলনায় ছিল ১৫৭ এবং ঢাকায় ১০২। অর্থাৎ জনবহুল ঢাকা থেকেও নির্মল এই শহর দূষিত হয়ে গেছে।

রাজশাহী নগরীর ভদ্রা, শিরোইল, সাহেববাজার, সোনাদিঘী—সবখানেই এখন ধুলোর আস্তরণ। ফ্লাইওভার ও ভবন নির্মাণের বালু, ইট, খোয়া পড়ে আছে খোলা জায়গায়। শহরের ভেতর দিয়ে চলাচল করছে পুরোনো বাস, ট্রাক, অটোরিকশা—যেগুলো থেকে বের হচ্ছে কালো ধোঁয়া। ফলে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে পিএম-২.৫ নামের অতিক্ষুদ্র কণা, যা সরাসরি ফুসফুসে প্রবেশ করে শ্বাসযন্ত্রের মারাত্মক ক্ষতি করে।

পরিবেশবিজ্ঞানীরা বলছেন, রাজশাহীতে বড় কোনো শিল্পকারখানা না থাকলেও নির্মাণকাজ ও যানবহনের ধোঁয়াই এখন প্রধান দূষণ উৎস। বালু রাখা হচ্ছে রাস্তায়, পানি ছিটানোর ব্যবস্থা নেই। এতে বাতাসে ধূলিকণা বেড়ে যাচ্ছে উদ্বেগজনক হারে।

নগরীর বহরমপুর এলাকার গৃহবধূ জান্নাত আরা বলেন, সকাল-বিকাল জানালা খুললেই ঘরে ধুলা ঢুকে পড়ে। আমার ছেলে দীর্ঘদিন থেকে কাশিতে ভুগছে। ডাক্তার বলেছেন, দূষিত বাতাসে অ্যালার্জি হচ্ছে। এখন জানালা বন্ধ রাখলেও মুক্তি মিলছে না।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. শংকর কে রায় সতর্ক করে বলেন, রাজশাহীর মতো শহরে এমন বায়ুদূষণ অকল্পনীয়। শিশু ও প্রবীণরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট এমনকি হৃদরোগও বাড়বে যদি দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হয়।

জানা যায়, সড়ক পরিবহন আইনে কালো ধোঁয়া নির্গত যানবাহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান থাকলেও তা কার্যকর নয়। রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের উপকমিশনার নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, বাস-ট্রাকের বিরুদ্ধে মাঝে মাঝে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে মোটরসাইকেলের ধোঁয়া পরীক্ষা করার নিয়ম নেই। এটি মূলত বিআরটিএর দায়িত্ব।

বিআরটিএর রাজশাহী কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আমাদের কাছে ধোঁয়া পরীক্ষার যন্ত্র নেই। চোখে দেখেই ফিটনেস সার্টিফিকেট দিতে হয়। ঢাকার বাইরেও কোথাও এসব যন্ত্র নেই।

এদিকে রাজশাহীর বাতাসের মান সবচেয়ে খারাপ হয়ে পড়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে সম্প্রতি রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক) এক জরুরি বৈঠক করে। সেখানে ফ্লাইওভার, সড়ক ও ভবন নির্মাণের কারণে সৃষ্ট ধুলোবালি নিয়ন্ত্রণে করণীয় নিয়ে আলোচনা হয়।

রাসিকের পরিবেশ উন্নয়ন কর্মকর্তা মাহমুদ-উল-হাসান বলেন, এটা সত্যিই দুঃখজনক। এখন শহরে একাধিক ফ্লাইওভারের কাজ চলছে। পানি ছিটিয়ে ধুলো কমানোর ব্যবস্থা নিতে প্রকৌশল বিভাগকে বলা হয়েছে। নির্মাণকাজ শেষ হলে পরিস্থিতি উন্নতি হবে বলে আশা করছি। তবে নগরবাসী বলছে, যদি কাজ শেষ হতে আরো এক বছর লাগে, ততদিন আমরা কীভাবে শ্বাস নেব।

রাজশাহীর তরুণ পরিবেশকর্মী তফাজ্জল হোসেন বলেন, ২০১৬ সালে রাজশাহী ছিল বিশ্বে সবচেয়ে পরিষ্কার বাতাসের শহর। কিন্তু আজ সেই শহরেই মানুষকে দূষণ সতর্কতা শুনতে হচ্ছে। নগর পরিকল্পনা, যানবাহন নিয়ন্ত্রণ আর নির্মাণ শৃঙ্খলায় পরিবর্তন না আনলে রাজশাহী আর টিকবে না।

স্থানীয়রা বলছেন, যে শহরের মানুষ বিশ্বে নির্মল বাতাসের জন্য গর্ব করত, আজ সেখানে মানুষ মুখে মাস্ক পরে হাঁটে, শিশুরা কাশে এবং আকাশ ধোঁয়ায় ঢাকা থাকে। যদি এখনই পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে রাজশাহীতে নির্মল বাতাস এক সময় ইতিহাসের অংশ হয়ে যাবে।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

মুসলিম বিশ্বে পাকিস্তানের অবদানের প্রশংসা করে যা বললেন সিসি

সংঘাতের জন্য সবাই মুখিয়ে আছে: তথ্য উপদেষ্টা

শক্তি সঞ্চয় করছে ঘুর্ণিঝড় ‘মন্থা’, গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে

ছাত্রদল নেতার বিরুদ্ধে প্রবাসীর স্ত্রীকে শ্লীলতাহানি ও লুটপাটের অভিযোগ

চেলোপাড়ায় অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ১৭৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত