ঢাকা টু জিরো পয়েন্ট: পথে যেতে দেখা…

মুহাম্মদ জাভেদ হাকিম
প্রকাশ : ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ১৩: ৫২

ক্যালেন্ডারের পাতায় ছুটির লাল চিহ্ন দেখলেই মাথা ঘুরপাক খায়। মনে হয় যেন কতকাল যাইনি কোথাও। অথচ দুই সপ্তাহ আগেই ঘুরে এসেছি। রক্তের সঙ্গে ভ্রমণের নেশা লেপ্টে গেলে যা হয়। এমনিতেই আমাদের দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের অন্যতম স্লোগান—‘এসো বন্ধু ভ্রমণনেশায় আসক্ত হই।’ সত্যিই ভ্রমণনেশায় আমরা পুরাই বুঁদ হয়ে থাকি।

বাসের টিকিট না পেয়ে বন্ধু নাজমুল ভাইয়াকে নিয়ে বিবেক নিজেই চালকের আসনে বসে চার চাকা নিয়ে হাজির। বিবেককে মিথ্যা ভয় দেখিয়ে থামাতে চাইলাম; বললাম, ‘আসা-যাওয়া এক হাজার পাঁচশ কিলোমিটার।’ বিবেক বলল, ‘ভয় পাই না, দোস্ত।’ ‘ভয় যখন পাচ্ছ না, তাহলে চলো।’ যাচ্ছি চার বন্ধু। ভ্রমণসঙ্গী জিয়ার কথা একটাই—‘আমরা যেহেতু কোনো বরযাত্রায় যাচ্ছি না, তাহলে যেথায় খুশি সেথায় থামতে সমস্যা নেই। দরকার হলে তিন দিন লাগিয়ে বাংলাবান্ধা যাব।’ কতটা আবেগজড়ানো কথামালা!

বিজ্ঞাপন

যেতে যেতে সিরাজগঞ্জ চায়না বাঁধে। বাঁধ থেকে যমুনা ব্রিজের নান্দনিক সৌন্দর্য অসাধারণ। সেইসঙ্গে সাদা কাশফুলের নরম ছোঁয়া। দুদিকে নদী, মাঝখানে বাঁধ। মূল ফটক থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার সড়ক চলে গেছে চায়না বাঁধের শেষ অবধি। এই বাঁধের আরেক নাম ক্রসবার-৩। পুরো পরিবার নিয়ে সারাটা দিন সবুজ গালিচায় বসে নীল আসমান দেখতে দেখতে, কিংবা যমুনা নদীতে নৌভ্রমণ করে কাটিয়ে দেওয়া যাবে। নদীর বুকে জেগে ওঠা চরগুলোয়ও ইঞ্জিন নৌকায় করে গিয়ে ঘোরা যাবে।

যমুনার মাতাল হাওয়ায় যখন মশগুল, তখনই চালক বন্ধুর হাঁকডাক। গাড়ি স্টার্ট। আবারও ছুটলাম। যেতে যেতে বগুড়া শহরে ব্রেক। নামকরা এক রেস্তোরাঁয় নানা পদ দিয়ে দুপুরের আহার সারলাম। ওদিকে রংপুরের ভ্রমণবন্ধু শাকিলের মোবাইল কল—‘ভাই, কই?’ ওরে অভয় দিয়ে বলি, ‘টেনশন না করে রান্না করতে থাকো।’ হেলেদুলে পুরি, শিঙাড়া, পেঁয়াজু, দই ও মিষ্টি চাখতে চাখতে সন্ধ্যা ৭টায় রংপুর শহরের রবার্টসনগঞ্জ পৌঁছাই। সেখানে আগেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলেন জনৈক জবিয়ান বড় ভাই।

তিনি তো নাছোড়বান্দা—খিচুড়ি খাইয়ে ছাড়লেন। বহুকাল পরে দেখা বড় ভাইয়ের ভালোবাসা আর আতিথেয়তায় রাতটা রংপুরেই কাটাতে মনস্থির করলাম। সরকারি এক বালাখানায় প্রবেশ করে ফ্রেশ হয়ে রাতেই শহর ঘুরতে বেরিয়ে পড়ি। বেশ পরিপাটি শহর। পুজোর আনুষ্ঠানিকতা থাকায় রাতগভীরেও পথেঘাটে মানুষের বেশ সমাগম। ইতোমধ্যে শাকিলের বাসায় হানা। সবাই নিজের মনে করায় ওর সারা দিনের পরিশ্রম করা নানা পদের রান্না মুহূর্তেই সাবাড়। যমুনা নদীর কাতলা মাছের তরকারির স্বাদটা ছিল অতুলনীয়। পুরুষ হলেও তার হাতের রান্নার মজা একেবারে পাক্কা রাঁধুনি গুণধর গৃহিণীদের মতো। ওর খালি ফ্ল্যাটে চুটিয়ে আড্ডা মেরে রাতগভীরে ফিরি বালাখানায়। সুইমিংপুলে সারা দিনের ক্লান্তি ঝেড়ে ফ্রেশ একটা ঘুম।

amar2

সকালে ঘুম ভাঙলেই ত্বরিত গতিতে রেডি। শুরুতেই চলে যাই তাজহাট জমিদার বাড়ি। প্রবেশ ফি দিয়ে ফটকের ভেতর ঢুকতেই চোখ ধাঁধিয়ে যায় বিশাল আঙিনা দেখে। সেই আঙিনায় সবুজের সমাহার। জমিদারবাড়ির স্থাপত্যশৈলী চমৎকার। মহারাজা কুমার গোপাল লাল রায় বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বাড়িটির নির্মাণকাজ শুরু করিয়েছিলেন। শেষ করতে প্রায় ১০ বছর লেগেছিল। সেই ১৯১৭ সালেই এর নির্মাণব্যয় হয়েছিল প্রায় দেড় কোটি টাকা। তাজ হাট জমিদার বাড়িটি আগে ৩৫ একর নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হলেও এটি এখন মাত্র ১৬ একর আয়তন নিয়ে টিকে রয়েছে।

রংপুরের প্রাচীন নিদর্শন তাজহাট জমিদার বাড়িটি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক প্রাসাদগুলোর মধ্যে একটি। প্রাসাদটি প্রায় ২১০ ফুটের মতো প্রশস্ত। এর উচ্চতা প্রায় চারতলার মতো উঁচু। মোট ৩১টি সিঁড়ির প্রতিটিই মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি। প্রাসাদটিতে একটি গুপ্ত সিঁড়ি রয়েছে। জনশ্রুতি রয়েছে গুপ্ত সিড়িঁটি কোনো একটি সুড়ঙ্গের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ঘাঘাট নদীর সঙ্গে মিশেছে। নিরাপত্তাজনিত কারণে এখন সিঁড়িটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রাসাদের ফোয়ারা শ্বেতশুভ্র মার্বেল পাথরে মোড়ানো। কথিত আছে দৃষ্টিনন্দন ফোয়ারাটি বিশেষ করে ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে রানির জন্যই করা হয়েছিল। এখানেও প্রমাণিত, গুণবতী নারীরা সর্বকালেই পুরুষের কাছে সম্মানিত। তাজহাট জমিদারবাড়ি তথা রাজপ্রাসাদটির সম্মুখভাগ প্রায় ৭৬ মিটার পূর্ব দিকে মুখ করা। প্রাসাদটির মাঝখানেও মার্বেল পাথরের তৈরি প্রশস্ত সিঁড়ি রয়েছে।

সবকিছু মিলিয়ে এর প্রতিষ্ঠাতা মহারাজা কুমার গোপাল লাল রায় এই দৃষ্টিনন্দন কারুকাজখচিত বাড়িটি মোগল স্থাপত্যশৈলীর অনুকরণে নির্মাণ করে তার শৈল্পিক রুচির পরিচয় দিয়েছেন। বর্তমানে এটি তাজহাট রাজবাড়ি জাদুঘর নামে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। প্রতি রোববার পূর্ণ ও সোমবার অর্ধদিবস-সহ সরকারি বিশেষ ছুটির দিনগুলোয় জাদুঘর বন্ধ থাকে।

এরপর চলে যাই কারুপণ্যের অফিস কারখানায়। যদিও এটা অফিস, কিন্তু তবুও ঘোরার ও অভিজ্ঞতা অর্জনের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। মূল ফটক দিয়ে ঢুকতেই চোখ ছানাবড়া। পুরো সাততলা ভবন লতাপাতায় ঘেরা। যেন বিশালাকার কোনো বাগানে রয়েছি। প্রাকৃতিকভাবে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য এই কার্যকর আয়োজন। এতে প্রায় ৮০ ভাগ বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয়েছে। ভেতরটাতেও রয়েছে বেশ নান্দনিকতার ছোঁয়া। সবকিছুই খুব সুন্দরভাবে সাজানো-গোছানো।

কারুপণ্যের হস্তশিল্পের কারখানা ও শতরঞ্জি বিক্রয় কেন্দ্র ঘুরে ছুটলাম বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। জুলাই বিপ্লবের প্রথম শহীদ ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ—শ্রদ্ধা ও স্মরণ। সবুজে ঘেরা সুবিশাল ক্যাম্পাস চোখে এক ধরনের প্রশান্তি এনে দেয়। পুরো ক্যাম্পাসটা ঘুরতে গেলে সময় লাগবে বেশ। তাই দেরি না করে গাড়ি ছুটল তিস্তা ব্যারাজ। যেতে যেতে গঙ্গাচড়া ব্রেক। জবিয়ান বন্ধু সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সুজনের আতিথেয়তা গ্রহণ করা ছাড়া এগোনো যাবে না। তার বাড়ির আঙিনায় প্রবেশ করতেই মনের ভেতর অন্যরকম শিহরন দোল খেলো। এ যেন ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মিশেলে অনন্য এক গৃহস্থ বাড়ি। দল বেঁধে চীনা হাঁসের ছুটে চলার মনোরম দৃশ্য আর ঘরের পাশেই সবুজ ধান ক্ষেত নজর কাড়ে।

amar

ভ্রমণ মানেই পরতে পরতে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়, মানসিক তৃপ্তি ও যাপিত জীবনের উত্তম শিক্ষা লাভ। জম্পেশ একটা ভূরিভোজ শেষে ছুটলাম তিস্তা ব্যারাজ। ছবির মতো সুন্দর গঙ্গাচড়ার প্রকৃতি দেখতে দেখতে তিস্তা ব্যারাজ যখন পৌঁছি, তখন সন্ধ্যার আলোও বিদায়। অপেশাদার চালক, তবে দক্ষ; গাড়ি নিয়ে চলল পঞ্চগড়। যেতে যেতে রাত প্রায় ১০টা। সরকারি এক গেস্ট হাউসে রাতটা কাটিয়ে পরদিন সকালে ছুটলাম কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে তেঁতুলিয়ায়।

প্রশস্ত সড়কে ভোরের হাওয়া গায়ে মেখে সীমান্ত নদী মহানন্দার তীরে যেতেই চোখে ধরা দিল দার্জিলিং পাহাড়মালা। কিন্তু কাঞ্চনজঙ্ঘার খবর নেই। তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো। জায়গাটা এখন মিনি পার্ক। সাধারণ ভ্রমণপিপাসুদের জন্য বিনোদনের খোরাক। দূরদেশের পাহাড় দেখার জন্য কেন যেন মনে ধৈর্য রইল না। সমতলের চা বাগানের কচি পাতার ঘ্রাণ শুঁকতে শুঁকতে বাংলাবান্ধার পথে। কিছু দূর গিয়েই সকালের নাশতা করতে করতে মাথায় খেলল, কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেটে ঢুঁ মারার ভাবনা। যেমন ভাবা তেমন কাজ।

গাড়ি ঘুরিয়ে রওশনপুর গ্রামের পথে। গ্রামে ঢুকতেই দিল খোশ। নয়নাভিরাম সব চা বাগান। চোখজুড়ানো পরিপাটি গ্রাম। গাড়ি এগোতে এগোতে কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেটের মূল ফটকে। ভেতরটা বাহারি রকমের গাছের লাতা, পাতা ও গুল্ম দিয়ে ঠাসা। আমরা ধীরলয়ে পায়ে হাঁটতে থাকি। তৃপ্ত চিত্তে চারপাশের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে আমাদের দু’নয়ন জুড়ে মুগ্ধতা। যত এগোতে থাকি ততই পুলকিত ও শিহরিত হই।

ব্যক্তিমালিকানাধীন ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত অরগানিক চা উৎপাদনের জন্য টি এস্টেটের অফিস ও বাংলো প্রকৃতির মেলবন্ধনে সাজিয়েছে বেশ। বাংলোগুলোর সম্মুখে সবুজ ঘাসের প্রান্তরের পাশে সুদৃশ্য লেকও রয়েছে। আরো রয়েছে সারি সারি হরেক রকমের ছোট-বড় গাছ। গাছের ছায়ায় লেকের ধারে বসে অনায়াসে প্রেয়সীর জন্য একটি মনভোলানো গদ্য কবিতা লেখা যাবে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম—তিনিও অনেক জায়গায় গিয়ে প্রেমের খেয়ায় ভেসেছেন।

Screenshot 2025-11-09 134244

এবার দেশের শেষ সীমান্ত বাংলাবান্ধা যাত্রা শুরু। সেখানে গিয়ে তো পুরোই গোলকধাঁধা। এক দশকেরও বেশি সময় আগে যেমনটি দেখে গিয়েছিলাম, এখন আর তেমনটি নেই। বর্তমানে এতটাই আধুনিকায়ন করা হয়েছে যে, সাধারণ ভ্রমণপিপাসুদের জন্য এটি একটি বিনোদনমূলক পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তর হয়ে উঠেছে।

হিমালয়কন্যা পঞ্চগড় জেলার সর্বোত্তরের তেঁতুলিয়া উপজেলার ১নং বাংলাবান্ধা ইউনিয়নে অবস্থিত বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট। ১৯৯৭ সালে এখানে স্থলবন্দর স্থাপন করা হয়েছিল। কংক্রিট দিয়ে তৈরি বিশালাকার একটি জিরো—কারোই দৃষ্টি এড়াবে না। মূলত সেই জিরো স্থান থেকেই ভারতের পাশে বাংলাদেশের সীমানা শুরু। জিরোর অপর প্রান্তে রয়েছে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা, যা শত্রুর প্রতি কঠিন মনোবল আর মিত্রর প্রতি মোলায়েম মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ বহন করে। বাংলাবান্ধা দিয়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানির পাশাপাশি সীমিত আকারে যাত্রীরাও যাতায়াত করতে পারে। প্রকৃতির চাদরে সবুজে ঘেরা বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট থেকে ভারতের শিলিগুড়ি মাত্র সাত কিলোমিটার, দার্জিলিং ৫৮ কিলোমিটার। আর আরেক প্রতিবেশী দেশ নেপাল মাত্র ৩০ কিলোমিটার। বাংলাবান্ধা ভ্রমণে সবচেয়ে বেশি ভালোলাগার ব্যাপারটা হলো, আপনি একেবারে দেশের মানচিত্রের মাথায় অবস্থান করার একটা অব্যক্ত অনুভূতি অনুভব করতে পারবেন। বলে কাউকে বোঝাতে পারবেন না সেই অনুভূতির কথা। এটা বুঝতে হলে নয়নাভিরাম বাংলাবান্ধা যেতেই হবে।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

পদ্মার দুর্গম চরে কাকন ও মণ্ডল বাহিনীর বিরুদ্ধে ‘অপারেশন ফার্স্ট লাইট’

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পিআর অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি তুহিন, সা. সম্পাদক আবু সাদাত

বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে হামলায় হাইমচরে ইউপি সদস্য গ্রেপ্তার

দুই উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি প্রাথমিক শিক্ষকদের

রংপুরে চিকিৎসার অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে মানববন্ধন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত