দেশে ক্যানসার মহামারির পূর্বাভাস!

ডা. মো. তৌছিফুর রহমান
প্রকাশ : ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১১: ৫৮

বর্তমানে বিশ্বে ক্যানসার রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। গ্লোবোকানের তথ্যমতে, ২০২৪ সালে বিশ্বে প্রায় দুই কোটি মানুষ ক্যানসার-আক্রান্ত হয়েছে এবং এর মধ্যে প্রায় এক কোটি মানুষই মৃত্যুবরণ করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৫০ সাল নাগাদ ক্যানসার-আক্রান্ত রোগীর হার প্রায় ৩ দশমিক ৫ কোটিতে দাঁড়াবে। বাংলাদেশেও অতীতের তুলনায় ক্যানসারের রোগীর সংখ্যা বাড়ছেই। নিজস্ব কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও আন্তর্জাতিক রিপোর্টের আলোকে ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে প্রায় ১৩-১৫ লাখ ক্যানসারের রোগী আছে, যার মধ্যে প্রতি বছর প্রায় দুই লাখ মানুষ নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে। অর্থাৎ ভবিষ্যতে বাংলাদেশে ক্যানসার মহামারি আকারে আসার পূর্বাভাস দিচ্ছে। প্রধান প্রধান ক্যানসারের মধ্যে ফুসফুস, স্তন, ওরাল ক্যাভিটি, অন্ননালি ও পাকস্থলীর ক্যানসার অন্যতম। দেশে ক্যানসারের রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার বেশ কিছু কারণ তুলে ধরা হলো।

বিজ্ঞাপন

তামাকজাত দ্রব্য সেবন: বিশ্বব্যাপী ক্যানসার বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় কারণ ধূমপান। সিগারেট স্মোকিং ছাড়াও তামাকপাতা, সেকেন্ড হ্যান্ড স্মোকিং প্রভৃতি নানা ধরনের ক্যানসারের জন্য দায়ী ধূমপানের মধ্যে সাত হাজারের অধিক রাসায়নিক দ্রব্য আছে, যার মধ্যে ৭০টারও বেশি কারসিনোজেন আছে। এছাড়া প্যাসিভ স্মোকিংয়ের মাধ্যমেও অনেকে ক্যানসারের উচ্চ ঝুঁকিতে আছেন। বিশেষ করে যাদের বন্ধুবান্ধব ধূমপায়ী, তাদের নির্দিষ্ট খানে ধূমপানে বাধ্য করতে হবে। তাছাড়া পরিবারের নারী ও শিশুর সামনে ধূমপান করা যাবে না। ধূমপানের মাধ্যমে ফুসফুস, মুখগহ্বর ও মূত্রথলিতে ক্যানসারের প্রবণতা বেড়ে যায়।

সংক্রামক জীবাণু: কিছু ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। যেমন হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস জরায়ুমুখ ক্যানসার, হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি পাকস্থলীর ক্যানসার এবং হেপাটাইটিস বি ভাইরাস লিভার ক্যানসারের অন্যতম কারণ।

অতিবেগুনি রশ্মি: অতিরিক্ত মাত্রায় সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মিতে উন্মুক্ত হলে স্কিন ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এজন্য যারা আউটডোর অ্যাক্টিভিটিস করেন বা দীর্ঘক্ষণ যাদের রোদের মধ্যে থাকতে হয়, তারা পেশা পরিবর্তন করতে না পারলে সানস্ক্রিন ব্যবহার করবেন।

খাদ্যাভ্যাস ও শারীরিক পরিশ্রম: স্বাস্থ্যকর খাবার, যেমন ফলমূল, শাকসবজি ও আঁশযুক্ত খাবার কম খাওয়া এবং কম শারীরিক পরিশ্রম বিভিন্ন ক্যানসারের জন্য দায়ী। যেমন স্তন ও কোলন ক্যানসার। অন্যদিকে টিন ও প্যাকেটজাত খাবার এবং অতিরিক্ত তেলমসলা ও চর্বিজাতীয় খাবার ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়।

অতিরিক্ত মাত্রায় মদ্যপান: যকৃৎ, মুখ, গলা ও স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়।

পরিবেশ দূষণ: অনেক ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য, দূষিত বায়ু, ভারী ধাতু, কারখানার ধোঁয়া ও রেডিয়েশন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। যেমন অ্যাসবেস্টস ওরে ডন ফুসফুস ক্যানসারের ঝুঁকি অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, বেরিলিয়াম, সিলিকা ইত্যাদি ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়।

পেশাগত কারণ: কয়লা খনি, ঢালাই, লোহা, সিমেন্ট কারখানা, জাহাজ ভাঙা শিল্প প্রভৃতি ক্ষেত্রের শ্রমিকেরা বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার, বিশেষত ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত হন। তাছাড়া যারা কাপড়ের ডাই বা রং নিয়ে কাজ করেন, তাদের মূত্রথলির ক্যানসারের প্রবণতা বেশি থাকে।

জিনগত ও পারিবারিক ইতিহাস: অনেক সময় স্তন, কোলন, ডিম্বাশয় ও প্রোস্টেট ক্যানসারের ক্ষেত্রে পারিবারিক ও জিনগত ব্যাপার থাকতে পারে।

বয়স: বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অধিকাংশ ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়তে থাকে। আমাদের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন ক্যানসারের প্রবণতা বেড়ে গেছে।

হরমোনাল কারণ: HRT (Hormone Reglement Therapy) ও জন্মবিরতিকরণ পিল ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। যেমন স্তন ক্যানসার। উন্নত বিশ্বে পিল খাওয়ার প্রবণতা কমে গেলেও আমাদের দেশে রয়ে গেছে।

দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা: যেসব মানুষ HIV/AIDS-এ আক্রান্ত বা যারা দীর্ঘদিন ধরে Immunosuppressive ওষুধ খাচ্ছেন, তাদেরও ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

বাল্যবিয়ে: জরায়ুমুখ ক্যানসার হয় HPV নামক এক ধরনের ভাইরাসের ইনফেকশনের কারণে। অপরিণত বয়সে যৌনমিলন করার কারণে এই ভাইরাস নারীর জরায়ুতে বাসা বাঁধে এবং একসময় ক্যানসার তৈরি করে। এরপর তা প্রিম্যালিগনেন্ট অবস্থায় দীর্ঘসময় অতিবাহিত করে, যা প্রায় ১৫ বছর। VIA টেস্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রশিক্ষিত সেবিকা দ্বারা করা হয়। এর মাধ্যমে ক্যানসার-পূর্ববর্তী অবস্থা শনাক্ত ও প্রতিরোধ করা যায়।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বাল্যবিয়ে রোধ করে HPV Vaccine দিয়ে ও স্ক্রিনিং করে এই ক্যানসার প্রতিরোধ করা যায়, যা উন্নত বিশ্বে এরই মধ্যে সম্ভব হয়েছে। WHO বলছে, জরায়ুমুখ ক্যানসারে কোনো নারীরই মৃত্যু কাম্য নয়। এখানে আমাদের দেশে ক্যানসারে তৃতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যুর কারণ এই জরায়ুমুখ ক্যানসার।

দীর্ঘমেয়াদি কাশির রোগ: ধূমপান, বায়ুদূষণ, যক্ষ্মা, অ্যাজমা প্রভৃতি কারণে আমাদের দেশের অনেক মানুষেরই দীর্ঘস্থায়ী কাশির রোগ আছে। এ কাশি থেকে ফুসফুস ক্যানসারের প্রবণতা বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে যদি কিছু পরিবর্তন হয়, যেমন ওজন অতিরিক্ত হ্রাস, কাশির সঙ্গে স্বর দেবে যাওয়া, কফের সঙ্গে রক্ত যাওয়া, বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট ও জ্বর এলে আমাদের পরীক্ষা করে দেখতে হবে।

ভেজাল খাদ্য গ্রহণ: বর্তমানে খাদ্যে ভেজাল মহামারির মতো রূপ লাভ করেছে। ভেজাল খাদ্যে বিভিন্ন রকম কারসিনোজেন থাকে, যা ক্যানসারের জন্য দায়ী। এছাড়া প্রাণিজ সম্পদ প্রতিপালনে ও গরু মোটাতাজাকরণে কেমিক্যাল দ্রব্যসম্পন্ন ফিড খাওয়ানো হয়, যেগুলোর মধ্যে মুরগি, মাছ চাষ ও ফসলি জমিতে রাসায়নিক সারের ব্যাপক ব্যবহার অন্যতম।

দীর্ঘস্থায়ী গ্যাসের সমস্যা: অসচেতনতা ও খাদ্যাভ্যাসের কারণে আমাদের দেশের মানুষ কার্বহাইড্রেট, যেমন ভাত, মাটির নিচের খাবার যেমন কচু ও আলু এবং তেল, মসলা ও চর্বিজাতীয় খাবার বেশিই খায়। তাছাড়া অনিয়মিত সময়ে খাওয়ার কারণে পেটব্যথা, জ্বালাপোড়া বা গ্যাসের সমস্যা বেশি দেখা দেয়। উপরন্তু Helicobacter pylori ব্যাকটেরিয়াঘটিত কারণে পেপটিক আলসার ডিজিজ হয়, যা থেকে পাকস্থলি ক্যানসার হতে পারে। শুনলে আতঙ্কিত হতে হয় যে, পাকস্থলী ক্যানসারের প্রায় ৬০ ভাগই এই H. pylori ব্যাকটেরিয়াঘটিত পেপটিক আলসার ডিজিজ থেকে হয়ে থাকে।

স্ক্রিনিং প্রোগ্রামে সচেতনতার অভাব: অধিকাংশ ক্যানসারই স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে প্রতিরোধ করা যায়। যেমন জরায়ুমুখ ক্যানসার, কোলোরেক্টাম, স্তন প্রভৃতি। উপজেলা হাসপাতালগুলোয় স্তন ও জরায়ুমুখ ক্যানসার স্ক্রিনিং কর্নার আছে, যেখানে আমরা স্ক্রিনিং করতে পারি প্রায় বিনা মূল্যে।

হেপাটাইটিস বি ভাইরাস সংক্রমণ: নানা কারণে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের সংক্রমণ বাংলাদেশিদের মধ্যে বেশি। যেমন পানিদূষণ, খাদ্যদূষণ, অনিরাপদ ব্লাড ট্রান্সফিউশন, অনিরাপদ যৌনসম্পর্ক, টিকাদানের অপ্রতুলতা, ইনজেকশনের মাধ্যমে নেশা করা প্রভৃতি কারণে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে গেছে। পরিণতিতে লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও বেড়ে গেছে।

লেখক : মেডিকেল ও রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট

কনসালট্যান্ট, টিএমএসএস ক্যানসার সেন্টার, বগুড়া

বিষয়:

ক্যানসার
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত