ওয়েভ এনার্জি কনভার্টার

মোখতারুল ইসলাম মিলন
প্রকাশ : ২১ অক্টোবর ২০২৫, ১৬: ৫৪

পৃথিবীর প্রায় ৭১ শতাংশ জুড়ে রয়েছে সমুদ্র। এই বিশাল জলরাশি প্রতিনিয়ত তরঙ্গায়িত হচ্ছে। ঢেউয়ের পর ঢেউ আছড়ে পড়ছে উপকূলে। কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি, এই ঢেউয়ের মধ্যে লুকিয়ে আছে অসীম শক্তির এক অফুরন্ত উৎস? ওয়েভ এনার্জি কনভার্টার বা তরঙ্গশক্তি রূপান্তরক হলো সেই বিপ্লবী প্রযুক্তি, যা সমুদ্রের ঢেউ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে। সমুদ্রের ঢেউ মূলত বাতাসের ঘর্ষণে সৃষ্ট জলরাশির গতিশীল শক্তি।

যখন বাতাস সমুদ্রপৃষ্ঠের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়, তখন এটি জলে শক্তি স্থানান্তর করে এবং তরঙ্গের সৃষ্টি হয়। এই তরঙ্গশক্তি অত্যন্ত ঘনীভূত ও ধারাবাহিক। বিজ্ঞানীদের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের মহাসাগরগুলোয় প্রায় দু-তিন মিলিয়ন মেগাওয়াট শক্তি সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে, যা সমগ্র বিশ্বের বর্তমান বিদ্যুৎচাহিদার দ্বিগুণ। এই বিপুল পরিমাণ শক্তি যদি সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়, তাহলে বিশ্বের শক্তিসংকটের অনেকটাই সমাধান হতে পারে।

বিজ্ঞাপন

ওয়েভ এনার্জি কনভার্টার বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। তবে মূলনীতি একই—সমুদ্রের ঢেউয়ের যান্ত্রিক শক্তিকে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করা। একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি হলো পয়েন্ট অ্যাবজরবার, যা একটি ভাসমান বুয়ে বা বয়ার মতো কাজ করে। এটি ঢেউয়ের সঙ্গে উপরে-নিচে ওঠানামা করে এবং এই গতিবিধি একটি হাইড্রোলিক পাম্প বা লিনিয়ার জেনারেটর চালায়, যা বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। প্রতিটি বুয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করে এবং একাধিক বুয়ে একসঙ্গে স্থাপন করে বড় পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরি করা যায়। আরেকটি কার্যকর পদ্ধতি হলো অসিলেটিং ওয়াটার কলাম। এই পদ্ধতিতে একটি আংশিকভাবে নিমজ্জিত কাঠামো ব্যবহার করা হয়, যার ভেতরে একটি বায়ুকক্ষ থাকে। ঢেউ যখন এই কাঠামোতে প্রবেশ করে, তখন ভেতরের পানির স্তর ওঠানামা করে, যা বায়ুকক্ষের বাতাসকে সংকুচিত ও প্রসারিত করে। এই বাতাসের চাপ একটি টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। এটি অনেকটা ফুসফুসের মতো কাজ করে—ঢেউ এলে শ্বাস নেয় এবং ঢেউ চলে গেলে শ্বাস ছাড়ে।

অ্যাটিনিউয়েটর নামে আরেক ধরনের যন্ত্র রয়েছে, যা একটি দীর্ঘ সাপের মতো ভাসমান কাঠামো। এটি ঢেউয়ের দিকে সমান্তরালভাবে স্থাপিত হয় এবং বিভিন্ন অংশ কব্জার মাধ্যমে সংযুক্ত থাকে। ঢেউ যখন এর মধ্য দিয়ে যায়, তখন এই কব্জাগুলো নমনীয়ভাবে নড়ে এবং এই গতি হাইড্রোলিক পাম্পের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। স্কটল্যান্ডের বিখ্যাত ‘Pelamis’ যন্ত্রটি এই ধরনের একটি উদাহরণ, যা দেখতে অনেকটা সমুদ্রের দৈত্যাকার সাপের মতো। ওভারটপিং ডিভাইস নামে আরেকটি পদ্ধতিতে ঢেউকে একটি উঁচু জলাধারে তুলে আনা হয়। পরে এই পানি নিচে নামার সময় টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে—অনেকটা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো। এই পদ্ধতির সুবিধা হলো এটি ঝড়ের সময়েও কাজ করতে পারে এবং অতিরিক্ত পানি সংরক্ষণ করে পরে ব্যবহার করা যায়।

তরঙ্গশক্তির বেশকিছু অসাধারণ সুবিধা রয়েছে। প্রথমত, এটি সম্পূর্ণ নবায়নযোগ্য এবং পরিবেশবান্ধব। সমুদ্রের ঢেউ একটি অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ—যতদিন বাতাস থাকবে, ততদিন ঢেউ থাকবে। এটি কোনো কার্বন নিঃসরণ করে না, ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এটি একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। দ্বিতীয়ত, সৌরশক্তি বা বায়ুশক্তির তুলনায় তরঙ্গশক্তির ঘনত্ব অনেক বেশি। একই আয়তনের জায়গায় তরঙ্গশক্তি থেকে অনেক বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। তৃতীয়ত, এই শক্তি অত্যন্ত ধারাবাহিক। সৌরবিদ্যুৎ শুধু দিনে এবং বায়ুবিদ্যুৎ শুধু বাতাস থাকলে কাজ করে। কিন্তু সমুদ্রে ঢেউ প্রায় সবসময়ই থাকে, তাই তরঙ্গশক্তি অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য। উপকূলীয় এলাকা, যেখানে প্রচুর জনবসতি কিন্তু বিদ্যুৎ সরবরাহ অপ্রতুল, সেখানে এই প্রযুক্তি বিশেষভাবে উপযোগী। তবে এই প্রযুক্তির কিছু উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জও রয়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো উচ্চ প্রাথমিক খরচ। ওয়েভ এনার্জি কনভার্টার স্থাপনের খরচ অনেক বেশি, কারণ সমুদ্রের কঠোর পরিবেশে টিকে থাকার জন্য যন্ত্রগুলো অত্যন্ত মজবুত হতে হয়। লবণাক্ত পানি, প্রচণ্ড ঢেউ, ঝড়ঝঞ্ঝা—এসব সামলানোর জন্য বিশেষ ধরনের উপকরণ ব্যবহার করতে হয়, যা ব্যয়বহুল। রক্ষণাবেক্ষণও একটি জটিল বিষয়। লবণাক্ত পানি যন্ত্রপাতির ক্ষয় ঘটায় দ্রুত এবং সমুদ্রের মাঝখানে স্থাপিত যন্ত্রের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ কঠিন ও ব্যয়সাপেক্ষ।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এই প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করছে এবং পরীক্ষামূলক প্রকল্প চালাচ্ছে। ইউরোপীয় দেশ স্কটল্যান্ড তরঙ্গশক্তি গবেষণায় অগ্রণী এবং তারা বেশ কয়েকটি পাইলট প্রকল্প সফলভাবে পরিচালনা করছে। পর্তুগালের আগুকাডোরা ওয়েভ পার্ক ছিল বিশ্বের প্রথম বাণিজ্যিক তরঙ্গশক্তি কেন্দ্র। যদিও প্রযুক্তিগত সমস্যায় এটি পরবর্তী সময়ে বন্ধ হয়ে যায়। অস্ট্রেলিয়ার কার্নেগি ক্লিন এনার্জি কোম্পানি CETO নামে একটি উন্নত সিস্টেম তৈরি করেছে, যা সমুদ্রতলে স্থাপিত হয় এবং সম্পূর্ণ অদৃশ্যভাবে কাজ করে। যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন এবং হাওয়াই রাজ্যেও পরীক্ষামূলক প্রকল্প চলছে।

বাংলাদেশের জন্য এই প্রযুক্তির বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলরেখা রয়েছে, যেখানে বঙ্গোপসাগরের ঢেউ নিয়মিত আছড়ে পড়ে। বিশেষ করে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও পটুয়াখালী এলাকায় তরঙ্গশক্তির বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। উপকূলীয় দ্বীপগুলো, যেখানে জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা কঠিন এবং ব্যয়বহুল, সেখানে এই প্রযুক্তি অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে। তবে প্রযুক্তিগত জ্ঞান, বিনিয়োগ ও গবেষণার অভাবে আমরা এখনো এই সম্পদ কাজে লাগাতে পারিনি। যদি সরকার ও বেসরকারি খাত এই খাতে মনোযোগ দেয় এবং বিনিয়োগ করে, তাহলে উপকূলীয় অঞ্চলে বিদ্যুৎ সংকট অনেকটাই দূর করা সম্ভব। এছাড়া এটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং দেশকে পরিবেশবান্ধব শক্তির দিকে নিয়ে যাবে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত