রাজমিস্ত্রি সাদ্দাম ফ্রিল্যান্সিং করে কিনলেন জমি

মুহাম্মদ শফিকুর রহমান
প্রকাশ : ১৭ মার্চ ২০২৫, ১২: ৩২

যাদের কাজের প্রতি প্রবল ইচ্ছা, আন্তরিকতা আর পরিশ্রম করার মানসিকতা থাকে, তারা একদিন না একদিন সফলতার মুখ দেখতে পানই। নড়াইল উপশহরের গারুচিরা বাজারের পাশে দলজিতপুর গ্রামের সাদ্দাম হোসেন এমনই একজন মানুষ। তিনি নিজের প্রবল ইচ্ছা ও পরিশ্রম দিয়ে ফ্রিল্যান্সিংয়ে সফল হয়েছেন। মাসে তার গড় আয় দেড় থেকেই দুই লাখ টাকা। কখনো কখনো এই আয় আড়াই লাখ টাকাও ছাড়িয়ে যায়। এক মাসে তিনি সর্বোচ্চ ১৮ লাখ টাকা আয় করেছেন। ফেসবুকে একটি ভিডিওর মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৯০০ ডলার আয় করেছেন। পাঁচশর বেশি মানুষ সম্পূর্ণ ফ্রি অনলাইনে সাদ্দামের কাছে ফ্রিল্যান্সিং শিখেছেন। সাদ্দামের ফ্রিল্যান্সিংয়ে সফলতার গল্প লিখেছেন মুহাম্মদ শফিকুর রহমান

সাদ্দাম হোসেনের বাড়ি নড়াইল সদর উপজেলার উপশহরে। চার ভাই-বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। বাবা এম আবদুস সাত্তার চিংড়ির ব্যবসা করতেন। সাত্তার ও সায়রা বেগম দম্পতির ছোট ছেলে সাদ্দাম হোসেন। পরিবারে তার বড় ভাই ও ছোট দুই বোন রয়েছে। বছর তিনেক আগে থেকে তিনি নড়াইল উপশহর গারুচিরা বাজারের পাশে দলজিতপুর গ্রামে সপরিবারে বসবাস করছেন।

বিজ্ঞাপন

অভাবের সংসারে সচ্ছলতা আনতে গিয়ে সাদ্দামের সেভাবে পড়াশোনা করা হয়ে ওঠেনি। জীবন-জীবিকার তাগিদে কখনো বিক্রয় প্রতিনিধি, কখনোবা রাজমিস্ত্রির কাজ করেছেন। ইট, বালু ও সিমেন্টের সঙ্গে জীবনের প্রায় সাতটি বছর কেটে যায় তার। এরই মধ্যে এফএম রেডিও’র শোতে জানতে পারেন এমন এক ছেলের সফলতার গল্প। তিনি কিনা মাত্র আট বছর বয়সে ফ্রিল্যান্সিং করে লাখ টাকা আয় করেন। অনুপ্রেরণাময় জীবন-সংগ্রামের গল্পটি সাদ্দামের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তিনি গুগল ও ইউটিউব থেকে ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন। ইংরেজি শেখার জন্য নানা কোর্স করে নিজেকে যোগ্য করে তোলেন। আদতে নিজ উদ্যোগেই তিনি এগিয়ে গেছেন। ফ্রিল্যান্সিংয়ের কোনো কোর্স কোথাও করেননি। তবে জামাল হোসেন, ফারুক ও শামিমের ভিডিওগুলো থেকে তিনি অনেক কিছু শিখতে পারেন। রাজমিস্ত্রির কাজের পাশাপাশি অনলাইনে আয়ের তার এই প্রচেষ্টা চলমান থাকে।

ফ্রিল্যান্সিংয়ে অনেক রকম কাজের মধ্যে ডিজিটাল মার্কেটিং ও ওয়েব ডিজাইনের কাজ করেন সাদ্দাম। ২০১৩ সালে তিনি ইউটিউবের ব্যানার ডিজাইন করে পাঁচ ডলার আয় করেন। এটাই তার ফ্রিল্যান্সিংয়ে প্রথম আয়। ২০১৬ থেকে ২০২৫ সাল অবধি তার সর্বমোট আয় কোটি টাকা পেরিয়ে গেছে বলে জানান। অনলাইনে কাজের আয়ের টাকায় নড়াইল উপশহর-সংলগ্ন দলজিতপুর মৌজায় পাঁচ শতক জমির ওপর একতলা পাকাবাড়ি, সাড়ে তিন শতক জমিতে মার্কেটসহ ১২৬ শতক চাষাবাদের জমি কিনেছেন সাদ্দাম হোসেন।

সাদ্দামের নির্দিষ্ট কিছু ক্লায়েন্ট আছেন, যারা তার কাছ থেকেই সব সময় কাজ করিয়ে নেন বলে জানান। সেজন্য তার কাজের খুব একটা অভাব হয় না। ক্লায়েন্টদের সন্তুষ্টির নেপথ্যে তার একাগ্রতা ও নিষ্ঠা বড় ভূমিকা রাখছে। সাদ্দাম বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত কাজটা সুন্দর না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি লেগে থাকি। একটানা ২২ ঘণ্টাও কাজ করেছি। তার সমগ্র কাজের জীবনে একটিমাত্র থ্রি স্টার রিভিউ। বড় কোনো প্রজেক্টের কাজ পেলে একা সামলাতে না পারলে তখন অনলাইন থেকে অন্য ফ্রিল্যান্সারদের সহায়তা নেন সাদ্দাম।

নিজে ফ্রিল্যান্সিং শেখার পর একসময় সাদ্দাম অন্যদের কথা ভাবলেন। সেই ভাবনা থেকেই ফ্রিল্যান্সিং শেখাতে শুরু করেন। অনলাইনে দেশের নানা প্রান্তের মানুষ তার ফ্রিল্যান্সিং ক্লাসে যুক্ত হয়। তাদেরই একজন ময়মনসিংহের আমিনুল ইসলাম। তিনি সাদ্দামের কাছে ফ্রিল্যান্সিং শিখে কেবল নিজে সফলই হননি। তিনি একটি প্রতিষ্ঠানও দিয়েছেন। রফিকুল ইসলাম নামে একজন বহুজাতিক কোম্পানির চাকরি ছেড়ে ফ্রিল্যান্সিংয়ের জগতে আসেন সাদ্দামের কোর্স করেই। তিনি নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান করেছেন। রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি বর্তমানে বিলবাজার নামের একটি অনলাইন ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম পরিচালনা করছি। আমার এখন মাসে আয় এক থেকে দেড় লাখ টাকার মধ্যে। সাদ্দাম স্যারের প্রশিক্ষণ ও প্রেরণা আমাকে আজকের অবস্থানে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে।’

আর দশজনের মতো সাদ্দামের ফ্রিল্যান্সিংয়ের যাত্রা সহজ ছিল না। এই যাত্রায় প্রচুর মানুষের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার হয়েছেন তিনি। ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলতে গিয়েছেন। জিজ্ঞাসা করা হলো, কীজন্য খুলবেন? উত্তরে ফ্রিল্যান্সিং করে বিদেশ থেকে টাকা আনার কথা বললে চারদিকে হাসির রোল পড়ে যায়। তখনো ফ্রিল্যান্সিংয়ে সেভাবে সফল হননি সাদ্দাম। তাই রাজমিস্ত্রির পরিচয় দিতেই তারা বললেন, রাজমিস্ত্রি ফ্রিল্যান্সিং করে বিদেশ থেকে টাকা আনবে—এসব পাগল কোথা থেকে যে আসে। এমন কথা শুনতে হয় তাকে। এই তাচ্ছিল্যের জবাব সাদ্দাম অন্যভাবে ঠিকই দেন। তিনি ওই ব্যাংকে এক মাসে ১০ হাজার ডলার আনেন বিদেশ থেকে। এভাবেই সব বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যান সাদ্দাম। আবার তার নিজের বোনও একসময় বিশ্বাস করত না, এভাবে আয় করা যায়। পরে একদিন বোনের সামনে নিজের উপার্জিত আয়ের টাকা তোলেন। সেদিন তার খুব ভালো লেগেছিল বলে জানান। আগামী দিনগুলোয় কী করবেন, সেটা নিয়ে তেমন একটা ভাবনা নেই তার। তবে ছেলেকে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজটা খুব ভালোভাবে শেখাবেন এমনটাই ইচ্ছা তার।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত