তানজিয়ার লড়াইটা অস্তিত্বের

রুমান হাফিজ
প্রকাশ : ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২: ১৮

৪ আগস্ট। গায়ে ১০২ ডিগ্রি জ্বর। শেষবার কল করে বিদায় নিতেই ওপাশ থেকে মায়ের কান্না। তবুও বেরিয়ে গেলেন। কর্মসূচি শেষ হলো। বাসার মালিক কল করে বললেন, ফেরা যাবে না। বাসা পুলিশের পাহারায়। কোনো উপায় না দেখে আরেক বাসায় থাকতে গেলেন। বলছিলাম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মৌলভীবাজার জেলার প্রধান সমন্বয়ক তানজিয়া শিশিরের কথা।

তানজিয়া শিশিরের জন্ম সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার লোভা তীরবর্তী সতিপুর গ্রামে। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হোন মৌলভীবাজার জেলায়। এখন মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষে।

বিজ্ঞাপন

যেখান থেকে শুরু

তানজিয়া ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন-পরবর্তী ছাত্র অধিকার পরিষদের মৌলভীবাজার জেলা সমন্বয়ক ছিলেন। চব্বিশের কোটা সংস্কার আন্দোলনে দেশ যখন উত্তাল হয়ে উঠল নিজেকে যুক্ত করার প্রয়োজন অনুভব করলেন তানজিয়া। মৌলভীবাজারে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল না থাকায় আন্দোলন অন্য জেলা শহরের মতো হচ্ছিল না। ১০ জুলাই থেকে কর্মসূচি শুরু হয়। তানজিয়া যুক্ত হন ১৬ জুলাই। সেদিনই প্রথম মৌলভীবাজার সরকারি কলেজে ছাত্রলীগ আক্রমণ করে। এরপর জেলা প্রেস ক্লাব চত্বরে জড়ো হয়ে চৌমুহনা অভিমুখে মিছিল করেন। সেখানেও আক্রমণ করে যুবলীগ।

লড়াইটা অস্তিত্বের

১৬ জুলাই আন্দোলনে মাত্র তিনজন মেয়ে ছিলেন। সেদিন যুবলীগের এক নেতা জিজ্ঞেস করেন, ‘মেয়েমানুষ এখানে কেন এসেছ? বাসায় চলে যাও।’ ঠিক ওই মুহূর্তে তানজিয়া অনুভব করেন এখানে লড়াইটা কেবল কোটা সংস্কারের নয়, লড়াইটা নিজের অস্তিত্বেরও। তিনি বলেন, তখনই চিন্তা করি আমার অস্তিত্বের জন্য আমাকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। সেদিন থেকেই শুরু হয়ে যায় বিচ্ছিন্ন জীবনের হাতছানি। ওইদিন দুপুরের পর ঘোষণা আসে ১৭ জুলাই মশাল মিছিল। সেদিনও হামলা হয়। ওই রাতে মিটিং করে ১৮ জুলাই কর্মসূচি ঘোষণা করি। সেদিন আমার নাম উল্লেখ করে কর্মসূচি ঘোষণা করার জের ধরে ছাত্রলীগ ও প্রশাসন আমাকে খুঁজতে থাকে।

Tanjia 2

সাহসের সঙ্গে

১৮ জুলাই, বেলা ১টা। মিছিল শুরু হলো। পুলিশ পথ আটকাতে চাইল কয়েকবার। মিছিলের অগ্রভাগে গিয়ে দাঁড়িয়ে বুক পেতে দিলেন তানজিয়া। মিছিল ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশের যারপরনাই প্রচেষ্টা। লাঠিচার্জ, ধড়পাকড়, কাঁদানেগ্যাস নিক্ষেপ—সবই ছিল। তানজিয়া সবাইকে বললেন, আমাকে ভেদ করে তোমাদের বুকে গুলি লাগবে না। মিছিল চালিয়ে যেতে হবে। পুলিশের সামনে বুক পেতে দেওয়ার এই ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। এমন সাহসিকতার পরিচয় প্রশংসা কুড়ায় সবার।

নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্নের দিনগুলো

১৮ জুলাই রাত ৮টায় দেশব্যাপী নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তানজিয়া বলেন, নেটওয়ার্কবিহীন শুরু হয় ভয়াবহ দিন। বিভিন্ন জায়গা থেকে শুভাকাঙ্ক্ষীরা সতর্ক করতে থাকেন। মোবাইল, সিম ও বাসা পরিবর্তন করি। বাবা-মা ছাড়া আরেক শহরে আমার পালিয়ে বেড়ানোর দিন বাড়তে থাকে। রুমের আপুরা, বড় আপু নাহিদা আক্তার ও অসংখ্য শুভাকাঙ্ক্ষী তখন অভিভাবকের মতো দাঁড়িয়েছিলেন। কখনো নিজেকে একা মনে হয়নি। শাটডাউন হওয়ার পর যখন ঠিকমতো বাজার করা সম্ভব হচ্ছিল না, তখন বাসায় খাবার পর্যন্ত দিয়ে যান তারা। নতুন সিম থেকে কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। যেকোনোভাবে পরের কর্মসূচি ঠিক করার কথা বলি এবং সেগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, সেটা নিয়ে চলে আলোচনা। ১ আগস্ট আমাকে প্রধান সমন্বয়ক করে চার সদস্যের অস্থায়ী কমিটি প্রকাশিত হয়।

সহজ ছিল না এ পথ

১০২ ডিগ্রি জ্বর উপেক্ষা করে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া তানজিয়ার এ পথ সহজ ছিল না। তিনি বলেন, বুঝতে শেখার পর থেকে শুনেছি বাবা-মা সব সময় বলতেন, আমাদের একটি সন্তান। কখনো মেয়েসন্তান বলেননি। তবু বিপত্তি ঘটল জুলাই অভ্যুত্থানের সময়। আমার শক্তপোক্ত মাও যেন ভাঙা কাচের গ্লাসের মতো টুকরো টুকরো হয়ে গেলেন। যতবার কথা বলতাম, ততবারই কান্নায় ভেঙে পড়তেন। একপর্যায়ে মাও বলে বসলেন, মেয়েমানুষের এসবে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। মুদ্রার এক পিঠে দেশপ্রেম, অপর পিঠে বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্ববোধকে বজায় রেখে রোজ আন্দোলনে বের হতাম। রাজপথে যেতাম, তখনো স্বৈরাচারের দোসরদের কাছ থেকে শুনতে হতো নানা কথা। তবুও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে এসব পেরিয়ে এ বিজয়ের ক্ষুদ্র এক অংশ হতে পেরে আনন্দ অনুভব করছি। আগস্টের ৫ তারিখ দুপুরে বিজয়ের খবর পেলেন তানজিয়া। অতি আনন্দের এ খবর প্রথমেই জানালেন মাকে।

আক্ষেপের প্রতিধ্বনি

৫ আগস্টের আগে ও পরে তুলনা করলে এটা বলতে আমার দ্বিধা নেই যে, বিজয়-পরবর্তী সময় একজন মেয়ে হিসেবে আগের পরিস্থিতির খুব একটা পার্থক্য নেই বললেই চলে। রাজধানী ঢাকাকে কেন্দ্র করে সব রকমের আয়োজন আগে যেমন ছিল, এখনো তেমনই। অথচ এই অভ্যুত্থানে প্রান্তিক শহর থেকে যারা কেবল দেশপ্রেমের জন্য এগিয়ে এসেছিল, তারা আজও বঞ্চিতদের কাতারে। একজন মেয়ে হিসেবে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময় বহু প্রতিবন্ধকতা সামনে এসেছে। বহুবার শুনতে হয়েছে—‘আপনি তো মেয়েমানুষ।’ অথচ আমার প্রত্যাশা ছিল নতুন এই বিজয়ের পর মেয়েমানুষ শোনার আগে শুনব—‘আপনি তো একজন মানুষ।’

স্বপ্ন যেমন

তানজিয়া বলেন, নিজেকে দেশের একজন সৎ নাগরিক হিসেবে গড়তে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। দীর্ঘ ১৭ বছরের শিকল ভেঙে ৩৬ জুলাইয়ে যে বিজয় এসেছে ছাত্র-জনতার হাত ধরে, সে বিজয় ধরে রাখতে নিজেকে নিয়োজিত রাখব। বহু জীবনের বিনিময়ে পাওয়া নতুন এই দেশে যেন আবার কোনো স্বৈরাচারী খুনি শেখ হাসিনার জন্ম না হয়, সেই কামনা করি। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সম্প্রীতির নির্মল এক বাংলাদেশ গড়ে উঠবে—এটাই প্রত্যাশা।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত