চব্বিশের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান দমনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রথম অভিযোগে আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং দ্বিতীয় অভিযোগে ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এ রায় যেমন জাতীয় রাজনীতিতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, তেমনি তা গভীর প্রভাব ফেলেছে তরুণ প্রজন্মের মধ্যেও। দীর্ঘদিনের হতাশা, ক্ষোভ, পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা এবং ন্যায়ের দাবির সঙ্গে মিশে শিক্ষাঙ্গনে গড়ে উঠেছে নতুন এক রাজনৈতিক চেতনা। রাজধানীর সব ক্যাম্পাস থেকে শুরু করে বিভাগীয় শহরের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ—এমনকি ছোট শহরের স্কুলের শিক্ষার্থীরাও সামাজিক ন্যায় এবং রাষ্ট্রিক জবাবদিহির প্রশ্নে আরো সরব হয়ে উঠেছে।
সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো—এ রায় তরুণদের মধ্যে নতুন এক রাজনৈতিক চেতনা, প্রশ্ন করার সাহস এবং ভবিষ্যতের রাষ্ট্র নিয়ে ভাবনার একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে
ফ্যাসিস্ট হাসিনা ১৭ বছর তার অবৈধ শাসনকে জনগণের ওপর জোর করে চাপিয়ে দিয়েছে। তার এই অবৈধ শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কারণে দেশটাকে এই মৃত্যু-উপত্যকায় পরিণত করেছে। হাজার হাজার মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে তার অবৈধ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিল। কিছুদিন আগে দেশের সর্বোচ্চ আদালত তার বিরুদ্ধে আনা সব নৃশংস হত্যাকাণ্ডের রায় দিয়েছে। এই রায়ে নিহতের আত্মা এবং তাদের পরিবার কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবে। রায়টি প্রজেক্টরের মাধ্যমে সরাসরি লাইভে দেশবাসীকে দেখানো হয়েছে। আমি মনে করি, এই রায়টি পৃথিবীর ইতিহাসে এক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এই রায় প্রমাণ করে যে কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়, অপরাধ করে কেউ পার পাবে না, সবাইকে তার জন্য আইনের আওতায় আসতে হবে। তাছাড়া আমরা দেশনায়ক তারেক রহমানের নেতৃত্বে ১৭ বছর দেশে সুশাসন এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছি। এই রায়ের মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হয় যে আমরা দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি। আশা করি, এ সরকার ভারত সরকারের কাছে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার জন্য সব কূটনৈতিক কার্যক্রম শুরু করবে এবং দ্রুত বাস্তবায়ন করবে, যা ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। তাছাড়া এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সবাইকে বিচারের আওতায় এনে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
বাছিরুল ইসলাম খান রানা (গুমফেরত)
ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়
স্বৈরাচারের পক্ষে দাঁড়ানোর নৈতিক সাহস কারো নেই
১৭ নভেম্বরের রায়ে শুধু বিচার হয়নি, বরং স্বৈরাচারের মিনার ধসে পড়ার শব্দ শুনেছে পুরো জাতি। শহীদ পরিবার থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের চোখেমুখে সেই মুক্তির আনন্দ ছিল স্পষ্ট। তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর চিত্র ছিল রাজপথ ও আদালতেরÑযেখানে শেখ হাসিনার সমর্থকদের বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া বা প্রতিবাদ দেখা যায়নি, যা প্রমাণ করে স্বৈরাচারের পক্ষে দাঁড়ানোর নৈতিক সাহস আর কারো অবশিষ্ট নেই।
এখন মূল চ্যালেঞ্জ রায় কার্যকর করা। আন্তর্জাতিক মহল থেকে তেমন জোরালো সহায়তা না মিললেও, ভারতের সঙ্গে বন্দিবিনিময় চুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে তাকে ফিরিয়ে আনা অসম্ভব নয়। ভারত সরকার রায়টি শুধু ‘নোট’ করেছে—এই কূটনৈতিক অবস্থানকে কাজে লাগিয়েই চাপ সৃষ্টি করতে হবে। নির্বাচনের পর নতুন সরকার চাইলে এ প্রক্রিয়া দ্রুত এগিয়ে নিতে পারে।
শুধু শাস্তিই শেষ কথা নয়। জুলাই আন্দোলনে গুম, খুন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনে যারা জড়িত, তাদেরও অবিলম্বে দেশে এনে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। ন্যায়বিচারের এই ধারাবাহিকতা বাংলার মাটিতে নতুন আস্থার ভিত্তি গড়বে এবং সহিংস, স্বৈরশাসনভিত্তিক রাজনীতিকে অতীতের দিকে ঠেলে দেবে। এই বিচারের মাধ্যমেই দেশে নতুন বন্দোবস্তের রাজনীতি তৈরি করতে হবেÑযেন ফ্যাসিবাদ আর কখনোই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে।
উসামা মুবিন জোহার
আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশ (এআইইউবি)

অতি দ্রুত ফাঁসির রায় কার্যকর হোক
১৭ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২০২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদমুক্ত হয়েছে। এই দীর্ঘ রক্তাক্ত সংগ্রামে অনেক বিরোধীদলীয় নেতা, সাধারণ নাগরিক গুম, খুনের শিকার হয়েছেও। সর্বশেষ ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা-শ্রমিক, নারী-শিশুদের আত্মত্যাগ, অন্ধত্ব, পঙ্গুত্ববরণের মাধ্যমে জঘন্যতম ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিদায় হয়। আমাদের কাছে মনে হয়, বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষা এ রায়ে পূরণ হয়েছে। কোনো অপরাধী আইনের ঊর্ধ্বে নয়, তার উদাহরণ এ রায়। ভবিষ্যতে কেউ যেন এমন স্বৈরাচার না হয়ে ওঠে, সেই শিক্ষা দেবে এ রায়। এতে ন্যায়বিচারের প্রতিফলন হয়েছে এবং আমরা আশা করছি, বাকি চলমান মামলাগুলোর রায় দ্রুতই হবে। আমরা চাই অতিদ্রুত এই রায় কার্যকর হোক।
ওয়াসীম আহমেদ অনীক
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়া পর্যন্ত আমাদের লড়াই চলবে
খুনি স্বৈরাচারী হাসিনার ফাঁসির রায়—আমি একজন আহত যোদ্ধা হিসেবে এটিকে শুধু একটি রায় বলে দেখি না; আমার কাছে এটি স্বপ্নের মতো, বহু বছরের রক্ত, ত্যাগ ও অশ্রুর ন্যূনতম প্রতিদান। জুলাইয়ের আন্দোলনের প্রতিটি দিন আমার চোখে আজও ভাসে—ক্যাম্পাসের রাস্তায় রক্তাক্ত ছাত্র, হাঁটু গেড়ে স্লোগান দেওয়া তরুণরা, মিছিল ভেঙে যাওয়ার পরও আবার দাঁড়িয়ে পড়া সহযোদ্ধারা, আর রাতে হাসপাতালে ছুটে বেড়ানো আত্মীয়স্বজনের কান্নার শব্দ। আমরা তো শুধু ন্যায়ের দাবি করেছিলাম, দেশের সম্মান, মানুষের স্বাধীনতা আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তার কথা বলেছিলাম। সেই দাবি রক্ষার পথেই কত সহযোদ্ধা আজ বেঁচে নেই—তাদের নাম কেউ নেয় না, তাদের ছবি নেই কোনো পোস্টারে, কিন্তু তাদের রক্ত আজ ইতিহাসের সাক্ষী।
শহীদ ভাইদের দাফনের সময় আমি তাদের পরিবারের চোখে যে তলানির কান্না দেখেছি, তা আমাকে আজীবনের জন্য বদলে দিয়েছে। আমরা মিছিলে শুধু স্লোগান দিইনি; আমরা বুক চাপড়ে প্রতিজ্ঞা করেছি—এই দেশের মাটিতে অত্যাচার, নিপীড়ন, গুম-খুন, লুটপাট আর স্বৈরশাসনের শেষ চাই। আমরা জানতাম পথটা সহজ হবে না, জানতাম বিপদের মুখোমুখি হতে হবে, তবু দাঁড়িয়েছি—কারণ স্বাধীনতার পরবর্তী প্রজন্মের সঠিক ভবিষ্যতের জন্য দাঁড়ানো ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না।
আজ যখন খুনি স্বৈরাচারী হাসিনার ফাঁসির রায় আমরা শুনেছি, মনে হয়েছে যেন আমাদের সব শহীদের আত্মা আকাশের ওপার থেকে বলছে, ‘লড়াই বৃথা যায়নি।’ এই রায় আমাদের বুক ভরে দিয়েছে, মাথা উঁচু করেছে, বারবার প্রমাণ করেছে যে অন্যায়ের রাজত্ব যত দীর্ঘই হোকÑকোনো দিন স্থায়ী হয় না। কিন্তু রায় ঘোষণাই শেষ লক্ষ্য নয়Ñরায় কার্যকর হওয়া পর্যন্ত আমাদের লড়াই চলবে।
হামদে রাব্বি আকরাম
সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা
হাসিনার ফাঁসি কার্যকর হলে পুরো বাংলায় উচ্ছ্বাস হবে
এক অস্থির সময় পেরিয়ে দেশ যখন নতুন আশার আলো খুঁজছিল, তখন দীর্ঘদিনের নানা অভিযোগ ও বিতর্কে জর্জরিত অধ্যায়ের ইতি টানাকে অনেকেই স্বস্তির নিঃশ্বাস হিসেবে দেখছেন। জনগণের হৃদয়ে যে ক্ষোভ, দুঃখ আর বিভ্রান্তি জমে ছিল, শেখ হাসিনার ফাঁসির রায়ের মাধ্যমে ন্যায়বিচারের অগ্রগতির ইঙ্গিত আমাদের মনে কিছুটা হলেও শান্তি এনে দিয়েছে। অনিশ্চয়তার ঘন কুয়াশা সরে গিয়ে যেন স্বচ্ছতার দরজা একটু খুলে গেছে। মানুষ এখন নতুন অধ্যায় শুরু হওয়ার সম্ভাবনায় আশাবাদী—একটি সমাজ যেখানে দায়িত্ব, জবাবদিহি ও ন্যায় একটি সঠিক পথরেখা তৈরি করবে। পরিবর্তনের এই মুহূর্ত তাই অনেকের কাছে স্বস্তি, অনেকের কাছে নতুন স্বপ্ন দেখার সুযোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে যত দ্রুত শেখ হাসিনার ফাঁসি কার্যকর করা হবে, তত দ্রুত পুরো বাংলা উচ্ছ্বাস হবে।
প্রান্ত হাসান
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

হাসিনা রেজিমের সবাইকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে
দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও আইনি ঘটনাবলি আমি গভীরভাবে লক্ষ করছি। একজন তরুণ ছাত্রনেতা হিসেবে আমার অবস্থান স্পষ্টÑযেকোনো রায় বা সিদ্ধান্তের প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো আইনের শাসন, স্বচ্ছতা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত হওয়া। বিচারব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা রক্ষা করা দেশের গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ফ্যাসিস্ট হাসিনার রায় বাংলাদেশের বিদ্যমান বিচারব্যবস্থার সব প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেই দেওয়া হয়েছে আমি মনে করি। তিনি দেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সূচিত গণতান্ত্রিক এবং অর্থনৈতিক ভিত্তির ধারাকে সুপরিকল্পিতভাবে বিনষ্ট করেছে এবং মানুষের মৌলিক রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে দেশের ট্রিলিয়ন পরিমাণ অর্থ পাচার করে আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে দিয়ে গেছে।
আমি চাই, আগামী দিনেও ফ্যাসিবাদের দোসররা, যারা বিগত হাসিনা রেজিমে রাজনৈতিক হত্যা, গুম এবং জুলাই গণহত্যায় হাসিনার নির্দেশ পালন করে নিরপরাধ রাজনৈতিক কর্মী ও আন্দোলনকারীদের উপর গুলি চালিয়েছে, তাদের বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার ক্ষেত্রেও যেন কোনো ধরনের ছাড় না দেওয়া হয়।
দ্বীন ইসলাম খান
অ্যালামনাই সদস্য, এশিয়ান ডেমোক্রেটিক লিডারস অ্যালায়েন্স
হাসিনা সরকারের আমলে আমার পরিবার বাসায় থাকতে পারেনি
ফ্যাসিস্ট হাসিনার ফাঁসির রায় শুনে আমার মনে হলো—১৭ বছর ধরে চলা গুম, খুন আর জুলুমের হিসাব অবশেষে শুরু হলো। হাসিনা সরকারের আমলে আমার পরিবার—বাবা, ভাই, মাসের পর মাস বাসায় থাকতে পারেনি, কারণ আমরা বিএনপির সঙ্গে সংযুক্ত ছিলাম। আমার বাসায় হামলা ও ভাঙচুর করেছে আওয়ামী লীগের লোকজন। আমার বাবা জামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। তাকে মিথ্যা মামলায় জেল খাটতে হয়েছে। হাসিনা সরকারের সময় অনেক মানুষই ভয়ে দিন কাটাত। কারণ যেকোনো মুহূর্তে দমন-পীড়ন, গ্রেপ্তার বা হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কা ছিল। জুলাই-২০২৪-এ ছাত্রদের ওপর হামলা, সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতন, বিরোধীদের ওপর চাপ আর ভোটবিহীন নির্বাচন—সব মিলিয়ে মানুষ ভেতরে ভেতরে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল।
এই রায়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে খুশি, কারণ সাধারণ মানুষের কষ্ট, ভয় আর অভিযোগ শেষ পর্যন্ত গুরুত্ব পেয়েছে। কেউ এটাকে রাজনীতি বলবে, কেউ প্রতিশোধ বলবে; কিন্তু যারা বছরের পর বছর অন্যায়ের শিকার হয়েছে, তাদের কাছে এটি কিছুটা স্বস্তি।
তর্ক-বিতর্ক থাকবেই, মতভেদও থাকবে। কিন্তু একটি বার্তা পরিষ্কার—ক্ষমতা যত বড়ই হোক, আইনের বাইরে কেউ নয়। ন্যায়বিচার দেরিতে এলেও আসে আর এই রায় সেই বিশ্বাসকে আরো দৃঢ় করেছে।
নুসরাত চৌধুরী জাফরিন
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
ন্যায়বিচারই পারে ভবিষ্যতে ফ্যাসিবাদের পথ রুদ্ধ করতে
একজন তরুণ রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আমি দেখি ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায়, এটি এমন এক প্রজন্মের চিৎকার, যারা অর্ধ দশকেরও বেশি সময় ফ্যাসিবাদের নিষ্ঠুর শাসনে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে এবং ফ্যাসিস্ট হাসিনা যখন আদালত, নির্বাচনব্যবস্থা ও সংবিধানকে অকার্যকর করে ধ্বংস করে দিয়েছিল, সেই কুখ্যাত হাসিনার রায় আমিসহ সবাইকে নিঃসন্দেহে আনন্দিত করেছে।
শেখ হাসিনার শাসনামলে পদ্ধতিগত ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা পায় এবং রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যক্তিকেন্দ্রিক নিয়ন্ত্রণে রূপ নেয় এবং নির্বাচনি অনিয়ম, ধারাবাহিক ও পরিকল্পিত ভোট জালিয়াতি দেশে গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ভেঙে দেয়।
রাষ্ট্রযন্ত্র রাজনৈতিকীকরণের মাধ্যমে বিরোধী মত দমন করে গুম, মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গায়েবি মামলার মাধ্যমে অর্ধ দশক ধরে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করে।
সংবিধানের চার স্তম্ভ নির্বাহী, আইনসভা, বিচার বিভাগ ও গণমাধ্যমÑএসবের ওপর জনগণের আস্থা হারায় এবং ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন গণতন্ত্রকে কাগজে সীমাবদ্ধ করে দেয়।
শাপলা চত্বরে রাষ্ট্রীয় অভিযান এবং মৃত্যুর তথ্য-গোপন তরুণ প্রজন্মের মনে স্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি করে এবং গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার নেতৃত্বাধীন আন্দোলনে শিক্ষার্থী হত্যা জবাবদিহিহীন রাষ্ট্রীয় সহিংসতার চরম উদাহরণ হয়ে ওঠে।
তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব রাষ্ট্রীয় অপরাধের বিচার এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের অবসানই আমার দাবি। কারণ বিচারহীনতা যেকোনো ফ্যাসিবাদ পুনরুজ্জীবিত করে আর ন্যায়বিচারই পারে ভবিষ্যতে ফ্যাসিবাদের পথ রুদ্ধ করতে।
রিহান ফারজানা শারমিন
আইডিয়াল ল কলেজ, ঢাকা
আমি নিজেই গুমের শিকার ছিলাম
ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের পুরোটুকুই ছিল গুম, খুন আর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে ভরা। আমি নিজেই গুমের শিকার ছিলাম, বিরোধী মতকে দমন করতে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শক্তিও সে ব্যবহার করেছে। যার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী বিএনপি, ছাত্রদলসহ অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিগুলো। আমরা প্রতিশোধপরায়ণ রাজনীতিতে বিশ্বাসী না। জুলাইয়ের গণআন্দোলনে হাসিনার বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড ও তার পুরো শাসনামলের অন্যায়-অপকর্মের বিচার স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় আইন-আদালতের মাধ্যমে হবেÑএটাই আমাদের বিশ্বাস। তিনি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একজন হত্যাকারী। অতএব তার বিরুদ্ধে দেওয়া আদালতের রায় কার্যকরে রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখবেÑএটাই প্রত্যাশা করি।
আব্দুল্লাহ আল নোমান
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
দ্রুত দেশে এনে ফাঁসির কার্যকর করা দরকার
শেখ হাসিনা দেশের শিশু-ছাত্র-যুবক-নারী-জনতাকে নির্বিচারে হত্যা করায় মানবতাবিরোধী অপরাধে যেই সাজা ঘোষণা করা হয়েছে, তা তার ঘৃণিত, নৃশংস হত্যাকাণ্ডের তুলনায় কম হয়ে যায়, যদিও ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ডই আইনে সর্বোচ্চ সাজা। আমি মনে করি, তাকে অতিদ্রুত বাংলাদেশে ফেরত এনে ফাঁসির চেয়ে আরো নৃশংস বীভৎস কায়দায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা দরকার, যাতে এই দেশে ভবিষ্যতে আর কোনো শাসক, রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রীয় কোনো বাহিনী দেশের জনগণ বা কাউকে বিনাবিচারে হত্যা করার স্বপ্নও না দেখে।
মমিনুল ইসলাম জিসান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদবিরোধী পর্বের সমাপ্তি
একজন ছাত্রনেতা ও ‘জুলাইযোদ্ধা’ হিসেবে শেখ হাসিনার ফাঁসির রায় শুধু বহু প্রতীক্ষিত ন্যায়বিচারের প্রথম ধাপ, যার পূর্ণ বাস্তবায়ন প্রত্যাশা করে বাংলাদেশপন্থি প্রতিটি নাগরিক।
২০০৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পর ক্ষমতায় আসার পর থেকে অবৈধ সংবিধান সংশোধন, বিডিআর বিদ্রোহের প্রেক্ষাপট, হেফাজতকর্মীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, গুম-খুন, দুর্নীতি এবং ভোটবিহীন নির্বাচনের মতো অভিযোগগুলোর বিচারিক অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার ফিরিস্তি জাতির সামনে উন্মোচন করতে হবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনা বাস্তবায়ন মানে—শত শত পরিবারের স্বজনহারা হওয়ার বিচার নিশ্চিত করা।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনায় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ধারাবাহিকভাবে রাজপথে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয় ছিল। চিপাগলির ফাইটিং থেকে শুরু করে প্রেস ক্লাব, শাহবাগ বা শহীদ মিনার—সব ক্ষেত্রেই সংগঠনের কর্মীরা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। এই বহুমুখী অংশগ্রহণের সম্মিলিত শক্তিতেই স্বৈরাচারী শাসনের পতন ঘটে। এ বিজয় ছিল সমাজের প্রতিটি শ্রেণি—ধনী-গরিব, ছাত্র-শ্রমজীবী, নারী-পুরুষ, কিশোর-বৃদ্ধ—সব জনগোষ্ঠীর। আজকের রায় সেই বিজয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক, যার বাস্তবায়ন আমাদের গণতান্ত্রিক যাত্রাকে চূড়ান্তভাবে পথ দেখাবে।
এই রায় সব রাজনৈতিক দলকে একটি রেডলাইন অঙ্কন করে দিয়েছে যে, এদেশে আমরা আর কোনো শেখ হাসিনা চাই না, এদেশে আমরা আর কোনো আওয়ামী লীগ চাই না। কেউ তা হতে চাইলে তার স্থান বাংলাদেশে হবে না, তাদের জীবন হবে আওয়ামী লীগের মতো আশ্রিত জীবন।
বিএম কাওসার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এই রায় নিঃসন্দেহে ন্যায়বিচারের প্রতীক
সম্প্রতি বাংলাদেশের বিশেষ আদালত, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল শেখ হাসিনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড বা ফাঁসির আদেশ দিয়েছে। আদালতে যেসব অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে গত ১৪ বছরে গুম, গুলিতে হত্যা, নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, রাজনৈতিক দমননীতি, স্বাধীনচিন্তা ও মতপ্রকাশ দমনে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার এবং বিশেষত গত জুলাই বিপ্লবে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞে নির্দেশ দেওয়া, উসকানি দেওয়া বা হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধে ব্যর্থতার দায়। ইতিহাসের সবচেয়ে নির্মম ঘটনাগুলোর একটি—জুলাই বিপ্লবে ছাত্র ও শিশু হত্যার মতো জঘন্য মানবতাবিরোধী অপরাধও এই রায়ের ভিত্তিতে গুরুত্ব পেয়েছে।
যদি আমরা ঘটনাগুলো বিবেচনা করি, তাহলে এই রায় নিঃসন্দেহে ন্যায়বিচারের প্রতীক। বহু বছর ধরে যেসব পরিবার ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত ছিল, কিংবা যারা নিজেদের চোখের সামনে সহযোদ্ধা, সন্তান, ভাই বা বন্ধুকে হারিয়েছে—তাদের কাছে এই রায় যেন বহু প্রতীক্ষিত স্বস্তির বার্তা।
এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো যত দ্রুত সম্ভব এই রায় কার্যকর করা। কারণ এই রায় শুধু একটি ব্যক্তির শাস্তি নয়—এটি ভবিষ্যৎ শাসকদের জন্য সতর্কবার্তাও বয়ে আনে, যাতে আর কোনো শাসক কখনো তার নিজের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার দুঃসাহস না দেখায়।
জাহিদুল ইসলাম শিহাব
ঢাকা কলেজ

হাসিনার শাসনামলের পুরোটা ছিল নিপীড়নের
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো উত্থাপিত হয়েছে, সেগুলো আমরা শুধু রাজনৈতিক সহিংসতা বা বিচ্ছিন্ন নির্যাতন হিসেবে দেখি না, এগুলো মানবতাবিরোধী অপরাধের আওতাভুক্ত করেই বিবেচনা করছি। তার শাসনামলের পুরো সময় গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর নিপীড়নÑএসব ছিল প্রায় নিয়মিত ঘটনা। বিশেষ করে জামায়াত-বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক দমন-পীড়ন, গায়েবি মামলাÑএমনকি একসময় জামায়াতের কর্মীদের ওপরও পরিকল্পিতভাবে হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ উঠে আসে।
জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে অভাবনীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। কোনো ধরনের মারণাস্ত্র ছাড়াই সাধারণ মানুষ যখন নৈতিক শক্তিকে পুঁজি করে রাস্তায় নেমেছিল, তখন তাদের ওপর যে ভয়াবহ দমন-পীড়ন চালানো হয়েছে—তা বিশ্ব ইতিহাসেও বিরল উদাহরণ। সময়ই বলে দেবে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করা সম্ভব হবে কি না। তবে সেটি করা না গেলেও এই রায়ের মাধ্যমে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখানেই কার্যত সমাপ্তির পথে। জনগণের ক্ষোভ, বিচারপ্রক্রিয়ার অগ্রগতি এবং ইতিহাসের বিচার সব মিলিয়ে তার অধ্যায়ের শেষের ইঙ্গিত ইতোমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
সুমাইয়া আফরিন সেবা
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
এই রায় বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি মাইলফলক
জুলাই গণ অভ্যুত্থান এর পর আমাদের অন্যতম দাবিই ছিলো শেখ হাসিনার বিচার। আমার কাছে এই রায় বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি মাইলফলক। আমি বিশ্বাস করি, এর মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথে দেশ এগোতে পারে যদি সময়মতো রায়ের বাস্তবায়ন হয়।
কারণ এই রায় শুধু অতীতের অপরাধের শাস্তি নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য একটি শিক্ষা যে একসময়ের ক্ষমতাশালী নেতারাও আইনের বাইরে নয় কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে হবে। অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের অন্যতম সাফল্য।
এদিকে আবার আমরা ভারতের গণমাধ্যমসহ আন্তর্জাতিক মহলে আলোচনার যে ঝড় দেখেছি এতে আঁচ করা যায় আঞ্চলিক রাজনীতিতে এর ভালো প্রভাব পড়েছে।
তাসিন খান
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

