বর্তমান সময়ে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ছোট থেকে বড় প্রায় সবার হাতেই আছে ফোন। কিন্তু আজ যে স্মার্টফোন আমাদের হাতের মুঠোয়, তার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ, বৈপ্লবিক এক যাত্রাপথ। সেই পথের শুরু ১৮৭৬ সালে আর শেষ নেই আজও। প্রতিদিন প্রযুক্তির নতুন নতুন সম্ভাবনা যোগ হচ্ছে এই যাত্রায়।
টেলিফোন থেকে মোবাইল
১৮৭৬ সালে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল টেলিফোন আবিষ্কার করেন। তার এই আবিষ্কার মানবসভ্যতাকে এমন এক যোগাযোগ যুগে নিয়ে আসে, যা পরে সব প্রযুক্তির ভিত্তি তৈরি করে। স্থির তারযুক্ত ফোন তখন দু-একজন মানুষের ঘর, অফিস আর টেবিলের সঙ্গে বাঁধা। মোবাইল বা হাতে নিয়ে ঘোরার মতো ফোনের ধারণা ছিল কল্পনার বাইরে।
মোবাইল যোগাযোগের ইতিহাস
১৯৪৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী প্রথম মোবাইল নেটওয়ার্ক তৈরি করে। সেটি ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং সামরিক কর্মকর্তাদের ব্যবহারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ১৯৫০-এর দশকে বেতার যোগাযোগে দ্রুত অগ্রগতি এবং ১৯৫৬ সালে সাবমেরিন যোগাযোগের জন্য প্রথম স্যাটেলাইট সিস্টেম চালু—এই সবকিছুই পরে মোবাইল ফোন তৈরির প্রযুক্তিগত ভিত্তি শক্ত করে। ১৯৬০-এর দশক মোবাইল ফোন গবেষণার জন্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৬৮ সালে মার্কিন ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন মোবাইল ফোনের নকশা তৈরির জন্য একটি বিশেষ প্রকল্প হাতে নেয়। সেই প্রকল্পই ১৯৭৩ সালের মহামুহূর্তের প্রস্তুতি তৈরি করে দেয়।
মোবাইল ফোনের জন্ম
১৯৭৩ সালে আমেরিকার নিউওয়ার্ক শহরে ইঞ্জিনিয়ার মার্টিন কুপার প্রথম হাতে ধরা মোবাইল ফোন তৈরি করেন। তিনি তখন MOTOROLA-তে কর্মরত। তার স্বপ্ন ছিল একদিন সবার হাতে থাকবে একটি করে ফোন আর যেকোনো সময় তারা একে অন্যের সঙ্গে কথা বলতে পারবে। সে সময় এ ধারণা ছিল যেন বিজ্ঞান-কল্পকাহিনির গল্প। Dick Tracy কমিকের চরিত্রদের হাতে থাকা রেডিও যোগাযোগ যন্ত্রই তার কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিতে অনুপ্রাণিত করে। মাত্র ৩০ জনের একটি দল মাত্র ৩০ দিনের চেষ্টায় তৈরি করে বিশ্বের প্রথম মোবাইল ফোন। ১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাসে নিউওয়ার্কের হিলটন হোটেলে সেই মোবাইল ফোনের প্রথম উন্মোচন করা হয়। ফোনটির দৈর্ঘ্য ছিল ১০ ইঞ্চি, চওড়া ২ ইঞ্চি, পুরুত্ব ৪ ইঞ্চি আর ওজন এক কেজিরও বেশি। ব্যাটারি টিকত মাত্র ২০ মিনিট! তবু এটিই ছিল এক যুগান্তকারী সাফল্য। পৃথিবীর প্রথম মোবাইল কল করেন স্বয়ং মার্টিন কুপার, তার অন্য টেলিকম জায়ান্ট AT&T-এর এক ইঞ্জিনিয়ার বন্ধুকে।
বাণিজ্যিক যুগের সূচনা
মোবাইল ফোন বাজারে আসতে আরো ১০ বছর লেগে যায়। ১৯৮৩ সালে মোটোরোলা বাজারে আনে প্রথম বাণিজ্যিক মোবাইল ফোনÑমোটোরোলা ডায়নাট্যাক (Dynatac)। এটি ছিল তুলনামূলক হালকা, ব্যাটারি স্থায়িত্ব বেশি এবং ব্যবহারে সুবিধাজনক। তখন ফোনটির দাম ছিল প্রায় ৪,০০০ ডলার—অর্থাৎ একেবারে অভিজাত পর্যায়ের। কারো কাছে ‘ইট’, কারো কাছে ‘জুতা’—এ রকম অদ্ভুত আকৃতি হলেও এ ফোনই মানুষের কল্পনায় মোবাইল ফোন ব্যবহারের সংস্কৃতি গড়ে তোলে।
১৯৯০-এর দশকে মোবাইল
১৯৯০-এর দশকে মোবাইল ফোন ছোট হলো, হালকা হলো ও দাম কমল। ডিজিটাল নেটওয়ার্ক, এসএমএস, সহজ কলরেট—সবকিছু মিলিয়ে মোবাইল ফোন সাধারণ মানুষের নাগালে আসতে শুরু করে। এ সময়ই মোবাইল ফোন বিশ্বজুড়ে যোগাযোগব্যবস্থাকে উল্টে দেয়।
স্মার্টফোনের আগমন
২০০০-এর দশকে মোবাইল ফোন আর শুধু কথা বলার মাধ্যম থাকল না। ইন্টারনেট, ইমেইল, ক্যামেরা, মিউজিক, ভিডিও—সব একসঙ্গে যুক্ত হতে শুরু করল।
ফিচার ফোন থেকে স্মার্টফোনে রূপান্তরের মাধ্যমে প্রযুক্তির নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। এরপর আসে টাচস্ক্রিন, অ্যাপ ইকোসিস্টেম, সোশ্যাল মিডিয়া, জিপিএস ও ক্লাউডÑসব মিলিয়ে এক নতুন ডিজিটাল সভ্যতা গড়ে ওঠে এই স্মার্টফোনকে কেন্দ্র করে।
আজকের স্মার্টফোন যেন ‘হাতের মুঠোয় বিশ্ব’
আজ স্মার্টফোন আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যোগাযোগ, ব্যাংকিং, ব্যবসা, পড়াশোনা, স্বাস্থ্য, বিনোদন ও নেভিগেশন—সবকিছু এক ডিভাইসে সমাধান। মার্টিন কুপারের সেই কল্পনা আজ বাস্তব—পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের হাতেই ফোন আর তার সাহায্যে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে মুহূর্তে যোগাযোগ সম্ভব।

