ই-মেইলের জন্মকথা

জুবাইর আল হাদী
প্রকাশ : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৫: ৫২

আগেকার দিনে যখন কোনো ব্যক্তিকে কোনো তথ্য দিতে হতো, তখন চিঠির মাধ্যমে পৌঁছানোই ছিল একমাত্র অবলম্বন, যার উত্তর পেতে অপেক্ষা করতে হতো অনেক দিন। কিন্তু বর্তমান সময়ে ইন্টারনেটের আবির্ভাবের পর থেকে তা হয় না, এখন সবকিছু বদলে গেছে। যেকোনো তথ্য সহজেই যেকোনো ব্যক্তির কাছে অল্প সময়ের মধ্যে পৌঁছে দেওয়া যায়।

আগে যখন কম্পিউটার ও স্মার্টফোনের আবিষ্কার হয়নি, তখন ‘ই-মেইল’ শব্দটির কথা কেউ শোনেনি। তবে এই যুগে এসে ‘ই-মেইল’ শব্দ শোনা তো দূরে থাক, ই-মেইলে কারো আইডি নেই, এমন লোক পাওয়াই দুষ্কর। যে ই-মেইল আমাদের যোগাযোগ বা চিঠি আদান-প্রদান এতটা সহজ করে দিল, চলুন জেনে আসি এই ই-মেইলের ইতিহাস।

বিজ্ঞাপন

ই-মেইলের কথা বলতে গেলে প্রথমেই উঠে আসে মার্কিন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার রেমন্ড স্যামুয়েল টমলিনসনের নাম। তিনি একাধারে প্রযুক্তিবিদ আবার শিক্ষকও ছিলেন। কিছুদিন তিনি ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (MIT) অধ্যাপনা করেছেন। ১৯৭১ সালে তার হাত ধরেই জন্ম নেয় ইলেকট্রনিক বার্তা আদান-প্রদানের এক নতুন পদ্ধতি। যেটিকে আমরা আজ ‘ই-মেইল’ নামে জানি। তাই স্বাভাবিকভাবেই তিনি পরিচিত হয়েছেন ‘ই-মেইলের জনক’ হিসেবে। তবে টমলিনসনের সফলতার আগেই ই-মেইল পাঠানোর কিছু ব্যর্থ প্রচেষ্টা হয়েছিল, সেদিকেও নজর দেওয়া দরকার।

সময়টা ১৯৬৯। ইন্টারনেট তখনো পৃথিবীর মানুষের কাছে অচেনা এক ধারণা। তবুও সে সময় এক কম্পিউটার থেকে পাশের আরেক কম্পিউটারে একটি বার্তা পাঠানোর চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু সেই বার্তাটি পৌঁছাতে লেগেছিল এক ঘণ্টারও বেশি সময়! তাও পুরো বার্তা নয়, মাত্র দুটি অক্ষর ‘L’ এবং ‘O’ পৌঁছেছিল অপর প্রান্তে। বার্তা পাঠানোর মাঝপথেই সিস্টেম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যদিও ই-মেইল তখনো সফল হয়নি, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তরের পৃষ্ঠপোষকতায় একটি বিশেষ নেটওয়ার্ক চালু হয়েছিল, যার নাম ছিল আরপানেট (ARPANET)। চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসকে যুক্ত করে গড়ে উঠেছিল এই নেটওয়ার্ক; আর সেখান থেকেই আধুনিক ইন্টারনেট ও ই-মেইলের ভিত্তি স্থাপিত হয়।

email

আরপানেটের অন্যতম সক্রিয় গবেষণা কেন্দ্র ছিল ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলেস। সেখানেই গবেষক লিওনার্দো ক্লেইনরক ও তার সহকর্মী চার্লি ক্লাইন প্রথম ই-মেইল পাঠানোর প্রয়াস নেন। যদিও তারা পুরোপুরি সফল হতে পারেননি, তবুও ইতিহাসে তাদের অবদান অমলিন। আর মাত্র দুই বছর পরেই ১৯৭১ সালে টমলিনসন আরপানেট ব্যবস্থার সঙ্গে দুটি নতুন প্রোগ্রাম যুক্ত করে ই-মেইল প্রযুক্তিকে পূর্ণতা দেন। আর প্রথমবারের চেষ্টাতেই তিনি সফল হন।

টমলিনসনের অবদান শুধু ই-মেইলেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এর আগেই ১৯৬৭ সালে তিনি বিবিএন (BBN) টেকনোলজি কোম্পানিতে কাজ করার সময় তৈরি করেছিলেন টেনেক্স অপারেটিং সিস্টেম। এই সিস্টেমের মধ্যেই যুক্ত ছিল আরপানেটের নেটওয়ার্ক কন্ট্রোল প্রোটোকল। এমনকি আরপানেটের প্রথম ফাইল ট্রান্সফার প্রোগ্রামটিও তার হাতেই লেখা। অর্থাৎ, আধুনিক ডিজিটাল যোগাযোগব্যবস্থার ভিত গড়ার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অন্যতম পথিকৃৎ।

প্রথম দিকে ই-মেইল কেবল বার্তা লেখা ও পড়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল; কিন্তু প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এতে ছবি, নথি ও ভিডিও যোগ করার সুবিধাও যুক্ত হয়। ১৯৭৪ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা পৌঁছে দিতে ই-মেইল ব্যবহার শুরু করে।

আবার ১৯৭২ সালে টমলিনসন প্রথমবারের মতো ‘@’ চিহ্নটি ই-মেইল ঠিকানায় অন্তর্ভুক্ত করেন। এর মাধ্যমেই চালু হয় আজকের পরিচিত ফরম্যাট—‘ব্যবহারকারীর নাম @ হোস্ট’। ধীরে ধীরে এই ব্যবস্থা সাধারণ মানুষের কাছেও পৌঁছে যায় এবং রূপ নেয় বিশ্বব্যাপী যোগাযোগের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হিসেবে।

অদ্ভুত এক ঘটনা হলো, মৃত্যুর অল্প কিছুদিন আগে ২০১৬ সালের মার্চ মাসে সংবাদমাধ্যম টমলিনসনকে জিজ্ঞেস করেছিল, তার পাঠানো প্রথম ই-মেইলে তিনি কী লিখেছিলেন এবং কাকে পাঠিয়েছিলেন। বিস্ময়করভাবে টমলিনসন জবাব দিয়েছিলেন, ‘সেটা আমার আর মনে নেই।’

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত