বৃক্ষমেলায় সবুজের প্রশান্তি

বিউটি হাসু
প্রকাশ : ২০ জুলাই ২০২৫, ১১: ৫১
আপডেট : ২০ জুলাই ২০২৫, ১১: ৫৫

বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। আমাদের দেশে সারা বছরই গাছ বা বৃক্ষরোপণ করা যায়। তবে গাছ লাগানোর সবচেয়ে উপযুক্ত সময় বর্ষা ও শরৎকাল। আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র ও আশ্বিন—এই চার মাস গাছ লাগানোর উপযুক্ত সময়। এ সময় পর্যাপ্ত বৃষ্টি থাকে বলে চারাও সুন্দরভাবে প্রকৃতির সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠে। তা ছাড়া আলো-বাতাস ও অনুকূল তাপমাত্রার জন্যও এ সময়টা বৃক্ষরোপণের মোক্ষম মৌসুম।

বিজ্ঞাপন

সবুজ বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকারে জাতীয় বৃক্ষমেলা

সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে শুরু হয়েছে ‘জাতীয় বৃক্ষমেলা-২০২৫’। বৃক্ষরোপণের মৌসুম সামনে রেখে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পুরোনো বাণিজ্যমেলার মাঠে এটি শুরু হয়েছে। আগামী ২৫ জুলাই পর্যন্ত চলবে। কোনো ধরনের প্রবেশমূল্য বা টিকিট ছাড়া উপভোগ করতে পারবেন এ বৃক্ষমেলা। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ক্রেতা-দর্শনার্থীদের জন্য মেলা উন্মুক্ত।

‘পরিকল্পিত বনায়ন করি, সবুজ বাংলাদেশ গড়ি’ স্লোগানে গত ২৫ জুন থেকে শুরু হয়েছে মাসব্যাপী এই বৃক্ষমেলা। এই বৃক্ষমেলার আয়োজন করেছে বন অধিদপ্তর। এই মেলা শুধু গাছের চারা কেনাবেচার উৎসব নয়, বরং এটি একটি সচেতনতাভিত্তিক সামাজিক আন্দোলন বলে জানিয়েছে বন অধিদপ্তর, যার মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের বার্তা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে দেশের প্রতিটি প্রান্তে।

Tree-Fair-2

বৃক্ষমেলার বন অধিদপ্তরের তথ্যকেন্দ্রের তথ্যমতে, বৃক্ষমেলায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন নার্সারি এবং কৃষি ও বনসংশ্লিষ্ট ছয়টি সরকারি প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করছে। এ মেলার স্টলসংখ্যা ১৩৫টি, যার মধ্যে রয়েছে একশ’র কাছাকাছি নার্সারির স্টল, বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান, বাংলাদেশ বন শিল্প উন্নয়ন করপোরেশন ও কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের স্টল। নাগরিক সহায়তার জন্য রয়েছে তথ্য সেল, কন্ট্রোল রুম, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নিজস্ব স্টল এবং বেশ কয়েকটি অরগানিক খাদ্যসামগ্রীর স্টল। কয়েকটি মৃৎশিল্পের দোকানও স্থান পেয়েছে।

সবুজ বৈচিত্র্যময় ফুলফল-লতাগুল্ম আর নানা ধরনের গাছগাছালিতে সাজানো শতাধিক স্টল। যে গাছগুলো সচরাচর পাওয়া যায় না, সেগুলোই বৃক্ষমেলা থেকে সংগ্রহ করা যায়।

স্টলের সামনে খোলা মাঠের নান্দনিক পরিবেশ আর সবুজের নিবিড় সন্নিবেশ। উপভোগ করতে পারবেন গাছের ডালে ডালে ঝুলে থাকা দেশি-বিদেশি নানা বর্ণের ও ধরনের আম, আমলকী, জাম-জামরুল, আতা বা মেওয়া, পেয়ারা, করমচা, বেল-কদবেল, লঙ্গান, রাম্বুটান, ডুরিয়ান, অ্যাভোকাডোসহ নানা ফল।

মেলায় রয়েছে সহস্র ফলের সমাহার। পাশাপাশি সৌন্দর্যবর্ধন গাছ, বনসাঁই, ক্যাকটাস ও নানারকম ইনডোর প্ল্যান্টও মিলছে এবারের মেলায়। নাম জানা ও অজানা শত-সহস্র রকমের ফুলের রূপ দেখে চোখ জুড়াবে, মন হবে বিমোহিত। মন হারিয়ে যাবে বিলুপ্তপ্রায় নানা ধরনের দৃষ্টিনন্দন গাছের রূপ দেখে ও সবুজ পরশে।

আরো রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের প্রায় ২০০ প্রজাতির বাঁশগাছের তথ্য, বৃক্ষসংবলিত স্টল এবং খেজুরসহ সৌদি আরবের খেজুরগাছ। পরিচিত হতে পারবেন বিভিন্ন বনজ ও ঔষধি গাছের সঙ্গে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের তৈরি নান্দনিক সব মৃৎশিল্পের সৌন্দর্যেও হবেন মুগ্ধ।

গাছের প্রতি আগ্রহ

মেলায় বৃক্ষপ্রেমীদের ভিড় পরিলক্ষিত হয়। মেলায় আসা এক বৃক্ষপ্রেমী জানান, মূলত ছাদবাগান গড়ে তুলতে মেলা থেকে গাছের চারা কিনেছেন।

মতিঝিল থেকে আসা ক্রেতা নয়ন বলেন, ‘বারোমাসি ফলের চারা কিনতে মেলায় আসা। মেলায় একসঙ্গে অনেক নার্সারির স্টল পাওয়া যায়। তাই এই মেলাটার প্রতি আমার বেশি আগ্রহ।’

Tree-Fair-3

ধানমন্ডি থেকে আসা শিক্ষার্থী আনিকা নিজের রুমের সৌন্দর্য বাড়াতে গাছ কিনতে এসেছেন। আনিকা বলেন, ‘গাছ দেখতে খুব ভালো লাগে, মন ভালো হয়ে যায়।’ তিনি ক্যাকটাস ও আরো কয়েকটি গাছ কিনেছেন। আরো একদিন তার মাকে সঙ্গে নিয়ে বৃক্ষমেলায় আসার ইচ্ছা আছে তার। আজ কয়েকটি গাছ কিনেছেন, আরো কয়েকটি গাছ কিনবেন বলেও জানান তিনি।

রাজধানীর উত্তরা থেকে মেলায় আসা ফুয়াদ মল্লিক বলেন, প্রতিবছরই বৃক্ষমেলায় আসি। নিজের প্রয়োজনেই এখানে আসতেই হয়। তার নিজের একটি ছাদবাগান রয়েছে। বাগানের জন্য নানারকম গাছ কিনতেই আসা।

তিনি বলেন, বৃক্ষ ও ফল-ফুল সবসময় আমাকে আকৃষ্ট করে। এখানে এসে একই সঙ্গে দেখা মেলে নাম জানা-না জানা নানারকমের বৃক্ষের সঙ্গে, ফলের সঙ্গে আর ফুলের সঙ্গে, যা আমাকে মুগ্ধই করে না, করে বিমোহিত। এবার বেশকিছু ফুলের ও ফলের গাছ কিনেছি। কিছু বনজ ও ঔষধি গাছ এবং দেশে বিলুপ্তপ্রায় বিরল কিছু গাছ কেনার ইচ্ছা আছে।’

বিক্রেতাদের কথা

‘কিশোরগঞ্জ নার্সারি’র মো. কাঞ্চন জানান, প্রথম দিকেই বিক্রি বেশি ভালো ছিল। এখন বিক্রি কম। তার এ স্টলে প্রায় ১০ হাজার গাছ রয়েছে। তার নার্সারিতে ফল-ফুল, ইনডোর প্ল্যান্টসহ বিভিন্ন ধরনের গাছ রয়েছে। ‘মহুয়া নার্সারি’র মো. কালু মিয়া জানান, তারা কেরানীগঞ্জ থেকে এসেছেন। ১২ জন কাজ করেন। মেলার সবচেয়ে বড় ক্যাকটাস তাদের স্টলে রয়েছে, যার মূল্য ৩৫ হাজার টাকা।

‘খান নার্সারি’র সজীব বলেন, তাদের এখানে ২০০ রকমের গাছ রয়েছে। রাজনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল হলে বেচাকেনা বাড়বে বলে তিনি মনে করেন। ‘ব্র্যাক নার্সারি’র সারা দেশে ১৫টি নার্সারি রয়েছে। এ স্টলে পাঁচ টাকা থেকে সর্বনিম্ন দাম শুরু। সর্বোচ্চ দেড় টাকা মূল্যের বনসাঁই গাছ রয়েছে।

‘ইউনিক নার্সারি’র মালিক দেওয়ান মাসুদের সঙ্গে মেলায় কথা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করা এই বৃক্ষ ও প্রকৃতিপ্রেমী এবারের বৃক্ষমেলা প্রসঙ্গে বলেন, তার নার্সারিতে ফল, ফুল এবং অন্যান্য গাছ মিলিয়ে প্রায় ৫০০ প্রজাতির গাছ আছে; যেমন মিষ্টি ও লাল দুই রকমের তেঁতুল, সাদা জাম ও মিষ্টি জলপাই গাছের চারা, সফেদা, ডেউয়া, লটকন, জলপাই, লেবু, জাম্বুরা, আতা, গাব, কাজুবাদাম, করমচা, জামরুল, আমলকী, অড়বরই, কাউফলসহ বিভিন্ন দেশি ফলের চারা ও বড় গাছ আছে। বিদেশি ফলের মধ্যে আছে অ্যাভোকাডো, পার্সিমন, রাম্বুটান, লঙ্গান, ডুরিয়ান, মিসরীয় ডুমুরসহ নানা প্রজাতির গাছ।

Tree-Fair-4

মেলায় ঘুরতে ঘুরতে নানারকম মসলার গাছের দেখা মেলে। রাশিদা নার্সারির বিক্রেতা কাইয়ুম হাসান জানান, এলাচি, চুইঝাল, গোলমরিচ, দারুচিনি, তেজপাতা—এসবের চারা পাওয়া যাবে আকার অনুসারে ৩০০ থেকে দুই হাজার টাকায়।

এনার্জি প্যাক এগ্রো লিমিটেডের স্টলে রয়েছে কয়েক ধরনের নারিকেল ও সুপারিগাছ। স্টলের বিক্রয়কর্মী জানান, তাদের এখানে ‘কাঞ্চনপুরি, মালয়েশিয়ান, শ্রীলঙ্কান, ভিয়েতনামি, কেরালা, মিয়ানমার ও বারি-৪’ জাতের নারকেলের চারা আছে। এসব চারার দাম সর্বনিম্ন ২০০ থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে।

বৃক্ষমেলা কেন করা হয়

বৃক্ষমেলা করার মূল উদ্দেশ্য হলো বৃক্ষরোপণকে একটি অভিযানে রূপান্তরিত করা এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা। জলবায়ু পরিবর্তন আজ আর কোনো ভবিষ্যদ্বাণী নয়, বাস্তবতা। অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি—এগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পৃথিবী হবে বাসযোগ্যতাহীন। তাই সবুজ পৃথিবী গড়ার অঙ্গীকার আমাদের টিকে থাকার জন্য জরুরি প্রয়োজন। তাই বেশি বেশি গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত