কবি নজরুলের শিশু-কিশোর লেখার জগৎ

হাসান হাফিজ
প্রকাশ : ২৪ মে ২০২৫, ১২: ০৮

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) শিশু-কিশোর রচনার পরিমাণ বিপুল নয়। কম হলেও আপন বৈশিষ্ট্যে, বৈচিত্র্যে ভাস্কর এবং অনন্য। শিশুরা যেন বিজ্ঞানমনস্ক, দৃঢ়চিত্ত, মানবিক, প্রাণোচ্ছল, অনুসন্ধানী সত্তা হিসেবে গড়ে ওঠে- সেটাই ছিল নজরুল রচনার লক্ষ্য। শিশুমনের নির্মল অনুভূতি, ভাব-কল্পনা, স্বপ্ন- কবির রচনায় আশ্চর্য নৈপুণ্যে শৈল্পিক দ্যুতিতে ভাস্বর হয়ে আছে। সহজ-সরল ভাষায়, নিখুঁত ছন্দে, পরিবেশন শৈলীÑসব মিলিয়ে অসাধারণ মুনশিয়ানায় তিনি লিখেছেন শিশুতোষ ছড়া-কবিতা, গান ও নাটিকা।

দুনিয়াজুড়ে মাকে নিয়ে কত কবি, কত যে গান-কবিতা লিখেছেন, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। ‘ঝিঙেফুল’ গ্রন্থে কাজী নজরুল ইসলামের একটি কবিতার নাম ‘মা’। তিনি লিখছেন,

বিজ্ঞাপন

‘যেখানেতে দেখি যাহা

মা-এর মতন আহা

একটি কথায় এত সুধা মেশা নাই,

  • মায়ের মতন এত
  • আদর-সোহাগ সে তো

আর কোনোখানে কেহ পাইবে না ভাই।

মাতৃস্নেহ যে কত গভীর, কত নিঃস্বার্থ, তুলনাহীনÑসেটা প্রতিধ্বনিত হয়েছে একই কবিতার নিম্নে উদ্ধৃত চরণগুলোয়Ñ

গা’টি গরম হলে

মা সে চোখের জলে

ভেসে বলে, ‘ওরে জাদু কি হয়েচে বল্!

কত দেবতার ‘থানে’

পীরে মা মানত মানেÑ

মাতা ছাড়া নাই কারো চোখে এত জল।

যখন ঘুমায়ে থাকি

জাগে রে কাহার আঁখি

আমার শিয়রে, আহা কিসে হবে ঘুম!

তাই কত ছড়াগানে

ঘুম পাড়ানিরে আনে,

বলে, ‘ঘুম! দিয়ে যা রে খুকু-চোখে চুম।’

‘প্রভাতী’ নামের ঝলমলানো উচ্ছ্বাস আবেগ-অনুভূতির বর্ণচ্ছটায় উজ্জ্বল অসাধারণ যে কবিতাটি, আমরা প্রায় সবাই সেটি পড়েছি। ছবির মতন চমৎকার সেই কবিতা। পড়ে পেয়েছি নির্মল আনন্দ। সেই অভিজ্ঞতা চির মনোরম, চির মধুর। কবি লিখছেন,

... ... ...

‘ত্যাজি নীড়

করে ভিড়

  • ওড়ে পাখি আকাশে,

এন্তার

গান তার

  • ভাসে ভোর বাতাসে।

চুলবুল্

বুল্বুল্

  • শিস দেয় পুষ্পে,

এইবার

এইবার

  • খুকুমণি উঠবে!

খুলি হাল

তুলি পাল

  • ঐ তরী চল্ল,

এইবার

এইবার

  • খুকু চোখ খুল্ল।

আলসে

নয় সে

ওঠে রোজ সকালে,

রোজ তাই

চাঁদা ভাই

  • টিপ দেয় কপালে।

... ... ...

কী সুন্দর কী মনজুড়ানো কবিতা। পাঠান্তে মনে দোলা দেয়, গেঁথে থাকে। ভুলে যাওয়া দুঃসাধ্য। খুশিমনে আবৃত্তি করা যায় কবিতাটি। এমন অনিন্দ্যকান্তি ঝরঝরে প্রাণময় লেখার সুকৃতি ও আবেদন সর্বজনীন। কাল থেকে কালে এর মর্মকথা মন ছুঁয়ে যায়, যাবে সব বয়সি পাঠকের। এ কথা আমরা অনায়াসেই বলতে পারি।

‘পুতুলের বিয়ে’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় আজ থেকে ৯২ বছর আগে, ১৩৪০ বঙ্গাব্দে। প্রকাশক ডি এম লাইব্রেরি, ৬১ কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট, কলকাতা। এ বইয়ের একটি কবিতার নাম ‘শিশু জাদুকর’। কবিতাটি সম্পর্কে শামসুন নাহার মাহমুদ যে তথ্য দিয়েছেন, তা উদ্ধৃতিযোগ্য। ‘নজরুলকে যেমন দেখেছি’ গ্রন্থে তিনি লেখেনÑ

“আসন্ন বিদায়ের কথা স্মরণ করে কবি লিখলেনÑ‘বিদায় হে মোর বাতায়ন পাশে নিশীথ জাগার, সাথী...’ ‘সুপারি গাছগুলি সুন্দর, না এই শিশুটি’Ñআম্মার এ কথা শুনে কি বুঝে জানি না কবি অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। বললেনÑ‘আম্মার মনের কথা বুঝতে আর আমার বাকি নেই। পরদিন সকালে কবিতার খাতা খুলতেই চোখে পড়ল নতুন কবিতা ‘শিশু জাদুকর’।”

সেই কবিতার খানিকটাÑ

‘পার হয়ে কত নদী কত সে সাগর

এই পারে এলি তুই শিশু জাদুকর।

কোন রূপ-লোকে ছিলি রূপকথা তুই,

রূপ ধরে এলি এই মমতার ভুঁই।

নবনীত সুকোমল লাবণি লয়ে

এলি কে রে অবনীতে দিগবিজয়ে।

কত সে তিমির-নদী পারায়ে এলিÑ

নির্মল নভে তুই চাঁদ পহেলি।

... ... ...

তোর সাথে ঘর ভরে এলো ফালগুন,

সব হেসে খুন হল, কি জানিস গুণ!

এল কুসুমের বাস পাখিদের গান,

ভিড় করে আলো এল, বুক ভরে প্রাণ।

পেলি হেথা ঠোঁট-ভরা মধু চুম্বন,

আমি দিনু হাতে তোর নামের কাঁকন।

তোর নামে রহিল রে মোর স্মৃতিটুক

তোর মাঝে রহিলাম আমি জাগরূক।’

দুই.

কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা একটি স্কুলপাঠ্য বইয়ের নাম মক্তব সাহিত্য। এটি ক্ষুদ্রাকার একটি গ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৫ সালের ৩১ জুলাই। প্রকাশক ছিলেন খোন্দকার আবদুল জব্বার, ২৫-এ পঞ্চাননটোলা লেন, কলকাতা।

‘মক্তব সাহিত্যে’ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আলস্যের ফল’ ও ‘হার-জিত’ নামে যে কবিতা দুটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, কণিকা (১৮৯৯) কাব্যে তা যথাক্রমে ‘অকর্মার বিভ্রাট’ ও ‘হার-জিত’ শিরোনামে ভিন্নপাঠযুক্ত হয়ে সংকলিত হয়েছে।

‘আমাদের খাদ্য’ শীর্ষক রচনাটির লেখক ডা. চুনীলাল বসু, রায় বাহাদুর, সিআইই (১৮৬১-১৯৩০) বিখ্যাত চিকিৎসক ও রসায়নবিদ ছিলেন। ভারতীয়দের মধ্যে তিনিই প্রথম রসায়নের অধ্যাপক পদ লাভ করেন (১৮৯৮)। তার নানা গ্রন্থের মধ্যে ‘খাদ্য’ নামেও একটি বই আছে।

‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে’ কবিতাটির সঙ্গে অজ্ঞাত কারণে রচয়িত্রী কুসুমকুমারী দাশের নাম মুদ্রিত হয়নি। কুসুমকুমারী দাশ হচ্ছেন প্রখ্যাত কবি জীবনানন্দ দাশের মা।

মক্তব সাহিত্যের মর্মকথা

স্কুলপাঠ্য এই গ্রন্থটি শুরু হয়েছে মোনাজাত (সুরা ফাতেহা) দিয়ে। এটি সুরা ফাতেহার বাংলা অনুবাদ। মক্তব্য সাহিত্যের সূচিপত্র : হজরত মুহাম্মদের উম্মত পরীক্ষা, আলস্যের ফল, পানি, কুটির, ঈদের দিনে, মৌলবি সাহেব, চাষি, কাবা শরিফ, কোরআন শরিফ, উদ্ভিদ, আল্লাহতায়ালা, আমাদের খাদ্য, হজরতের মহানুভবতা, গোরু, আদর্শ ছেলে, পরিচ্ছদ, সত্য রক্ষা, বিড়াল, ঈদের চাঁদ এবং হার-জিত।

গ্রন্থিত লেখাগুলোর মধ্যে গদ্যই বেশি। কবিতাগুলো হচ্ছে : মোনাজাত, আলস্যের ফল, কুটির, মৌলবি সাহেব, চাষি, হজরতের মহানুভবতা, আদর্শ ছেলে, ঈদের চাঁদ এবং হার-জিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হার-জিত কবিতাটি-

‘ভীমরুল মৌমাছিতে হল রেষারেষি,

দুজনার মহাতর্ক কার শক্তি বেশি।

ভীমরুল কহে,Ñআছে সহস্র প্রমাণ,

তোমার কামড় নহে আমার সমান।

মৌমাছির কথা নাই, ছলছল আঁখি

হাতেফ কহিল তারে কানে কানে ডাকি,Ñ

‘কেন বাছা মাথা হেঁট একথা নিশ্চিত

বিষে তুমি হার মান, মধুতে যে জিত।

আলোচনা : রেষারেষি-রাগারাগি... আঁখি-চক্ষু, জিত-জয় করা।

প্রশ্ন : কবিতাটি আবৃত্তি কর। কবিতাটি পড়িয়া কি শিখিলে?’

ছোট ছোট গদ্য রচনায় তথ্য দিয়ে শিশুদের শেখানো হয়েছে আমাদের জীবনে কোন বিষয়টির কী গুরুত্ব, কী প্রয়োজনীয়তা ও তাৎপর্য। ‘পানি’ শিরোনামের লেখাটি এখানে তুলে দিচ্ছিÑ

‘পানি না হইলে আমরা বাঁচিতে পারি না। পানির অন্য নাম জল। পিপাসার সময় পানি না পাইলে সমস্ত জীবজন্তু প্রাণত্যাগ করে। গোসল করা, অজু করা, রান্না করা, কাপড় ধোয়া, বাসন মাজা ইত্যাদি প্রতিদিনের নানা আবশ্যকীয় কাজ আমাদের পানির সাহায্যে করিতে হয়।

নদী, পুষ্করিণী প্রভৃতির জলভাগ তোমরা অনেকে দেখিয়াছ। সমুদ্র দুনিয়ার স্থলভাগকে ঘিরিয়া আছে।... তাহা হইলে এই দুনিয়ার পানি কত বেশি, তাহা সহজেই অনুমান করিতে পার। সমুদ্রের পানি লোনা। উহা কেহ পান করিতে পারে না। পানের জন্য যে পানি ব্যবহার করিবে, তাহা বিশুদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। বিশুদ্ধ পানি বর্ণহীন, গন্ধহীন ও স্বাদহীন। যে পানিতে কোনো বর্ণ বা গন্ধ আছে, তাহা দূষিত বলিয়া জানিবে। দূষিত পানিতে নানারূপ রোগের জীবাণু লুকানো থাকে। দূষিত পানি পান করিলে আমাশয়, টাইফয়েড ও কলেরা প্রভৃতি রোগ আক্রমণ করিতে পারে। নানা কারণে নদী, পুষ্করিণী ও কূপ প্রভৃতির পানি দূষিত হয়। নদীতে লোকে জীবজন্তুর মৃতদেহ ফেলে, বহু গাছপালার পাতা পড়িয়া পচে ও গোমহিষাদি স্নান করে, ইত্যাদি কারণে... পানি দূষিত হয়... এজন্যই গ্রামে মধ্যে মধ্যে এত বেশি সংক্রামক রোগ দেখা দেয়। তোমরা কদাচ এইরূপ জলাশয়ের পানি পান করিবে না।

দূষিত পানি পান করিতে হইলে উহা আধঘণ্টা আগুনে ফুটাইয়া লইয়া একটি পাত্রে রাখিয়া দেবে; পরে ঠান্ডা হাইলে পান করিবে।’

এই লেখা শেষ করছি স্বয়ং নজরুলের লেখা ‘ঈদের চাঁদ’ কবিতাটি দিয়েÑ

‘রমজানেরই রোজার শেষে

উঠেছে আজ ঈদের চাঁদ

চারদিকে আজ খুশির তুফান

নাই ভাবনা নাই বিষাদ।

কাল সকালে ঈদের নামাজ

পড়তে যাব ঈদগাহে

নিদ নাই তাই আজকে চোখে

মন ছুটে যায় আল্লাহর রাহে।

আতর গোলাব মাখব গায়ে

রঙিন পিরহান পরি

শিরনি সেমাই ক্ষীর খাব ভাই

ভর্তি করে তশতরি।...

যে হজরতের উম্মত যার

দোওয়ায় আসে ঈদ এমন

তাহার নামে পড়ব দরুদ

চাইব সদা তার শরণ।’

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত