ই-বুকের জন্মকথা

জুবাইর আল হাদী
প্রকাশ : ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৫: ২১

টিনের ক্যান বাজারে আসে ১৮১০ সালে। অথচ সেটি খোলার যন্ত্র (ক্যান ওপেনার) আবিষ্কৃত হয় প্রায় অর্ধশতাব্দী পর ১৮৫৮ সালে। শুনে অবাক লাগতে পারে, ই-বুকের গল্পও কিন্তু এ রকমই। পাঠকযন্ত্র বা ই-বুক রিডার আসার বহু আগে ই-বুকের জন্ম হয়েছিল। প্রায় তিন দশক আগে। আজ আমরা সেই জন্মকথায় যাই। ১৯৭১ সাল।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়ের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন মাইকেল হার্ট। ছোটবেলা থেকেই যন্ত্রপাতির ভেতরকার গোপন রহস্য তাকে টানত। মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি টেলিভিশন বা রেডিও খুলে ভেতরের যন্ত্রাংশ বোঝার চেষ্টা করতেন এবং আবার জোড়া লাগাতেন।

বিজ্ঞাপন

এক গ্রীষ্মে বন্ধুর সহায়তায় তিনি প্রথমবার দেখলেন বিশাল এক মেইনফ্রেম কম্পিউটার—জেরক্স সিগমা ৫। গবেষণাগারে রাখা এই যন্ত্র যুক্ত ছিল দেশের প্রায় ১০০ বিশ্ববিদ্যালয় ও সামরিক বাহিনীর কম্পিউটারের সঙ্গে। যেটি পরিচিত ছিল ARPANET নামে। এটিকেই আজকের ইন্টারনেটের পূর্বসূরি বলা হয়। ১৯৭১ সালের ৪ জুলাই, স্বাধীনতা দিবসে, হার্ট পেলেন সেই কম্পিউটার ব্যবহার করার সুযোগ।

অন্যরা যেখানে প্রোগ্রাম লিখতে ব্যস্ত, সেখানে হার্টের মাথায় এলো অন্য কিছু করার ইচ্ছা। ব্যাগে রাখা খাবারের সঙ্গে যখন তিনি পেলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, তখনই যেন মাথায় বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, পুরো ঘোষণাপত্রটি টাইপ করে কম্পিউটারে সংরক্ষণ করবেন।

কাজটি সহজ ছিল না। জেরক্স সিগমা-৫-এর দাম ছিল প্রায় ৩ লাখ ডলার। জায়গা নিত পুরো একটি ঘর। অথচ না ছিল স্ক্রিন, না কী-বোর্ড। টেলিটাইপ নামক যন্ত্র দিয়ে টাইপ করতে হতো, যা মূলত টেলিগ্রাফ ব্যবহারের জন্য বানানো হয়েছিল। টাইপ করা অক্ষরগুলো ছিদ্র করা কাগজে রূপান্তরিত হতো কোড আকারে।

ই-বুক জনক মাইকেল এস হার্ট
ই-বুক জনক মাইকেল এস হার্ট

পরে সেটি কম্পিউটারে প্রবেশ করানো হতো। আরো মজার ব্যাপার, তখন কম্পিউটার ছোট-বড় অক্ষর চিনতে পারত না, তাই পুরো ঘোষণাপত্র টাইপ করতে হয়েছিল বড় হাতের অক্ষরে। যখন কাজ শেষ হলো, ডকুমেন্টের আকার দাঁড়াল পাঁচ কিলোবাইট, যা আজকের মাইক্রোসফট ওয়ার্ডের একটি ফাঁকা পাতার থেকেও বড়! নেটওয়ার্কে ডকুমেন্ট পাঠাতে চাইলে সহকর্মীরা আপত্তি করলেন, এতে নাকি পুরো ARPANET ক্র্যাশ হতে পারে। তাই হার্ট করলেন অন্য ব্যবস্থা—সব ব্যবহারকারীকে বার্তা পাঠালেন, তার ইলেকট্রনিক ঘোষণাপত্র কোথায় পাওয়া যাবে। সেদিন মাত্র ছয়জন সেটি ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু ইতিহাসে এটাই ছিল প্রথম ই-বুক।

হার্টের লক্ষ্য ছিল দীর্ঘমেয়াদি। তিনি জানতেন ASCII কোড ব্যবহৃত হলে ডকুমেন্ট যুগের পর যুগ টিকে থাকবে। তার ধারণাই সত্যি হলো—আজও সেই ডকুমেন্ট পড়া সম্ভব। পরের বছর তিনি Bill of Rights, তারপর যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান এবং কিং জেমস বাইবেলের অংশবিশেষ টাইপ করেন। ধীরে ধীরে তিনি তার প্রকল্পের নাম দেন ‘প্রজেক্ট গুটেনবার্গ’—যিনি ১৪৫০ সালে প্রথম মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন, সেই জোহানেস গুটেনবার্গকে সম্মান জানাতে। প্রথমে একা একাই কাজ চালালেও ১৯৮০-এর দশকে প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কাজ সহজ হলো। স্ক্যানার ও OCR সফটওয়্যার আসায় আর হাতে টাইপ করতে হতো না।

১৯৯০-এর দশকে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব জনপ্রিয় হওয়ার ফলে স্বেচ্ছাসেবকরা যুক্ত হতে শুরু করলেন। শুরুতে ১৮ বছর লেগেছিল প্রথম ১০টি বই তৈরি করতে। কিন্তু পরে গতি বেড়ে যায়—প্রতি মাসে ১টি, তারপর ২টি, ৪টি ও ৮টি। এভাবে ১৯৯৫ সালে পৌঁছে যায় মাসে ১৬টিতে। ২০০০ সালের মধ্যে সংরক্ষিত হলো ৩,০০০-এরও বেশি ই-বুক। আর ২০০৪ সালের দিকে মাসে প্রকাশিত হতে লাগল গড়ে ৩৩৮টি বই—দিনে ১০টিরও বেশি। মাইকেল হার্ট বিশ্বাস করতেন, বই সবার জন্য উন্মুক্ত হওয়া উচিত। তাই কপিরাইট-মুক্ত বইগুলোই তিনি ডিজিটাল আকারে দিতেন। নিজের টাকায় শুরু করলেও পরে অনুদানের মাধ্যমে প্রকল্পটি টিকে গেল। ২০১১ সালে হার্ট মারা যান, বয়স হয়েছিল ৬৪। কিন্তু তার স্বপ্ন থেমে থাকেনি।

আজ প্রজেক্ট গুটেনবার্গে ৫০,০০০-এরও বেশি বই পাওয়া যায়, নানা ভাষায়—চীনা, সংস্কৃত, হিব্রু থেকে শুরু করে এসপেরান্তো পর্যন্ত। আর লক্ষ্য হলো ১০০ ভাষায় এক কোটি বই সংরক্ষণ করা। একজন মানুষের একক স্বপ্ন থেকেই যে উদ্যোগ জন্মেছিল, আজ তা বিশ্বজুড়ে জ্ঞানের ভান্ডারে পরিণত হয়েছে। ইন্টারনেট যুগে প্রজেক্ট গুটেনবার্গ ছাড়া এখন কল্পনাও করা কঠিন।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত