আত্মসমালোচনার গল্প

বই পড়ার অভ্যাস কমে যাচ্ছে কেন

শিফা চৌধুরী
প্রকাশ : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৬: ৩৪

একটা সময় ছিল, যখন বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যায় উঠোনে বসে মা-বাবা কিংবা দাদা-দাদির মুখে শোনা যেত গল্পের ঝাঁপি। ‘ঠাকুরমার ঝুলি’, ‘সিতারাম কুন্ডু’, কিংবা হ‍ুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস—এগুলো ছিল ঘরের বাতাসে ভেসে বেড়ানো চেনা গন্ধের মতো। কিন্তু আজ সেই গল্পগুলো হারিয়ে যাচ্ছে স্মৃতির ধুলোমাখা পর্দার আড়ালে। বইয়ের পাতা এখন আর আগের মতো নড়ে না, তার বদলে নড়ে মোবাইল স্ক্রিনের আলো।

প্রশ্ন জাগে কেন বই পড়ার অভ্যাস কমে যাচ্ছে?

বিজ্ঞাপন

এর উত্তর একক নয়, বরং বহুমাত্রিক।

প্রযুক্তির দাপট ও স্ক্রিনের প্রলোভন

আজকের শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক মানুষ পর্যন্ত—প্রতিদিন গড়ে কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে দিচ্ছে মোবাইল, ট্যাব বা ল্যাপটপের স্ক্রিনে। সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউব, অনলাইন গেমÑসবকিছু যেন এমনভাবে তৈরি, যাতে মানুষ যতক্ষণ সম্ভব এসবের সঙ্গে লেগে থাকে। এতে পাঠ্যাভ্যাস ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে পড়ছে। বই পড়া যেখানে ধৈর্য চায়, সেখানে ভিডিও চায় শুধু চোখ আর মুহূর্তিক আনন্দ।

ত্বরিতগতির জীবনে ধৈর্যের অভাব

আজকের যুগে আমরা চটজলদি সবকিছু পেতে অভ্যস্ত। খাবার থেকে শুরু করে খবর—সবকিছু চাই দ্রুত, এক ক্লিকে। কিন্তু বই পড়ে মনোযোগ ধরে রাখা, ভাষা বোঝা, চরিত্র উপলব্ধি করা—এসব সময় ও ধৈর্য দাবি করে। এই ধৈর্য আজ অনেকের মধ্যেই নেই।

শিক্ষাব্যবস্থার দিক থেকে পিছিয়ে থাকা

শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেও পাঠাভ্যাস গড়ার প্রতি গুরুত্ব কমে গেছে। পাঠ্যবইয়ের বাইরের পড়া প্রায় উঠেই গেছে। অনেক শিক্ষার্থী শুধু পরীক্ষায় পাস করার জন্য পড়াশোনা করে। ভালো বইয়ের সঙ্গে পরিচয় ঘটে না বললেই চলে। ফলে মননশীলতা তৈরির জায়গায় ফাঁকা পড়ে থাকে।

পারিবারিক পরিবেশ ও অনুপ্রেরণার অভাব

একটি পরিবারে যদি মা-বাবা নিজেরাও বই না পড়েন, তবে সন্তানদের মধ্যে সেই আগ্রহ জন্মাবে কীভাবে? আবার অনেক সময়, শিশু যখন গল্পের বই পড়ে, তখন বড়রা সেটা সময় নষ্ট বলে ধরে নেয়। অথচ একটা গল্পের বই থেকেই জন্ম নিতে পারে একটি প্রজন্মের কল্পনাশক্তি।

বইয়ের দাম ও প্রাপ্য

আজকাল ভালো মানের বইয়ের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। গ্রন্থাগার ব্যবস্থাও তেমন বিস্তৃত নয়। ফলে বই কিনে বা ধার নিয়ে পড়ার যে সংস্কৃতি ছিল, তা ক্ষয়ে যাচ্ছে।

তবু আশা আছে…

সবকিছু নেতিবাচক হলেও, আশার আলো এখনো পুরো নিভে যায়নি। এখনো কিছু পাঠক আছেন, যারা নিয়ম করে বই পড়েন, বইয়ের মেলা ঘুরে বেড়ান, প্রিয় লেখকের নতুন বইয়ের জন্য অপেক্ষা করেন। কিছু প্রকাশনী, কিছু লাইব্রেরি, কিছু বইপ্রেমী প্ল্যাটফর্ম নতুন করে পাঠাভ্যাস গড়তে উদ্যোগ নিচ্ছে। আমরা যদি চাই, তাহলে আবার ফিরিয়ে আনতে পারি সেই সোনালি যুগ।

পাঠাভ্যাস গড়তে করণীয়

১. প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট বই পড়ার সময় নির্ধারণ করুন।

২. সন্তানদের হাতে মোবাইল নয়, দিন গল্পের বই।

৩. প্রিয় বই নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করুন।

৪. লাইব্রেরি সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনুন পরিবারে ও সমাজে।

৫. সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বই রিভিউ বা বই নিয়ে আলোচনা চালু রাখুন।

শেষ কথায়…

বই শুধু বিনোদন নয়, বই হলো আত্মার খোরাক। বই পড়া মানে নিজের সঙ্গে নিজের যোগাযোগ তৈরি করা। বই আমাদের ভাবতে শেখায়, স্বপ্ন দেখতে শেখায়, মানুষ হতে শেখায়।

আসুন, আমরা আবার বইয়ের কাছে ফিরি। কারণ একটি ভালো বই একটিই জীবন বদলে দিতে পারে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত