করতোয়া নদীর উন্নয়নে ১৩২ কোটি টাকার প্রকল্প ২২ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি । ফলে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এই নদীর উন্নয়নের ব্যয় । বর্তমানে তা দ্বিগুণে দাঁড়িয়েছে । অন্যদিকে দখল দূষণে নদীটি এখন মরণদশায় পরিণত হয়েছে। পরিকল্পনা ছাড়াই করতোয়ার উন্নয়নে টাকা ঢালছে সরকার।
জানাগেছে, বগুড়া শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া মৃতপ্রায় করতোয়া নদীর উন্নয়নে ১৩২ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়া হয় ২০০১ সালে। এরপর কেটে গেছে প্রায় ২২ বছর। এই সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে নদীটির প্রাণ ফেরানোর প্রকল্পের ব্যয়ও। এখন এই প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে হয়েছে ২২ গুণ। সমীক্ষার অপেক্ষায় আটকা করতোয়ার ভাগ্য। ফলে গেল দুই দশকে করতোয়ার ভাগ্য ফেরার বদলে বরং মৃত্যু হয়েছে। উন্নয়নের নামে সরকারি খরচের খাতাকে ভারি করা হয়েছে। ৩ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়ার ফলে লুটপাটের সুযোগ হয়েছে ক্ষমতাবানদের ।
জানাগেছে, দখল-দূষণে মৃত করতোয়া নদীর সর্বশেষ প্রকল্পের প্রস্তাবনা ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা। নাম দেওয়া হয়েছে স্মার্ট করতোয়া রিভার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম। বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলছে, করতোয়া নদী উন্নয়নের প্রকল্পটি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সবুজ পাতায় আছে। সমীক্ষায় সব কিছু ঠিক থাকলে করতোয়া প্রকল্প ত্বরান্বিত হতে আর কোনো বিপত্তি থাকবে না।
পাউবো সূত্রে জানা যায়, ২০০১ সালে ১৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে করতোয়া নদীর উন্নয়নে প্রথম উদ্যোগ নেয়া হয়। সে সময় করতোয়া নদীর দূষণ ঠেকাতে এবং পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক রেখে শহরটির সৌন্দর্যবর্ধনের মূল লক্ষ্য ছিল। প্রথম ধাপে ২০০২ সালে ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে করতোয়া নদীর চেলোপাড়া থেকে নাটাইপাড়া অংশে তীর সংরক্ষণ করে মাটি ভরাট করে রাস্তা নির্মাণ হয়েছিল। সেখানে গাছ ও রোড লাইট স্থাপন হয়। এরপর সেখানেই কাজের সমাপ্তি।
পরবর্তীতে ২০০৬ সালে করতোয়াকে নিয়ে আবার প্রকল্পে ১৩৬ কোটি টাকার প্রস্তাবনা দেয়া হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) ও পৌরসভা যৌথভাবে করতোয়া নদী উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়।
১৩৬ কোটি টাকার ওই প্রকল্পে করতোয়া নদীর পূর্ব তীরে ১০ দশমিক ৬ কিলোমিটার এবং পশ্চিম তীরে ৯ দশমিক ১৭ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব রাখা হয়েছিল। এছাড়া পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে সাড়ে ৪৭ কিলোমিটার করতোয়া নদী পুনঃখনন, নদীর বিভিন্ন বাঁকে পানিপ্রবাহ যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, এ জন্য নদী সোজা করতে এক কিলোমিটার খনন, ্হরতলির মাদলা এলাকায় একটি রাবার ড্যাম নির্মাণ, নদীর ঢালে সাড়ে তিন কিলোমিটার সিসি ব্লক, সাড়ে তিন কিলোমিটার ঢাল উন্নয়ন, শহরের দুটি স্থানে দুটি নান্দনিক ঘাট নির্মাণ, নদীর পানি কাজে লাগাতে চারটি জলকপাট (স্লুইচগেট) নির্মাণ, করতোয়া-সংলগ্ন সুবিল খালে ছয়টি বক্স কালভার্ট এবং ৪০০টি খুঁটি নির্মাণ করার প্রস্তাব রয়েছে।
দুই বছরের সমীক্ষা শেষে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ মহাজোটের আমলে প্রকল্প প্রস্তাবনাটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। এরপর এর আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।
কয়েক বছর পর ২০১১ সালে করতোয়াকে বাঁচাতে ফের তোড়জোড় শুরু হয়। করতোয়া নদী উন্নয়ন প্রকল্প শিরোনামে নতুন করে উদ্যোগ নেয় পাউবো। তবে সেসব ছিল খণ্ডিত প্রকল্প। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে পূর্ণাঙ্গভাবে প্রকল্প প্রস্তাবনা দেন তৎকালীন বগুড়া পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ। এতে করতোয়াসহ বগুড়ার গজারিয়া, ইছামতি নদী সংস্কারে ২ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকার ব্যয় প্রস্তাব করা হয়। তবে গোবিন্দগঞ্জের খুলসি থেকে বগুড়ার শেরপুর পর্যন্ত করতোয়ার ১১৯ কিলোমিটার নদী উন্নয়নে ব্যয় ধরা হয়েছিল পৌনে ১২শ কোটি টাকা। এই প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে যায়। এবং তখন থেকেই কমিশনেই ফাইল চাপা হয়ে পড়ে আছে। এই প্রকল্পটির ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৯৪২ কোটি। তবে এই টাকার অংকটি খরচ হবে শুধু করতোয়া নদীতে।
এ প্রকল্পের আওতায় রয়েছে করতোয়া নদীর পরিবেশ দূষণ বন্ধ, শহরের যানজট নিরসনে সড়ক নির্মাণ। করতোয়া নদীর বগুড়া জেলা অংশের শিবগঞ্জ উপজেলার উত্তরের সীমানা থেকে শেরপুর উপজেলার দক্ষিণ সীমানা পর্যন্ত মোট ১২৩ কিলোমিটার এলাকা খনন।
একই সঙ্গে খনন করা হবে সুবিল খাল ৩১ কিলোমিটার, ইছামতী নদী ও গজারিয়া খালের ৭৫ কিলোমিটার। নদীর দুই পাড়ের ২৭ কিলোমিটার এলাকায় ২০ ফুট প্রশস্ত রাস্তা ও ৬ ফুট ওয়াকওয়ে নির্মাণ, মাস্টার ড্রেন নির্মাণকাজ, পানি নিয়ন্ত্রণে তিনটি অবকাঠামো নির্মাণ, নদীর দুই পাড়ে সৌন্দর্য বৃদ্ধিকরণ, পানির ট্রিটমেন্ট প্লান্ট নির্মাণকাজ। প্রকল্পের অধীনে ভূমি অধিগ্রহণ থাকবে।
পাউবোর বগুড়া জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী নাজমুল হক জানান, করতোয়া নদী উন্নয়ন প্রকল্পের সমীক্ষা যাচাই চলছে। ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেল (আইডব্লিউএম), বাংলাদেশ অধ্যয়ন কেন্দ্র (সিবিএস) ও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন যৌথভাবে এই সমীক্ষা করছে।
বগুড়া জেলা প্রশাসক মো. তৌফিকুর রহমান বলেন, করতোয়া নদী বগুড়ার প্রাণ। কিন্তু দখল-দূষণে করতোয়া নদীর প্রাণবৈচিত্র্য প্রায় নিঃশেষ। নদীর সীমানা নির্ধারণ করে এই অংশটি ওয়াকওয়ে করে দেয়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। আমরা আশাবাদী করতোয়া আবার প্রাণ ফিরে পাবে।
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

