‘প্রথম ক্যানোলা করার সময় বাচ্চার কান্না দেখে আমিও কাঁদি’

এন আই মানিক
প্রকাশ : ০৬ আগস্ট ২০২৫, ১০: ৫৭

জীবন সাজাতে কে কোন পেশা বেছে নেবেন, তা নির্ধারণে আমাদের জীবনে ছোট কিছু ঘটনার ভূমিকা থাকে। গাজীপুরের মেয়ে চামেলি রোজারিওর জীবনেও ঘটে এমন একটি ঘটনা। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় পেটব্যথা নিয়ে ভর্তি হন ন্যাশনাল হসপিটালে। যেখানে তার বড় চাচি সিনিয়র স্টাফ নার্স হিসেবে কর্মরত ছিলেন। চামেলির সামনেই তার চাচি বেশ কিছু মানুষকে সেবা দিচ্ছেন দেখে পেশাটা ভালো লেগে যায়। তিনি বলেন, ‘বড় চাচির অনুপ্রেরণাতেই আমি নার্সিং পেশায় আসি। ওই সময় মনে হয়েছিল, এ পেশায় এলেই মানুষের কাছাকাছি যেতে পারব। জনসেবা করতে পারব।’

বিজ্ঞাপন

সেই থেকে চামেলি রোজারিওর মাথায় নার্সিং পেশায় আসার ইচ্ছা জাগে। জার্নিটা শুরু হয় ২০০২ সালে এইচএসসি পাস করার পর। মায়ের ইচ্ছা আর বাবার প্রবল অনিচ্ছায় কুমুদিনী নার্সিং ইনস্টিটিউটে ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হন। ২০০৭ সালে ডিপ্লোমা কোর্সটি কমপ্লিট করে বের হওয়ার পর প্রথম চাকরি হয় ধানমন্ডির পপুলার স্পেশালাইজড হসপিটালে। প্রথম দিনের কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রথম দিন আমার ডিউটি ছিল পোস্ট অপারেটিভে। তখন একজন রোগী অপারেশনের পর ব্যথায় খুব কান্না করছিল। বিষয়টি ডাক্তারকে জানালে তিনি কিছু মেডিসিন দিতে বলেন, আমি মেডিসিনগুলো দেওয়ার পরই রোগীর ব্যথা কমে যায়, কান্নাও থেমে যায়। তখন অন্যরকম এক ভালো লাগা কাজ করল, আমার সেবায় একজন মানুষের উপকার হয়েছে এই ভেবে।’

সেই থেকে এ পেশায় যাত্রা শুরু হওয়া চামেলির অভিজ্ঞতার ভান্ডারে ১৮ বছর পূর্ণ হলো। এর মধ্যে গত ১৫ বছর বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। বর্তমানে সেখানে তিনি নার্সিং সুপারভাইজার হিসেবে কর্মরত। দীর্ঘ সময় কাজের অভিজ্ঞতায় এমন কোনো ঘটনা আছে কি না, যা আপনাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে চামেলি রোজারিও বলেন, ‘অবশ্যই। অনেক ঘটনা আছে। তবে হার্ট টাচিং একটি ঘটনা বলছি, এখানে ২০১০ সালে জয়েন করার পর প্রথম দিন আমাকে দেওয়া হয় নিউট্রিশিয়ান ওয়ার্ডে। ওই ওয়ার্ডের ইনচার্জ দিদি বললেন ক্যানোলা করার জন্য। ক্যানোলা করার সময় বাচ্চা খুব কান্না করছিল আর এই বাচ্চার কান্না দেখে আমিও কান্না করছিলাম। সেই সঙ্গে বাচ্চার বাবা-মাও কাঁদছিলেন। সব মিলিয়ে তখন একটি হৃদয়বিদারক ঘটনার সৃষ্টি হয়। ওই অভিজ্ঞতাটা আমি কখনো ভুলতে পারব না। আসলে একটা বাচ্চা অসুস্থ হলে মা-বাবার মনে যে কেমন উপলব্ধি, সেই হৃদয়বিদারক ঘটনা আমার মনে এখনো নাড়া দেয়। ওই কারণে আমার ছেলে হওয়ার পর আমি বাচ্চাদের ক্যানোলা করিনি প্রায় এক মাস, এরপর অবশ্য করতাম।’

শিশু হাসপাতালের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সেবা দিচ্ছেন চামেলি। যেখানে কোমলমতি শিশুরা অসুস্থ হলেই মা-বাবারা ছুটে আসেন। সে ক্ষেত্রে নার্স হিসেবে রোগীর সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাবা-মায়েরা এখানে নিয়ে আসেন অসুস্থ বাচ্চাকে। তখন তাদের মনের অবস্থা ভালো থাকে না, প্রথমে এসে দেখা যায় চিকিৎসা দিতে একটু দেরি হচ্ছে বা আমাদের ঢিলে হচ্ছে। সেসব কারণে তারা একটু অ্যাগ্রেসিভ থাকে। পরে দেখা যায়, আমরা যখন তাদের সঙ্গে কথা বলি, কাউন্সেলিং দিই, বিশেষ করে আমি সবসময় একটু সফট মাইন্ডে কথা বলি। তখন দেখা যায়, তারা আমার ব্যবহার দেখে মুগ্ধ হয়ে আমাকে খোঁজেন। অন্য সিস্টারদের কাছে যেতে চান না, আমার কথা সবার কাছে জিজ্ঞেস করেন। দারুণ একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। এ ছাড়া বাচ্চাদের প্রতি আমার একটা সফট কর্নার কাজ করে। মাঝে মাঝে তাদের কোলে তুলে নিই। তখন বাবা-মা খুব খুশি হন।’

সাধারণত যারা নার্সিং পেশায় কাজ করেন, তাদের দিন-রাত ফ্যামিলি থেকে দূরে থাকতে হয়। সে ক্ষেত্রে নার্সিং পেশায় পরিবার ও ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখাটা কতটা কঠিন? আপনি কীভাবে সামলান? এমন প্রশ্নের উত্তরে চামেলি রোজারিও খুব আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘আসলে আমাদের এই কষ্টগুলোর কথা কেউ কখনো জানতে চাননি। এগুলো কোথাও বলার মতো সুযোগও পাইনি। বিশেষ করে আমরা যারা মা, তাদের জন্য এটি অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। ফ্যামিলি ও হাসপাতাল দুটোই আমাদের সামলাতে হয়। হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরলে রেস্ট না নিয়ে ছেলেমেয়েদের সময় দিই। আবার দেখা গেছে, রাতে ছয় ঘণ্টা ঘুমানোর বদলে তিন ঘণ্টা ঘুম হলো। বাকি তিন ঘণ্টা বাচ্চাদের সময় দিই। আমি যখন নাইট ডিউটিতে আসি, তখন আমার স্বামীর অনেক সাপোর্ট পাই। সে সারারাত জেগে বাচ্চাদের পাহারা দেয়। দিনের বেলা গিয়ে আমি পাহারা দিই। মাঝেমধ্যে গ্রাম থেকে শ্বশুর-শাশুড়ি আসেন, তাদেরও সাপোর্ট পাই।’

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত