ছাদে ছোট সবুজ উদ্যান

শিফা চৌধুরী
প্রকাশ : ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ১১: ১৭

সবুজ মানেই সতেজতা। সবুজ মানেই প্রশান্তি। যান্ত্রিক এই শহরে সবুজের এতটুকু উপস্থিতিও যেন অনেকখানি প্রশান্তি এনে দেয়। দুঃখজনক হলেও সত্যি, এই শহর ক্রমেই নিষ্প্রাণ হয়ে উঠছে। নাগরিক কোলাহলের এই শহর সজীবতা হারাচ্ছে প্রতিদিন। কিন্তু মানুষ তার শিকড়কে সহজে ভুলতে পারে না। সবুজে ভরা গ্রামবাংলায় বেড়ে ওঠা নাগরিক সমাজের একটা অংশ সবুজকে ধরে রাখতে চায় আবাসস্থলে। শৌখিন মানুষেরা তাদের ঘরবাড়িতে সবুজকে ধরে রাখার জন্য একান্ত নিজস্ব ভাবনা আর প্রচেষ্টায় নিজের বাড়ির ছাদে তৈরি করছেন ছাদবাগান। সময়ের সঙ্গে এ বাগান এখন আর শৌখিনতায় আটকে নেই। নিরাপদ সবজি দিয়ে পারিবারিক পুষ্টিচাহিদা পূরণ, পারিবারিক বিনোদন এবং অবসর কাটানোর এক মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে এ ছাদবাগানগুলো। বাংলাদেশের শহুরে কৃষিব্যবস্থার শৌখিন পদযাত্রা সময়ের বিবর্তনে এক সামাজিক আন্দোলনে রূপ নিতে যাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন
Chadbagam-2

ছাদে বাগান কোনো নতুন ধারণা নয়। অতি প্রাচীন সভ্যতায়ও ছাদবাগানের ইতিহাস চোখে পড়ে। খ্রিষ্টের জন্মেরও আগে মেসোপটেমিয়া ও পারস্যের জুকুরাক নামীয় পিরামিড আকৃতির উঁচু পাথরের স্থাপনায় বাগান ও ছোট গাছ লাগানোর জন্য স্থান নির্ধারণ করার নিদর্শন পাওয়া যায়। পম্পেই নগরীর কাছেই প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন রোমান ভিলায় কেবল একটি নির্দিষ্ট ছাদ তৈরিই করা হয়েছিল বাগান করার জন্য। ১১ শতকের পুরোনো কায়রো শহরে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়, যার কোনো কোনোটি ছিল ১৪ তলা পর্যন্ত বিস্তৃত। এ ভবনগুলোর সবকটির ছাদেই বাগান স্থাপন করা হয়েছিল সৌন্দর্যের অংশ হিসেবে, যাতে সেচ দেওয়ার জন্য পশুশক্তির সাহায্যে চাকা ঘুরিয়ে পুলি দিয়ে নিচ থেকে ওপরে পানি তোলা হতো। ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যানও ধারণা করা হয় বিভিন্ন ছাদ ও বারান্দার সমন্বয়ে তৈরি, তবে ঐতিহাসিকভাবে এ উদ্যানের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া না গেলেও তৎকালে বর্তমান ইরাকের মসুল শহরের কাছেই আরেক ঝুলন্ত উদ্যানের নিদর্শন পাওয়া যায়।

বিশ্বব্যাপী নগরায়ণ বাড়ছে। ফলে শহুরে কৃষি নামক এক নতুন শব্দ আমাদের শব্দভাণ্ডারে যুক্ত হচ্ছে। এ কৃষির শুরুটা শৌখিন। ব্যাপক বাণিজ্যিক উৎপাদন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্ভব না হলেও ধীরে ধীরে পারিবারিক পুষ্টিচাহিদা পূরণে এ খাত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কেবল বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের দেশে দেশে এর গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। শহরাঞ্চলে ফুল, ফল ও সবজির পারিবারিক বাগান এখন আর কেবলই শৌখিনতা বা পারিবারিক প্রয়োজন নয়। পরিবেশ রক্ষা আর নগরের তাপমাত্রা কমিয়ে আনতে অনেক দেশেই বাড়ির ছাদ, বারান্দা, গাড়িবারান্দা, ফুটপাত, পার্ক, সরকারি খাস ভূমি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রতিটি পর্যায়ে কৃষি উৎপাদন বিশেষ করে উদ্যান ফসল ও বাহারি ফুলের গাছের সমন্বয়ে তৈরি করা হচ্ছে সবুজ নগরায়ণ। আমাদের দেশেও হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে ছাদবাগানের মাধ্যমে ব্যক্তিপর্যায়ে শহরে সবুজায়ন শুরু হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নয়, বরং একান্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগেই এদেশে ছাদবাগানের সূচনা।

Chadbagam-3

শহরে ছাদবাগান স্থাপন করা হলে শহরের তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি পর্যন্ত কমে আসে। আমাদের শহরগুলোয় মাটির অস্তিত্ব দিন দিন কমে আসছে। ইট-কাঠের ভবনের বদলে দ্রুতই বৃদ্ধি পাচ্ছে ইস্পাতের কাঠামো ও কাচে মোড়ানো বহুতল ভবন। বিশেষ করে জানালায় কাচ ও বাণিজ্যিক ভবনের টেকসই স্থাপনার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে হালকা কিন্তু শক্তিশালী ধাতব পাত, ফাইবার ও গ্লাস। সূর্য থেকে তাপ ও আলো এ ধাতব পাত ও কাচের কাঠামোর একটিতে পড়ে অপরটিতে প্রতিফলিত হয়। বারংবার প্রতিফলনের দরুন সে নির্দিষ্ট এলাকার তাপমাত্রা আশপাশের এলাকার তুলনায় সামান্য বেড়ে যায় এবং শহরজুড়ে তৈরি হয় অসংখ্য হিট আইল্যান্ড বা তাপদ্বীপ। ভবনে বা এর কাঠামোতে বাগান স্থাপন করা হলে বাগানের গাছের পৃষ্ঠদেশ এ তাপ শুষে নেয় এবং গাছের দেহ থেকে যে পানি জলীয় বাষ্প আকারে প্রস্বেদন প্রক্রিয়ায় বেরিয়ে যায়, তা সে নির্দিষ্ট স্থানের তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি কমিয়ে আনে। অসংখ্য ছাদবাগান বা শহরের গাছপালা এ প্রক্রিয়ায় শহরের উচ্চ তাপমাত্রাকে কমিয়ে আনে।

ছাদবাগানকে কেতাবি ভাষায় যেমন কোনো সংজ্ঞায় নির্ধারিত করা যায়নি, তেমনি এর কোনো সুনির্দিষ্ট মডেল এদেশে এখন পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। পাকা বাড়ির খালি ছাদে অথবা ব্যালকনিতে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ফুল, ফল ও শাকসবজির বাগান গড়ে তোলাকে ছাদবাগান বলা হয়। বাড়ির মালিক তাদের আপন উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখে আপন ভাবনায় ও ভঙ্গিমায় সাজিয়ে তোলেন তাদের ছাদকে। এখানে টব, বড় বড় ড্রাম, কিংবা ট্রেতে রোপণ করা হয় নানা ফুল, ফল ও সবজি। কেউ কেউ আবার ছাদে স্থায়ী কাঠামো নির্মাণ করে তাতে গাছ রোপণ করেন। ছাদের আকার ও সহনশীলতার দিকে লক্ষ রেখে নানা কাঠামোর ওপর স্থাপন করেন টব ও মাচা। তবে এলোমেলো ও অপরিকল্পিত ছাদবাগান কেবল সময় ও অর্থ অপচয়ই করায় না, একইসঙ্গে ভবনেরও নানা ক্ষতি করে। তাই কিছু মৌলিক বিষয়ের প্রতি লক্ষ রেখে ছাদবাগান গড়ে তোলা প্রয়োজন।

Chadbagam-4

ছাদে বাগান করার সময় প্রথমেই ছাদের আয়তন অনুসারে কাগজে-কলমে খসড়া ম্যাপ করে বিভিন্ন স্থাপনা ও ভবনের কলামগুলো চিহ্নিত করে নিতে হবে। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ চাহিদা ও রুচি অনুসারে সাজানো না হলে এর পুনর্বিন্যাস অত্যন্ত শ্রমসাধ্য একটি কাজ। বড় বা ভারী গাছগুলো ছাদের বিম বা কলামের নিকটবর্তী স্থান বরাবর স্থাপন করতে হবে। ছাদ যেন ড্যাম্প বা স্যাঁতসেঁতে হতে না পারে, সেজন্য রিং বা ইটের ওপর ড্রাম অথবা টবগুলো স্থাপন করলে নিচ দিয়ে আলো-বাতাস চলাচল করবে এবং ছাদও ড্যাম্প হবে না। নেট ফিনিশিংয়ের মাধ্যমেও ড্যাম্প হওয়া থেকে ছাদকে প্রতিরোধ করা যায়।

পরিবেশের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করা মানুষের কিছু অভিযোজিত ক্ষমতা এখনো আমাদের মাঝে বিরাজমান। যেকোনো রঙের তুলনায় আমাদের চোখে সবুজ রঙের পার্থক্যটা বেশি ধরার কারণও এই অভিযোজনের ফলাফল বলে অনেকেই ধারণা করেন। তাই নানা ধরনের সবুজের সমারোহ দেখে আমরা প্রফুল্ল হয়ে উঠি। অসংখ্য শেডের সবুজ রঙ আমাদের একঘেয়েমিতে আক্রান্ত করে না, করে উৎফুল্ল। যান্ত্রিক জীবনে ছাদবাগানের ছোট সবুজ উদ্যান আমাদের সতেজ রাখতে সহায়তা করে, গড়ে তোলে নির্মল পরিবেশ। ছাদ না পেলে ব্যালকনিতেই গড়ে তুলুন আপন উদ্যান।

বিষয়:

ছাদবাগান
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত