‘জামিআতুল কারউয়্যিন’ বা আল-কারউয়্যিন বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীর প্রথম ও প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়। ৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে মরক্কোর ফেজ শহরে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠা করেন একজন মুসলিম মহিলা ফাতেমা আল-ফিহরি। দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃত মিসরের ‘জামিআতুল আজহার’ প্রতিষ্ঠিত হয় ৯৭০ বা ৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে। তার প্রায় ১২০ বছর পর ১০৮৮ খ্রিষ্টাব্দে ইতালিতে ‘বোলোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটিই ইউরোপের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। তারপর ১০৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘আল-মাদরাসাতুন নিজামিয়াহ’। সে সময় মুসলিম বিশ্বে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেও মাদরাসা হিসেবে অভিহিত করা হতো। তারপর ১০৯৪ খ্রিষ্টাব্দে স্পেনের ‘সালামাঙ্কা বিশ্ববিদ্যালয়’, ১০৯৬ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের ‘অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়’, ১১৬০ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্সের ‘প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়’ এবং ১২০৯ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের ‘কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মাত্র ৭০-৮০ বছর পর, ১২৮০-৯১ খ্রিষ্টাব্দে সুলতানি বাংলার রাজধানী সোনারগাঁয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়টি। নালন্দাকে স্বীকার করেও গবেষকরা এটিকে উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম প্রতিষ্ঠিত ও মুসলিমশিক্ষা-সমন্বিত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবেও স্বীকৃতি দেন। এটি প্রতিষ্ঠা করেন আরব বা মধ্য এশিয়া থেকে আসা বিশ্ববিখ্যাত সুফি ও মুসলিম স্কলার শায়েখ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা। প্রায় ৮০০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত বাংলার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়টি আজ কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। কিন্তু বইয়ের পাতায় রয়ে গেছে এর ইতিহাস আর বাস্তবে পাওয়া যায় কয়েকটি মাত্র ভবনের ধ্বংসাবশেষ।
প্রতিষ্ঠাতা শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা
যেসব মহাপুরুষ বাংলায় জ্ঞান-বিজ্ঞান, নৈতিকতা-মূল্যবোধ, একত্ববাদ ও ধর্মীয় সম্প্রীতি প্রচারে অসামান্য অবদান রেখেছেন, তাদের মধ্যে মুন্সীগঞ্জ বা বিক্রমপুরের বাবা আদম শহীদ, বগুড়া বা পুণ্ড্রবর্ধনের শাহ সুলতান বলখী মাহিসাওয়ার, ময়মনসিংহের শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমী, রাজশাহী বা বরেন্দ্রের শাহ মখদুম রূপোশ, সিলেটের শাহজালাল ও সোনারগাঁয়ের শায়েখ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা ছাড়া অন্য কারো বিষয়ে বাংলায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বিস্তারের ইতিহাস জানা যায় না। শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামাই বাংলার ইতিহাসে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং উপমহাদেশে হাদিসশাস্ত্রের পাঠদান শুরু করেন। তার আগে বাংলা-পাক-ভারত উপমহাদেশে হাদিস শিক্ষার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের ইতিহাস জানা যায় না।
গবেষকরা বলেন, উপমহাদেশে আবু তাওয়ামাই প্রথম হাদিসের অন্যতম সংকলনগ্রন্থ সহিহ বুখারির হাতে লেখা কপি নিয়ে আসেন। তিনি ছিলেন উপমহাদেশের প্রথম হাদিসবিশারদ বা মুহাদ্দিস এবং একাধারে আইনবিদ, ভেষজবিদ ও গণিতবিদ। ভূগোল, রসায়ন ও যুদ্ধবিদ্যায় ছিল তার বিশেষ পারদর্শিতা।
তিনি ১২০০ খ্রিষ্টাব্দের গোড়ার দিকে মধ্য এশিয়ার বুখারায় জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ বুখারায় সমাপ্ত করেন। পরবর্তী সময়ে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে ইয়েমেনের অধিবাসী হন। সেখানে বিভিন্ন বিষয়ে সর্বোচ্চ স্তরের ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। তার অসামান্য জ্ঞান, আধ্যাত্মিক সাধনা ও মানবিক গুণাবলির কারণে গোটা আরবে তার সুমান-সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ তার কাছ থেকে শিক্ষা ও দিকনির্দেশনা নিতে ছুটে আসেন। তার পরামর্শ ও সদুপদেশ থেকে উপকৃত হন বিভিন্ন সুলতান-আমির-উমরাও। কোথাও কোথাও জনগণের কাছে সুলতান বা আমিরদের চেয়ে তার জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা ছিল বেশি।

দিল্লি আগমন
দিল্লিতে তখন সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের শেষ সময় চলছে। ১২৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ৬০ বছর বয়সে তিনি দিল্লি সালতানাতের সুলতান নির্বাচিত হন। তখন তার বয়স ৭৮। কিছুদিন আগে দিল্লি সালতানাতের সবচেয়ে বিদ্রোহপ্রবণ অঞ্চল বাংলার দীর্ঘ বিদ্রোহ দমন করে এসেছেন। ১২৮৪ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লিতে আগমন করেন শায়েখ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা। তার আগমনের খবর ছড়িয়ে পড়লে দিল্লির হাজার হাজার মানুষ তার শিক্ষা ও সান্নিধ্য নিতে প্রতিদিন জমা হয়। কোনো কোনো বিবরণ থেকে জানা যায়, অল্প দিনে তার ছাত্র-শিষ্যের সংখ্যা হাজার পনেরো ছাড়িয়ে যায়। এত মানুষের সমাগমে অস্থির বোধ করেন সুলতান গিয়াসুদ্দিন বলবন। শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামাকে হুমকি মনে করেন তার সালতানাতের জন্য। ফলে শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামার সঙ্গে তিনি কথা বলেন এবং কৌশলে তাকে দিল্লি থেকে বাংলায় আসার পরামর্শ দেন। শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা সরল মনে সুলতানের পরামর্শ গ্রহণ করে কিছুদিনের মধ্যে দিল্লি থেকে বাংলার উদ্দেশে রওয়া হন। সঙ্গে পরিবারের লোকজন ছাড়াও বহু ভক্ত-শিষ্য তার অনুগামী হন। বিশেষভাবে জানা যায় তার ভাই হাফেজ মঈনুদ্দিনের কথা।
বিহারে অবস্থান
বাংলায় আসার আগে তিনি বিহারের রাজধানী পাটনার কাছাকাছি মানের অঞ্চলে যান। বেশ কিছুদিন মানেরে অবস্থান করেন। সেখানে তিনি আবু ইয়াহইয়া মানেরি নামে এক সুফি ও মুসলিম স্কলারের সান্নিধ্য লাভ করেন। আবু ইয়াহইয়া মানেরি তার বালক ছেলে ইয়াহইয়াকে শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামার কাছে শিষ্য হিসেবে অর্পণ করেন। এরপর সম্ভবত ১২৮৫ খ্রিষ্টাব্দের শুরুর দিকে তিনি বাংলার সমৃদ্ধ জনপদ সোনারগাঁয়ে আগমন করেন। নিজ পরিবার ও শিষ্যদেরও সঙ্গে নিয়ে আসেন।
বাংলায় আগমন
শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামার দিল্লি থেকে সোনারগাঁয়ে আসার ব্যয়ভার দিল্লির সুলতান গিয়াসুদ্দিন বলবন বহন করেন। শুধু তাই নয়, সোনারগাঁয়ে যাতে তিনি শিক্ষাদান, নৈতিকতা ও একত্ববাদ প্রচার করতে পারেন তারও বন্দোবস্ত করে দেন তিনি। সে সময় দিল্লির শাসনাধীন বাংলার গভর্নর ছিলেন দিল্লির সুলতান বলবনের ছেলে নাসিরুদ্দিন বুগরা খান। পরে তিনি নিজেকে স্বাধীন সুলতান ঘোষণা করেন। কোনো কোনো বিবরণ থেকে জানা যায়, সুলতান বলবন তার ছেলে বাংলার গভর্নর নাসিরুদ্দিন বুগরা খানকে চিঠি লিখে আবু তাওয়ামাকে সহযোগিতার নির্দেশ দেন। সুলতানের নির্দেশে বুগরা খান তাকে সর্বাত্মক সহায়তা করেন।

বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন
মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস বিষয়ে যথেষ্ট গবেষণা না হওয়ার ফলে প্রমাণিত সূত্র না হলেও কারো কারো বর্ণনায় জানা যায়, সে সময় তার বিশ্ববিদ্যালয় ও খানকাহ প্রতিষ্ঠার জন্য সুলতান নাসিরুদ্দিন বুগরা খান শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামাকে প্রায় ৩০০ একর পরিমাণ আবাদি জমি লা-খেরাজ বা করবিহীন সম্পত্তি হিসেবে দান করেন।
তাতে তিনি ভক্ত-মুরিদদের জন্য একটি আলাদা খানকাহ এবং ছাত্রদের জন্য একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় ও কুতুবখানা বা পাঠাগার স্থাপন করেন।
সোনারগাঁয়ের এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাগত মান ও মর্যাদা তৎকালীন বিশ্বের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় যেমন মরক্কোর কারাউয়্যিন, মিসরের আল-আজহার, বাগদাদের নেজামিয়া, মালীর তিম্বুকতু, স্পেনের সালামাঙ্কা, ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সমপর্যায়ের ছিল বলে অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেন।
সিলেবাস বা পাঠ্য বিষয়
এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি ও ফারসি ভাষায় লিখিত গ্রন্থাবলিই শুধু পড়ানো হতো তা-ই নয়, এদেশের স্কলারদের লেখা গ্রন্থও পড়ানো হতো বলে জানা যায়। শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা হাদিস ও আইনশাস্ত্রের পাশাপাশি ভেষজ, গণিত, ভূগোল, রসায়ন ও যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। ফলে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশিষ্ট হাদিসগ্রন্থ সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম ও মুসনাদে আবু ইয়ালার পাঠদান করা হতো।
পাশাপাশি তাসাওফ বা অধিবিদ্যা, ফিকহ বা আইনশাস্ত্র, মানতেক বা তর্কশাস্ত্র, ইতিহাস, জ্যোতির্বিজ্ঞান, নৌবিদ্যা, ভেষজ বিজ্ঞান, গণিত, ভূগোল, রসায়ন, দর্শনসহ সমকালীন বিশ্বের প্রয়োজনীয় বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হতো এবং এসব বিষয়ে পাঠদানের জন্য যে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োজিত ছিল, সেটি সহজভাবেই অনুমান করা যায়।
ছাত্রসংখ্যা
শায়েখ শরফুদ্দিন আগে থেকেই আরব ও হিন্দুস্তানে স্কলার হিসেবে অত্যন্ত পরিচিত হওয়ায় তার সান্নিধ্য ও শিক্ষা নিতে বৃহৎ বাংলার পাশাপাশি হিন্দুস্থানসহ আরব-আফ্রিকা থেকেও বহু ছাত্র-সাধক সোনারগাঁয়ে আসতে থাকেন।
তখন বাংলায় বা কসমোপলিটন সিটি সোনারগাঁয়ে বোখারা, কান্দাহার, খোরাসান, সিরিয়া, ইয়েমেন, বিহার ও দাক্ষিণাত্যের ছাত্রদের উপস্থিতি ছিল সাধারণ বাস্তবতা। অচিরেই সোনারগাঁ উচ্চশিক্ষা ও আধ্যাত্মিক সাধনার একটি কেন্দ্র পরিণত হয়। ধারণা করা হয়, তখন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যা ছিল প্রায় ১০ হাজার। এর আগে বিহারের নালন্দা ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার আর কোনো শিক্ষায়তনে এত ছাত্রের সন্নিবেশ হয়নি।
কুতুবখানা বা পাঠাগার
এখনো সোনারগাঁয়ের মোগড়াপাড়া থেকে দমদমায় গেলে দেখা যায়, অবহেলা আর অযত্নে একটি ভগ্নপ্রায় ভবন কোনোমতে টিকে আছে। ভবনটি বিরাট হলেও এখন অবশিষ্ট আছে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ। ভবনের অলংকৃত তোরণ, প্রশস্ত কক্ষ এবং দোতলায় ওঠার সিঁড়ি প্রমাণ করে, এ ভবনটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগার কক্ষ। দেয়ালগুলো প্রশস্ত ও পুরো। দেয়ালে ছোট ছোট পাতলা জাফরি ইট। মেঝের তিন ফুট উপর থেকে প্রায় ছাদ পর্যন্ত চারপাশের দেয়ালে আছে বই রাখার উপযুক্ত বিভিন্ন সাইজের দেয়াল-শেলফ। এটি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কুতুবখানা বা পাঠাগার ছিল, তাতে আর সন্দেহ থাকে না। এরকম আরো পাঠাগার ভবন ছিল বলে স্বাভাবিকভাবেই অনুমান করা যায়। কিন্তু কালের করাল গ্রাসে তা আজ অস্তিত্বহীন।
তবে এই ভবনের খুব কাছেই আরো কিছু ভবন এখন জনসাধারণের দখলে আছে। সরকারি উদ্যোগের অভাবে সংরক্ষিত হচ্ছে না। ফলে জানা যাচ্ছে না বাংলার প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়টির বিস্তৃত ইতিহাস।
ধ্যানাগার বা মেডিটেশন সেন্টার
পাঠাগার ভবনের ডান পাশ দিয়ে মাটির নিচে নেমে গেছে সরু একটি সিঁড়ি। দুজন একসঙ্গে নামার উপায় নেই। আট থেকে ১০ ধাপ সিঁড়ি ভাঙার পর মোড় নিতে হয় হাতের বাঁ দিকে। অন্ধকারে চোখের আলো কোনো কাজে আসে না। গা ছমছমে পরিবেশ। কিছুক্ষণ পর ফিরে আসে চোখের আলো। চোখে পড়ে পাঁচ ফুট উচ্চতার এবং প্রায় ১০×১০ বর্গফুটের একটি কামড়া। নেই কোনো দরজা বা জানালা। অন্ধকার এই কক্ষটি ছিল শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামার ধ্যানাগার বা মেডিটেশন সেন্টার। ছাত্রদেরও মেডিটেশন শিক্ষা দেওয়ার জন্য এটি কাজে লাগানো অস্বাভাবিক নয়।

শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামার রচিত গ্রন্থ
শিক্ষাদান ও একত্ববাদ প্রচারের পাশাপাশি গ্রন্থ রচনার ক্ষেত্রেও শায়েখ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা ছিলেন আগ্রহী। ফারসি ভাষায় রচিত ‘নামায়ে হক’ নামে তার একটি গ্রন্থের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এ গ্রন্থে ১৮০টি কবিতা লিপিবদ্ধ আছে। অনেকে এ গ্রন্থটিকে ‘মসনবী বনামে হক’ নামে অভিহিত করেছেন। গ্রন্থটি ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে মুম্বাই থেকে, ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে কানপুর থেকে এবং পাকিস্তানের লাহোরের মাকতাবায়ে কাদেরিয়া কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছিল । এটি এখনো পাওয়া যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই ছিলেন বাংলার। এ কারণে তিনি বাংলা ভাষায় গ্রন্থ রচনায় তাদের উৎসাহ প্রদান করেন। তার তত্ত্বাবধানে ‘মনজিলে মাকামাত’ নামে বাংলা ভাষায় একটি সুফিতাত্ত্বিক দর্শনগ্রন্থ রচিত হয় বলে জানা যায়। যদিও এ গ্রন্থের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। তবে বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা লিখিত একাধিক পাণ্ডুলিপি ব্রিটিশ জাদুঘরের আর্কাইভ ভবনে রক্ষিত আছে।
শরফউদ্দিন আবু তাওয়ামা কর্তৃক সহিহ বোখারির হাদিসের ওপরে রচিত একটি পাণ্ডুলিপি বাগদাদের গ্রন্থাগারে এখনো রক্ষিত আছে। ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক আখতার-উল-আলম বাগদাদের গ্রন্থাগারে শরফউদ্দিন আবু তাওয়ামার লিখিত পাণ্ডুলিপিটি দেখতে পান। দেশে ফিরে ডক্টর কাজী দীন মুহম্মদকে সঙ্গে নিয়ে আখতার-উল-আলম সোনারগাঁয়ের অবহেলিত পল্লিতে জঙ্গল সাফ করে শেখ আবু তাওয়ামার কবর জিয়ারত করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত ছাত্র
এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত ছাত্র এবং পরে জগদ্বিখ্যাত মুসলিম স্কলার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন শরফুদ্দিন ইয়াহিয়া মানেরি। তিনি ছিলেন বিহারের ইয়াহিয়া মানেরির ছেলে এবং শেখ শরফুদ্দিন আবু তওয়ামার মেয়েজামাই।
শরফুদ্দিন ইয়াহিয়া মানেরি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। জন্মস্থান মানে ফিরে যাওয়ার আগে শরফুদ্দিন ইয়াহিয়া মানেরি তার শিক্ষক শরফুদ্দিন আবু তওয়ামার মেয়েকে বিয়ে করেন। পরবর্তী জীবনে সুফি জগতে তিনি বিরল খ্যাতির অধিকারী হন। তার মাকতুবাত বা রচনা ও চিঠির সংকলন পাওয়া গিয়েছে। আধ্যাত্মিক উপদেশে এসব রচনা পরিপূর্ণ। সমসাময়িক দিল্লির সুলতানরা তার উপদেশ গ্রহণের জন্য উদগ্রীব থাকতেন বলে জানা যায়। ধারণা করা হয়, ‘শরফুদ্দিন’ নামটি তিনি তার শিক্ষকের নাম থেকে গ্রহণ করছেন।
সোনারগাঁয়ে প্রাপ্ত একটি শিলালিপিতে কয়েকজন উচ্চপদস্থ প্রশাসনিক কর্মকর্তার নাম পাওয়া যায়, যাদের প্রত্যেকের নামের শুরুতে পদবি হিসেবে মুহাদ্দিস (হাদিস বিশারদ) শব্দটি যুক্ত ছিল। ধারণা করা হয়, তারা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্র্যাজুয়েট ছিলেন। সম্ভবত তখনকার গ্র্যাজুয়েট বা শিক্ষাসমাপনকারীদের মুহাদ্দিস বলা হতো। প্রশাসনিক কাজের পাশাপাশি তারা হয়তো শিক্ষকতায় যুক্ত ছিলেন।
ইয়াহয়া মানেরির রচনা ও গ্রন্থাবলি
শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামার অন্যতম শিষ্য শায়খ ইয়াহইয়া মানেরিও গ্রন্থ রচনায় ছিলেন সিদ্ধহস্ত। জানা যায়, সুফি সাহিত্য ও দর্শনশাস্ত্রে তিনি শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তার রচিত ‘মকতুবাতে সাদি’ সুফি সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। এছাড়া ‘মালফুজুস সফর’ নামেও মানেরির একটি বিখ্যাত গ্রন্থের পরিচয় পাওয়া যায়।
শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামার মৃত্যু ও মৃত্যুর পর
শায়েখ আবু তাওয়ামা ৭০০ হিজরি মোতাবেক ১৩০০ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন বলে জানা যায়। তার মৃত্যুর পরও এ বিশ্ববিদ্যালয়টি অনেক দিন স্থায়ী ছিল। পরবর্তীকালে শেখ আলাউদ্দিন আলাউল হক (মৃ. ১৩৯৮), তার নাতি শেখ বদর-ই-ইসলাম ও নাতিপুত্র শেখ জাহিদ সোনারগাঁয়ে ধর্মতত্ত্ব ও সুফিতত্ত্ব বিষয়ে শিক্ষা দিতেন। আবু তাওয়ামা প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় ও খানকা সম্ভবত তার অনুসারীদের দ্বারা এবং পরবর্তীকালে প্রখ্যাত সুফিসাধক সাইয়্যিদ ইবরাহিম দানিশমন্দ এবং তার বংশধর সৈয়দ আরিফ বিল্লাহ মুহাম্মদ কামেল, সাইয়্যিদ মুহম্মদ ইউসুফ ও অন্যদের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়।
ধ্বংস
কবি, ইতিহাস গবেষক ও সম্পাদক আবদুল হাই শিকদার তার ‘সোনারগাঁ : অন্তরে বাহিরে রূপকথা’ গ্রন্থে লেখেন, মনে প্রশ্ন জাগে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কী হলো? তার সামান্য ভগ্নাবশেষও কি কোথাও নেই? আবু তাওয়ামার মৃত্যুর পর আর কতদিন টিকেছিল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়? ইতিহাস বলে, এই বিশ্ববিদ্যালয় সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের শাসনামল পর্যন্ত টিকে ছিল। আজম শাহ রাজা গণেশের চক্রান্তে খুন হলে এই বিশ্ববিদ্যালয়টিও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়। এরপর ইলিয়াস শাহি বংশের পতনের পর যখন রাজা গণেশ ক্ষমতা গ্রহণ করেন, তখন থেকেই আর কিছুই জানা যায় না বিশ্ববিদ্যালয়টি সম্বন্ধে। সম্ভবত রাজা গণেশ বিশ্ববিদ্যালয়টি ধ্বংস করে দেন।
পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি ও সরকারের অমনোযোগ
বাংলার স্বর্ণসময় মধ্যযুগের সুলতানি আমলের এই গৌরব সোনারগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়টি ধ্বংস হওয়ার প্রায় ৭০০ বছর পর ভারতের বিখ্যাত স্কলার সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী ১৯৮৪ সালে সোনারগাঁয়ে আসেন। শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামার প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টির ধ্বংসাবশেষ ও বেহাল দশা দেখে তিনি চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামার স্মৃতি ভাস্বর রাখতে সে বিশ্ববিদ্যালয় সীমানার কাছেই ‘মাদরাসাতুশ শরফ’ নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করতে পরামর্শ দেন এবং অনুদান করেন। যার দায়িত্ব পালন করছেন প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মাওলানা ওবায়দুল কাদের নদভী।
যদিও ‘মাদরাসাতুশ শরফ’ প্রচলিত অর্থে একটি কওমি মাদরাসা। আর শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটি ছিল একটি সমৃদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক গবেষক ড. আকরাম নদভী বাংলাদেশে এসে শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামার কবর জিয়ারত করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়টি পুনঃপ্রতিষ্ঠার ওপর জোর তাগিদ দেন।
এছাড়া বাংলা, ভারত ও আরবের ইতিহাস সম্পর্কে জানেন, এমন গবেষক ও স্কলার মাত্রই বাংলার এই বিশ্ববিদ্যালয়টির পুনঃপ্রতিষ্ঠা বাংলাদেশের ইতিহাস ও গৌরবের পুনর্জাগরণ মনে করেন এবং জোর দাবি জানান। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো সরকার এ পর্যন্ত এ নিয়ে কোনোরকম উদ্যোগ দূরে থাক, আগ্রহই দেখায়নি। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবশিষ্ট ভবনগুলোর সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতেও অনাগ্রহী। এই রহস্যজনক অনাগ্রহের কোনো কারণ থাকতে পারে বলে সচেতন সমাজ মনে করে না।
নালন্দা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে সোনারগাঁ নয় কেন?
প্রাচীন ভারতের বিহার রাজ্যে পঞ্চম থেকে ১৩ শতক পর্যন্ত চালু ছিল নালন্দা বিহার বা বিশ্ববিদ্যালয়। এটি ভারতের অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃত। বৌদ্ধ ধর্মতত্ত্বসহ বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হতো নালন্দায়। ১৩ শতকে এটি ধ্বংস হয়ে যায়।
নালন্দাকে পুনরুজ্জীবিত করার ধারণা ২০০৭ সালে আলোচিত ও অনুমোদিত হয় এবং ২০১৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর উদ্বোধন করা হয়। প্রতিষ্ঠাকালে ভারতের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন বিশ্ববিদ্যালয়টির পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ছিলেন।
অথচ বাংলার ইতিহাসের প্রথম ও প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়টি এখনো অবহেলায় হারিয়ে যেতে দিচ্ছি আমরা। প্রশ্ন জাগে, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ৮০০ বছর পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হলে বাংলার সোনারগাঁ বিশ্ববিদ্যালয় কেন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না? আরেক নোবেল লরিয়েট বর্তমান বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস কি এই মহান গৌরব পুনরুদ্ধারের বিরল সুযোগ কাজে লাগাতে আগ্রহী হবেন?
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন


নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হলেন গাজার চিকিৎসকরা