ঢাবিতে মাদক, ভবঘুরে ও ভ্রাম্যমাণ দোকানি সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য

মাহির কাইয়ুম, ঢাবি
প্রকাশ : ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ০০: ৪৬

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে মাদক ব্যবসায়ী, ভবঘুরে ও ভ্রাম্যমাণ দোকানিদের সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য নতুন করে আলোচনায় এসেছে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, ডাকসু ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যৌথ উদ্যোগে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অবৈধ দোকান ও ভবঘুরে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার পর এই সিন্ডিকেট ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

এদিকে প্রশাসনের অভিযানের বিরোধিতা করে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর একাংশ হকারদের পক্ষে বিক্ষোভে নেমে পড়ায় বিষয়টি আরো বেশি সমালোচিত হচ্ছে। এছাড়া হকার-ভবঘুরেদের পক্ষ হয়ে একহাত নিচ্ছেন বামপন্থি শিক্ষকদের অনেকে।

বিজ্ঞাপন

গত শনিবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাষ্কর্য এলাকায় বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে একদল হকার ও বহিরাগত বিক্ষোভ মিছিল করে। এসময় তারা ‘কেউ খাবে কেউ খাবে না, তা হবে না তা হবে না; অবৈধ উচ্ছেদ মানি না মানব না’ ইত্যাদি স্লোগান দেন।

বিক্ষোভে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রমৈত্রীসহ বামপন্থি সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা এবং ভবঘুরে- ভ্রাম্যমাণ দোকানি সিন্ডিকেটের সদস্যরা অংশ নেন।

বিক্ষোভে প্রক্টর অফিসের চাকরিচ্যুত টোকেনম্যান ও সাবেক প্রক্টর গোলাম রাব্বানীর ড্রাইভার শামীমকে অংশ নিতে দেখা যায়। তিনি বিগত সময়ে লাখ টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ চাকরিচ্যুত হন।

বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির দপ্তর সম্পাদক ও বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) স্টাফ রিপোর্টার তাওসিফুল ইসলাম বলেন, ‘এই চক্র নতুন নয়। ২০২৩-২৪ সালে আমরা ধারাবাহিক প্রতিবেদন করেছিলাম, যেখানে তাদের চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসার প্রমাণ মেলে। তদন্ত কমিটি সত্যতা পেয়ে শামীমকে চাকরিচ্যুত করে। আজ তাকে ফের সক্রিয় অবস্থায় দেখা উদ্বেগজনক।’

অন্যদিকে বিক্ষোভের প্রতিক্রিয়ায় ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক এবি জুবায়ের, কার্যনির্বাহী সদস্য সর্ব মিত্র চাকমা ও অন্যান্য নেতারা প্রশাসনের কাছে এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা বলেন, বাম সংগঠনগুলো এখন হকারদের নিয়ে ভণ্ডামি করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে যারা এই অবৈধ কর্মকাণ্ডের পৃষ্ঠপোষকতা করছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসন ব্যবস্থা না নিলে আন্দোলনে নামা হবে।

এ নিয়ে ফেসবুক পোস্টে ডাকসুর জিএস এসএম ফরহাদ বলেন, ‘ঢাবির স্টেকহোল্ডার কেবল শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। মাদক ব্যবসায়ী বা অনিবন্ধিত হকারদের কোনো স্থান বিশ্ববিদ্যালয়ে হতে পারে না। হয় ডাকসু থাকবে, নয়তো সিন্ডিকেট থাকবেÑদুটো একসঙ্গে নয়।’

ডাকসুর ভিপি আবু সাদিক কায়েম বলেন, ‘বিতাড়িত ছাত্রলীগের অনুপস্থিতিতে ক্যাম্পাসে নতুন অপরাধী চক্র গড়ে উঠেছে। এই চক্রই এখন হকার ও ভবঘুরে নামের আড়ালে মাদক ও চাঁদাবাজির সিন্ডিকেট চালাচ্ছে।’

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানায়, শনিবার রাত ১০টার দিকে প্রক্টোরিয়াল টিমের এক সদস্য এই সিন্ডিকেটের হামলায় আহত হন। নিরাপত্তাজনিত কারণে তার নাম প্রকাশ করা হয়নি।

প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহাম্মেদ বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রশাসন সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। তবে এটি কেবল প্রক্টোরিয়াল টিমের একার পক্ষে সম্ভব নয়- সিটি করপোরেশন, মেট্রোরেল পুলিশ ও শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা প্রয়োজন।’

এদিকে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন তার ফেসবুক পোস্টে লিখেনÑ ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শ হলো মানবিকতা শেখানো। কোনোরকম উচ্ছেদ, বিশৃঙ্খলা বা সহিংসতা কখনো শিক্ষার্থীর কাজ হতে পারে না।’

আরেক শিক্ষক সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সামিনা লুৎফা ডাকসুর উচ্ছেদ কার্যক্রমকে ‘গুন্ডামি’ আখ্যা দিয়ে সমালোচনা করেন। ফেসবুক পোস্টে তিনি লিখেন, ‘ডাকসুর গঠনতন্ত্রটা তো কোথাও দেখি না। কেউ শেয়ার করবেন, দেখি কোথায় লেখা আছে যে ডাকসুর নামে গুন্ডামি জায়েজ!’

জবাবে ডাকসুর সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পাদক মুসাদ্দিক আলী ইবনে মোহাম্মদ প্রশ্ন তোলেন, ‘শিক্ষক নেটওয়ার্কের গঠনতন্ত্রে কোথায় লেখা আছে যে মাদকাসক্ত ও ভবঘুরেদের রক্ষা করতে হবে?’

শিক্ষার্থীদের মতে, এ বিতর্ক ও দ্বন্দ্বের সুযোগে উদ্যান সিন্ডিকেটটি আরো শক্তিশালী হয়ে উঠছে। তাদের দাবি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অন্তত ৫০-৬০ জন সক্রিয় মাদক চক্র নিয়মিত কাজ করছে, যাদের কাছ থেকে যে কোনো ধরনের মাদক পাওয়া যায়।

ঢাবি শিক্ষার্থী মোহাম্মদ নূর নবী বলেন, ‘হকাররা এখন রাজু ভাস্কর্যের নিচে মাইকিং করে মিছিল করছে-এটা একেবারে কল্পনাতীত। তাদের কারণে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়ছে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর রফিকুল ইসলাম জানান, ‘বহিরাগত ও অবৈধ দোকান উচ্ছেদে নিয়মিত অভিযান চলবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষায় কোনো প্রকার আপস হবে না।’

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত