গুম খুন মামলায় ত্রাসের রাজত্ব ছিল আওয়ামী লীগের

ফজলে ইমাম বুলবুল, ঠাকুরগাঁও
প্রকাশ : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯: ২৬

উত্তরের জনপদ ঠাকুরগাঁওয়ের মানুষ শান্ত স্বভাবের। সহজ-সরল প্রকৃতির বলে বেশ সুনামও আছে। কৃষিপ্রধান এই এলাকার ঐতিহ্যই হলো মিলেমিশে বসবাস। স্বাধীনতার পর থেকে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল হিন্দু-মুসলিমের।

রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মধ্যে চায়ের দোকানে নিয়মিত বিতর্ক হলেও সম্পর্ক ছিল মধুর, বিপদে-আপদে এগিয়ে যেতেন পরস্পর। সেই জনপদকে রাজনৈতিক কারাগারে পরিণত করেছিল ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ। ২০০৮ সালের পরিকল্পিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা নিয়েই ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন দলটির নেতাকর্মীরা।

বিজ্ঞাপন

মূলত ঠাকুরগাঁওয়ে আওয়ামী অপরাজনীতির সূচনা হয় ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর। তখন সব এলোমেলো হয়ে যায়। সমাজে তৈরি হয় রাজনৈতিক বিভক্তি, যা ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। মামলা- হামলা নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের শত শত রাত কাটাতে হয় বনবাদাড়ে। গ্রেপ্তারের ভয়ে থাকতে হতো পালিয়ে। তাদের নামে ৩৮৬টি মামলা দেওয়া হয়। আসামি করা ৩০ হাজার নেতাকর্মীকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে খুন হন ১৪ নেতাকর্মী। এছাড়া জুলাই বিপ্লবে গুলি করে হত্যা করা হয় চারজনকে।

আওয়ামী দুঃশাসন শুরু হলে বিরোধী মতের নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন, নিপীড়ন ও জুলুমের বীভৎস রূপ দেখেন ঠাকুরগাঁওবাসী। ফ্যাসিবাদী দলটির নেতাকর্মীদের মামলা-বাণিজ্য, দখল, লুটপাট, চাঁদাবাজি, হয়রানি, টেন্ডারবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে জনজীবন। তাদের হাতিয়ারে পরিণত হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

থানার নথি ঘেঁটে ও বিএনপি-জামায়াত নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঠাকুরগাঁওয়ে এই দুই দলের নেতাকর্মীদের আন্দোলন দমাতে ও তাদের কোণঠাসা করার জন্য ৩৮৬টি মামলা দেওয়া হয়। এর মধ্যে ১৯৬টি মামলায় আসামি করা হয় বিএনপির সাড়ে ২৪ হাজার নেতাকর্মীকে। আর ১৯০ মামলায় জামায়াতের ছয় হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। এখনো সব মামলা প্রত্যাহার হয়নি। অনেক নেতাকর্মীকে দৌড়াতে হচ্ছে আদালতের বারান্দায়। মামলার খরচ চালাতে গিয়ে অনেকেই নিঃস্ব হয়ে গেছেন।

জেলার পাবলিক প্রসিকিউটর আবদুল হালিম বলেন, ‘আমি পাবলিক প্রসিকিউটর হওয়ার আগে ২১টি মামলায় ১২ শতাধিক নেতাকর্মীকে খালাস করা হয়েছে। বর্তমানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ৬৬টি মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এগুলো প্রত্যাহার হলে ২৭৫১ নেতাকর্মী মুক্তি পেতে পারেন। এছাড়া রুহিয়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি পার্থ সারথী সেন বাদী হয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে ২৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন, সেটি নিয়েও আলোচনা চলছে।’

সদর উপজেলার রুহিয়া ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব আলীর জামিন হচ্ছে না। দীর্ঘদিন ধরে আদালতের বারান্দায় ঘুরছেন তিনি। তার জামিন না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তার মেয়ে সুমাইয়া। তিনি বলেন, বাবার মুখ দেখা হয় না অনেক দিন। তাই বাবাকে এক নজর দেখতে আদালতের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকি।

তার মতো অনেকেই আওয়ামী লীগের নিপীড়নের শিকার হয়ে জেল খাটছেন, আইনজীবীদের পেছনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। জমির মতো অমূল্য সম্পদ বিক্রি করে মামলার খরচ চালাচ্ছেন। হাজিরা দিতে দিতে পায়ের জুতা ক্ষয় করে ফেলছেন। পারিবারিক ও সামাজিকভাবে হচ্ছেন অপদস্ত। এভাবে সাড়ে ১৫ বছরের দুঃশাসনে রাজনীতি করাই অপরাধে পরিণত হয়েছিল।

সাংবাদিক নিপীড়ন

আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর অপকর্ম প্রকাশ ও বিএনপি-জামায়াতের কর্মসূচির সংবাদ প্রচার করায় সাংবাদিকদের ওপর নিপীড়ন ও মামলা-হামলা চালিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। সংবাদ কর্মীদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে ফ্যাসিবাদী দলটি। ভুক্তভোগীদের মধ্যে ইত্তেফাকের সাংবাদিক তানভীর হাসান তানু, রহিম শুভ, বিশাল রহমান, আল মামুন, আসাদ জামান ও মাহাবুব আলম সোহাগ উল্লেখযোগ্য।

আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর খুন-সন্ত্রাসের দায় চাপানো হতো বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীর ঘাড়ে। মামলা দিয়ে করা হতো হয়রানি। এরই অংশ হিসেবে ২০১৭ সালের ১১ জুলাই যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাকর্মীদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে জেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সজীব দত্তের হাতে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের অর্থ সম্পাদক আবদুল মান্নান মুন্না খুন হন। নিহতের পরিবারের দাবি, ঠাকুরগাঁও অটোস্ট্যান্ডের টেন্ডার ও টোল আদায়কে কেন্দ্র করে যুবলীগ নেতা সজিব দত্ত, শান্তসহ চার থেকে সাতজনের একটি দল ওই হামলা চালিয়েছিল।

জেলা বিএনপির দপ্তর সম্পাদক মামুনুর রশিদ আমার দেশ-কে বলেন, ২০০৮ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত জেলার ৫ উপজেলায় পুলিশি নির্যাতনে অসংখ্য নেতাকর্মী আহত হয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। আওয়ামী ফ্যাসিস্ট পুলিশের নিপীড়নের বর্ণনা বলে শেষ করা যাবে না। তাদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে একবার মহিলা দলের নেতাকর্মীরা একতলা ভবনের ছাদে আশ্রয় নেন। সেখান থেকে তাদের ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়। তখন কোনো রকমে বেঁচে যান মহিলা দলের সানজিদা ইয়াসমিন, মাহাফুজা, ইতি, ফাতেমা ও পান্না।

জামায়াত নেতাকর্মীদের নিয়ে জঙ্গি নাটক

হরিপুর, রাণীশংকৈলসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে জামায়াত ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের শত শত নেতাকর্মীকে তুলে নিয়ে জঙ্গি নাটক সাজাত পুলিশ ও র‌্যাব। পরে তাদের নামে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দিত, যেন সহজে জামিন না পান। এই জুলুম-নির্যাতনের কারণে হাজার হাজার জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীকে শত শত রাত বাড়ির বাইরে কাটাতে হয়েছে, পালিয়ে জীবনযাপন করতে হয়েছে। আবার তাদের না পেয়ে পরিবারের যাকেই পেয়েছে তাকে গ্রেপ্তার করেছে, নির্যাতন ও হয়রানি করেছে।

সদর উপজেলা জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন বলেন, কারাগার জামায়াত-শিবির ও বিএনপি নেতাকর্মীদের জন্য দ্বিতীয় আবাসনে পরিণত হয়েছিল। আমাদের যেন বাইরে থাকাই অপরাধ ছিল। দেড় দশক ধরে আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে নেতাকর্মীদের। জেলা জামায়াতের সাবেক আমির মাওলানা আবদুল হাকিমে জেল খেটেছেন ৭ বার, তার বিরুদ্ধে ১৮টি মামলা চলমান। জেলা জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা ১০টি, জেল খেটেছেন ৬ বার। জেলা জামায়াতের সহ-সাধারণ সম্পাদক কফিল উদ্দিনের বিরুদ্ধে মামলা ৫টি, জেল খেটেছেন বেশ কয়েকবার। শত শত নেতাকর্মী হয়েছেন দেশান্তরী। এছাড়া ২০১৩ সালের ৩১ মার্চ রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয় জেলা জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেনের ছোট ভাই দেলোয়ার হোসেনকে। বর্তমানে তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি এবং ঠাকুরগাঁও-১ আসনের জামায়াত মনোনীত সংসদ সদস্য প্রার্থী। শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি থাকাবস্থায় তার ওপর চলে নির্মম নির্যাতন। অবর্ণনীয় জুলুমের কথা বলে শেষ করা যাবে না।

শিশুসহ ১৪ জনকে হত্যা

২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আল্লামা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়ার পর বিক্ষুব্ধ হন পুরো দেশের মানুষ। তখন সদর উপজেলার গড়েয়া ইউনিয়নের এলাকাবাসী রায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করলে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি গুলি চালান বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা। এতে নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের মধ্যে হিন্দুসহ ৬ জন ঘটনাস্থলে এবং পরে একজন মারা যান। তারা হলেনÑ ফিরোজ হাসান, নিরঞ্জন, রুবেল, দুলাল হোসেন, দায়মুল, মুনির ও নিতাই রায়।

এছাড়া ফারহাত আহম্মেদ পুলিশ সুপার থাকাবস্থায় বন্দুকযুদ্ধের নামে তিনজনকে হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে ২০১৮ সালের ২৬ মে মোবারক হোসেন, ২৭ মে রফিকুল ইলামকে রাণীশংকৈল এলাকায় এবং ২৯ মে হরিপুরে হারুনকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। তখন পুলিশের ভয়ে ঘরছাড়া হয় হাজার হাজার মানুষ। এছাড়া ২০২৩ সালে হরিপুরে যুবদল নেতা আকরাম আলীকে পুলিশ পিটিয়ে হত্যা করেছে বলে বিএনপি দাবি করেছে। একই এলাকায় গরু চোরাচালানকে কেন্দ্র করে জনতার সঙ্গে সংঘর্ষে তিনজনকে গুলি করে মারে বিজিবি।

এদিকে ২০২১ সালে ইউপি নির্বাচন চলাকালীন রাজাগাঁও আসান নগর মাদরাসা ভোট কেন্দ্রে হামিদুল ইসলাম নিহত হন। পীরগঞ্জ উপজেলার খনগাঁও ঘিডোব বিদ্যালয় কেন্দ্রে সাহাবলি হোসেন, মজাহারুল ও আদিত্য পুলিশের গুলিতে নিহত হন। তারা সবাই বিএনপির কর্মী বলে দলটির দাবি। তাদের হত্যা করে বিনা বাধায় ভোট চুরি করে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। আর রাণীশংকৈল ভাংবাড়ী নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহিংসতার কারণে পুলিশ গুলি চালালে ভোট দেখতে আসা মায়ের কোলে থাকা ছোট শিশুর মাথার খুলি উড়ে যায়। ঘটনাস্থলেই শিশুটি নিহত হয়। এসব ঘটনায় যে মামলা হয় তাতেও বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়।

জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি ওবায়দ্দুল্লাহ মাসুদ জানান, ‘২০১৩ সালে বিক্ষোভ কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেওয়ার সময় পুলিশের গুলিতে আহত হই, আমার ঘাড়ের হাড়ে গুলি লাগে। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যাই। ওসি ফিরোজের নেতৃত্বে সেদিন পুলিশ শর্ট গানের গুলি চালায়। আমি গুলিতে আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি।’

পুলিশের দলবাজ কর্মকর্তা

বন্দুকযুদ্ধের নামে নেতাকর্মীদের হত্যা, মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার, মামলা-বাণিজ্য ও হয়রানি চরম আকার ধারণ করেছিল পুলিশের দলবাজ কর্মকর্তাদের কারণে। ঠাকুরগাঁও জেলা বিএনপির সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয় গত ১৭ বছরে পুলিশ সুপার ফারহাত আহম্মেদ, মনিরুজ্জামান ও রহিম শাহ, ওসি আশিকুর রহমান আশিক, কার্তিক রায়, তানভীর আহমেদ, জিয়া, মোর্তুজা, পিযুষ, প্রদীপ ও ফিরোজ এবং এসআই জাহিদসহ অনেক কর্মকর্তা রাজনৈতিক কর্মীর মতো আচরণ করেছেন। বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীর ওপর জুলুম-নির্যাতন চালিয়েছেন।

জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক পয়গাম আলী বলেন, কিছু পুলিশ কর্মকর্তা জনগণের টাকায় বেতন নিলেও জুলুমের অন্যতম হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল। তারা আওয়ামী লীগের পেটোয়া বাহিনী হিসেবে কাজ করেছে। এমন নির্যাতন চালিয়েছে যে, শুধু ঠাকুরগাঁও নয়, পুরো দেশটাকে কারাগারে পরিণত করেছিল। মামলার খরচ চালাতে গিয়ে অনেক নেতাকর্মী নিঃস্ব হয়ে গেছেন।

তিনি আরো বলেন, ঠাকুরগাঁওয়ের হিন্দুদের বাড়ি-ঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। রাজনৈতিক স্বার্থে এসব ঘটিয়ে মামলা দিত বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের নামে। এভাবে বহু হিন্দুকে বাস্তুচ্যুত করেছে আওয়ামী লীগ সরকার।

গুমের শিকার ৩

ঠাকুরগাঁও জেলা বিএনপি ও অধিকারের তথ্য অনুযায়ী, দেড় দশকে জেলার তিন জনকে গুম করেছিল ফ্যাসিস্ট সরকার। তাদের একজন ঠাকুরগাঁও পৌর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শাহরিয়ার জুয়েল। অপর দুজন হলেনÑ সদর উপজেলার দানারহাট এলাকার দেলোয়ার হোসেন ও ছালেউর রহমান। তাদের দুজনকে ঢাকার তেজকুনিপাড়া থেকে সাদা পোশাকের পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেওয়ার আট মাস পরে রাস্তায় ফেলে দেয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে গুম করে তাদের অজ্ঞাত স্থানে আটকে রাখা হয়েছিল বলে জানান অধিকারের ঠাকুরগাঁও জেলা সমন্বয়ক আফতাব হোসেন রুপম।

গুমের শিকার শাহারিয়ার বলেন, ‘বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যখন প্রথম গ্রেপ্তার হন তার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে মিছিল করার পর সাদা পোশাকে কিছু লোক তাকে তুলে নিয়ে যায়। সাতদিন পর র‌্যাব তাকে নীলফামারী থানায় হস্তান্তর করলে একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। তিন মাস পর জামিনে মুক্তি পেলে আবার গুম করার চেষ্টা করেছিল। এক পর্যায়ে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যাও করতে চেয়েছিল, কিন্তু আল্লাহর রহমতে বেঁচে গেছি।’

রমেশের রামরাজত্ব

২০০৮ সালে ঠাকুরগাঁও-১ (সদর) আসনে এমপি হন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রমেশ চন্দ্র সেন। এরপর উল্টে যায় স্থানীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি। দলীয় কমিটি গঠন, স্কুল, কলেজ, মাদরাসাসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে অগ্রাধিকার দিয়ে সর্বত্র হিন্দু আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। জেলার ডিসি, এসপি, থানার ওসিসহ সরকারের সব পর্যায়ে হিন্দুদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে ঠাকুরগাঁওয়ে এনে হিন্দুদের জেলায় পরিণত করেন আওয়ামী ফ্যাসিস্ট।

টানা চারবার সংসদ সদস্য পদে থাকায় দীর্ঘ সময় ঠাকুরগাঁও-১ আসনে এমপি, সরকারের মন্ত্রিত্ব এবং আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকায় জেলায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন রমেশ। পরিবহনসহ জেলার সব খাতে চাঁদাবাজিকে নিয়মিত কাজে পরিণত করেন রমেশ ও তার ভাতিজা রুহিয়া থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি পার্থ সারথী সেন। টেন্ডার বাণিজ্য করে লুটেছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। রমেশ পানিসম্পদমন্ত্রী থাকাবস্থায় মন্ত্রণালয়ের সব ঠিকাদারির কাজ দেওয়া হতো তার ভাতিজার কোম্পানি সেন অ্যান্ড সেনকে। সর্বশেষ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৮ কোটি টাকায় সীমান্ত রক্ষার বাঁধের কাজ না করেই পালিয়ে গেছেন পার্থ।

আরেক ত্রাস ছিলেন রমেশের ভাই অনিল চন্দ্র সেন। তিনি থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির পদে থাকলেও নিয়ন্ত্রণ করতেন পুরো থানা। সবই চলত তার ইশারায়। তার বিরুদ্ধে গেলেই করা হতো মামলা, হামলা ও হয়রানি। এছাড়া রমেশ সেনের খাস লোক ছিলেন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোশারুল ইসলাম সরকার ও জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক নজরুল ইসলাম স্বপন, জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক দীপক কুমার রায়। তারা সবাই যোগসাজশে লুটেছেন পুরো জেলা।

এদিকে ঠাকুরগাঁওয়ের ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল নিয়ন্ত্রণ করতে রমেশের কথিত দ্বিতীয় স্ত্রী মুক্তা রানী (বর্তমানে পলাতক)। তার দাপট ও লুটপাটে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলেন হাসপাতালের চিকিৎসকসহ সব কর্মকর্তা ও কর্মচারী। রোগীদের খাদ্য-ওষুধ সরবরাহসহ অধিকাংশ সেবা দিতেন মুক্তার ভাতিজা নিপুণ।

জুলাই বিপ্লবে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে রমেশ রাজত্বেরও অবসান ঘটে। এরপর ১৬ আগস্ট ঠাকুরগাঁওয়ের নিজ বাসা থেকে তাকে একটি বিস্ফোরক মামলায় গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে আরেক মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। বর্তমানে কারাগারে আছেন তিনি।

ঠাকুরগাঁও-২ (বালিয়াডাঙ্গী ও হরিপুর) আসনের এমপি দবিরুল ইসলাম সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, মামলা ও দেশছাড়া করেন। এ আসনে দবিরুল ও পরে সুজন এমপির রাজনৈতিক প্রভাব মানুষকে ভয়-ভীতির মধ্যে রেখেছিল। তার আসনে রাজনৈতিক ক্ষমতায় তার পরিবারের লোকজন ছাড়া কেউ আসতে পারেনি উপজেলা, থানা এবং সংসদ নির্বাচনে লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে বার বার ভোট চুরি করে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখেন তারা। দেদারসে চালান নিয়োগ ও টেন্ডার-বাণিজ্য। এখানে পুলিশেরও কোনো আইন চলত না।

ঠাকুরগাঁও-৩ (পীরগঞ্জ ও রাণীশংকৈল) আসনে জাতীয় পার্টি (জাপা) ও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রভাব ছিল ভাগাভাগির সংসার। দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের দুঃশাসনে অতিষ্ঠ ছিল বিরোধী মত ও সাধারণ মানুষ। লুটপাট, সরকারি জমি দখল আর নিয়োগ-বাণিজ্য করে জাপা ও আওয়ামী লীগ নেতারা হাতিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।

আরো গডফাদার ছিলেন সংরক্ষিত আসনের এমপি সেলিনা জাহান লিটা, ওয়ার্কার্স পার্টির ইয়াসিন আলী ও আওয়ামী দোসর জাপার মহাজোটের এমপি হাফিজউদ্দিন। এই তিন এমপি পাল্লা দিয়ে স্কুল, কলেজ, মাদরাসায় নিয়োগ-বাণিজ্য করেছেন। গম কেলেঙ্কারি, টেন্ডার বাণিজ্য চালিয়েছেন মিলেমিশে।

এমপি লিটা ক্ষমতার অপব্যবহার করে জাতীয়করণ তালিকা থেকে রাণীশংকৈল ডিগ্রি কলেজের নাম কেটে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সুপারিশ নিয়ে রাণীশংকৈল মহিলা কলেজকে অন্তর্ভুক্ত করেন। এখান থেকে হাতিয়েছেন বিপুল অংকের টাকা। এছাড়া নেকমরদ বঙ্গবন্ধু কলেজকে সরকারিকরণ করার নামে লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য করেছেন।

ঠাকুরগাঁও-৩ (পীরগঞ্জ ও রাণীশংকৈল) আসনের জাপার এমপি হাফিজ উদ্দিন দলীয় লোক ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগসাজশে লুটপাট চালিয়েছেন। এখানে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনি সহিংসতা হয়েছে বেশ কয়েকটি। এর মধ্যে খনগাও ইউনিয়নে ভোট কেন্দ্রে পুলিশের গুলিতে এক শিশুসহ তিনজন মারা যায়। এ ঘটনায় মামলা হয় বিএনপি নেতাকর্মীর নামে।

আইনশৃঙ্খলার অবনতি

পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের কোণঠাসা ও অত্যাচার-নির্যাতনে ব্যস্ত থাকায় ভেঙে পড়েছিল আইনশৃঙ্খলা। এতে দেড় দশকে শতাধিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, যেগুলো রাজনৈতিক নয়।

মামলা কাঁধে নিয়ে মৃত্যু

রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও হয়রানিমূলক মামলায় হাজিরার পর হাজিরা দিতে দিতে মামলা নিষ্পত্তি না হলেও অনেকের জীবন অবসান হয়েছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জেলা বিএনপির সভাপতি তৈমুর রহমান, জেলা কৃষক দলের সভাপতি আনোয়ারুল ইসলাম আনোয়ার, সদর থানা বিএনপির সভাপতি আনোয়ার হোসেন লাল, সদর উপজেলার শুখানপুকুরী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আলম প্রমুখ।

ঠাকুরগাঁওয়ে ৪ জুলাই যোদ্ধা শহীদ

ঠাকুরগাঁওয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হামলা চালিয়ে কয়েকশ ছাত্র-জনতাকে আহত করেছে পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। শহীদ হন আল মামুন, সাহান পারভেজ, আবু রায়হান ও রাকিবুল হাসান। এছাড়া ৪ আগস্ট খেলতে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আন্দোলনে অংশ নেয় লামিম হাসান (১০)। তার বাম চোখে গুলিবিদ্ধ হয়। পরে হাসপাতালে ভর্তি করলেও সদর উপজেলার নারগুন গ্রামের মমিনুল-সাবিনা দম্পতির সন্তান লামিমের চোখ স্বাভাবিক হয়নি। এছাড়া বহু ছাত্র-জনতা এখনো শরীরে বুলেট নিয়ে জীবন সংগ্রাম চালাচ্ছেন।

জেলা যুবদলের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক জাহিদুর রহমান জাহিদ বলেন, গত বছরের ৪ আগস্ট চৌরাস্তায় মিছিলের সামনের সারিতে ছিলাম। স্বৈরাচারবিরোধী স্লোগান দেওয়ার সময় পুলিশ গুলি করে। চোখে বিদ্ধ হলে গুরুতর জখম হই। মাটিতে লুটিয়ে পড়লে জুলাই যোদ্ধারা উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন। তবে কোনোরকমে বেঁচে গেছি।

সমন্বয়ক ইসরাত ফারজানা বলেন, জেলায় তিন শতাধিক আহত জুলাই যোদ্ধাকে সহযোগিতা করেছে প্রশাসন। এখনও অনেকের নাম তালিকায় ওঠেনি। যারা আহত হয়েছিল তাদের উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বাদ পড়া যোদ্ধাদের নামের তালিকা করা হচ্ছে।

পুলিশের গাফিলতির অভিযোগ

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মী ও সন্ত্রাসী আত্মগোপনে চলে যান। অনেকে পালিয়ে যান। তবে সাবেক মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন, সাবেক এমপি দবিরুল ইসলাম, এমপি সুজন, আঞ্জুমান আরা, জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সমীর দত্ত, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক নেতা কামরুল হাসান খোকন, ইউপি চেয়ারম্যান অখিল চন্দ্রকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এর বাইরে অধিকাংশ আওয়ামী রাঘব-বোয়ালরা অধরাই রয়ে গেছেন। তাদের অনেকেই এখনো বুক ফুলিয়ে চলেন, দাপিয়ে বেড়ান শহর-বন্দর।

যাদের এখনো গ্রেপ্তার করা হয়নি তাদের মধ্যে অন্যতম হলেনÑ সাবেক এমপি সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অরুনাংশ টিটো, সাধারণ সম্পাদক মোশারুল ইসলাম, ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ সম্পাদক স্বপন, সভাপতি মাহাবুবুর রহমান খোকন, আওয়ামী লীগ নেতা বাবলুর রহমান বাবলু, সাবেক রেলমন্ত্রী সুজনের ভাগিনা স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা শাহ নাজমুল এপোলো, আবদুর রশিদ, রাণীশংকৈল উপজেলার আওয়ামী লীগের সভাপতি সহিদুল হক, সাবেক এমপি সেলিনা জাহান লিটা, আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল কাদের, রমজান আলী, আলমগীর হোসেন, রেজাওয়ানুল হক বিপ্লব, জিয়াউর রহমান জিয়া, মিঠু প্রমুখ।

পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম বলেন, পুলিশ তৎপর আছে। মামলার আসামিদের ধরতে নিয়মিত অভিযান চলছে। তথ্য দিয়ে সহায়তা করলে গ্রেপ্তারে সুবিধা হবে।

জেলা জামায়াতে আমির মাওলানা বেলাল উদ্দিন প্রধান বলেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার জন্য একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন শেখ হাসিনা। যেভাবে গ্রেপ্তার, গুম, খুন ও সন্ত্রাস চালিয়েছে তাতে পুরো দেশই কারাগারে পরিণত হয়েছিল। এই অত্যাচার-জুলুমের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ায় তাকে পালাতে হয়েছে। তবে তাদের উপযুক্ত বিচার হতে হবে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে যেন ভবিষ্যতে আর কেউ দানব হওয়ার স্বপ্ন না দেখে।

জেলা বিএনপি সভাপতি মির্জা ফয়সল আমিন আমার দেশ-কে বলেন, গত ১৭ বছরে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে ঠাকুরগাঁওয়ের ১৪টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা জেল, জুলুম, মামলাসহ নানা রকমের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। দলীয় কর্মসূচিতে পুলিশের লাঠিচার্জ, টিয়ার সেল, গুলি চালানো ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে রাতের আঁধারে গ্রেপ্তারের নামে হয়রানি করা হয়েছে। মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল। আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা আমাদের নেতাকর্মীদের কুপিয়ে হাত কেটেছে, গড়েয়া ইউনিয়নে কুপিয়ে হত্যা করেছে। পুলিশ পিটিয়ে হরিপুরের যুবদল নেতা আকরামকে হত্যা করেছে। গুলিতে চোখ নষ্ট হয়েছে। দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও জেল খেটেছেন। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে জেলা বিএনপির দলীয় কার্যালয় তিনবার আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। এসব জুলুমের বিচার অবশ্যই হতে হবে।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত