আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

নিলার ‘গরবা গুদি’

রুশিতা রূপন্তী
নিলার ‘গরবা গুদি’

নিলার জন্ম কিংবা বেড়ে ওঠা পাহাড় ও হ্রদবেষ্টিত জেলা রাঙামাটিতে। চাকরির পেছনে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিলেন, কাপ্তাই লেকের যে দ্বীপে তার বাড়ি, সে দ্বীপটিকে গড়ে তুলবেন পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে। সেই ভাবনা থেকে প্রথমে শুরু করলেন গরবা গুদি রেস্তোরাঁ, তারপর হোমস্টে। এখন বছরজুড়ে গরবা গুদিতে লেগে থাকে পর্যটকের আনাগোনা। রাঙামাটি জেলার প্রথম হোমস্টে তৈরির যাত্রাটা খুব একটা সহজ ছিল না নিলার জন্য। এই অদম্য পাহাড়ি কন্যার গল্প লিখেছেন রুশিতা রূপন্তী

চারপাশে সারি সারি পাহাড় আর তার কোলজুড়ে বয়ে গেছে কাপ্তাই হ্রদ। সেই হ্রদের ভেতর ছোট ছোট দ্বীপ। তেমনই এক দ্বীপে নিলার বাড়ি। আশপাশে কোনো কোলাহল নেই, জীবনের ব্যস্ততা নেই। নৌকা আর মাঝিদের গুনগুন গানের শব্দে সেখানে যেন সময় বয়ে চলে আয়েশি মেজাজে। রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার মগবান ইউনিয়নের কাপ্তাই নেভি ক্যাম্পের বিপরীতে, দোখাইয়াপাড়া এলাকায় এই নির্জন দ্বীপটির অবস্থান।

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বিএ শেষ করেন নিলা। পড়ুয়া অবস্থায় অনলাইন পোর্টালে কাজ শুরু করেন। এরপর চট্টগ্রামের একটি পত্রিকায় শিক্ষানবিশ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেন। তবে বেতন ঠিকমতো না হওয়া ও কম হওয়ার কারণে তাকে চাকরি এবং চট্টগ্রাম শহর ছেড়ে দিতে হয়। এদিকে তার বাবা পঙ্গু। মা আর ছোট ভাই মিলে পেরে উঠছেন না সবদিক সামলাতে। এমন পরিস্থিতিতে সংসারের হাল ধরবে কে? তাকে নিজের বসতভিটেয় রেস্তোরাঁ করার পরামর্শ দেন পরিচিত দুই ভাই। কিন্তু টাকা কোথায় পাবেন? তখন তারাই নিলাকে ৩০ হাজার টাকা ধার দেন, যা এক বছরের ভেতর বিনা সুদে তাকে শোধ করে দিতে হবে। সেই শুরু।

Gorban

নিলা রেস্তোরাঁর নাম দেন ‘গরবা গুদি’। চাকমা ভাষায় গরবা মানে মেহমান বা অতিথি, গুদি মানে রুম। অর্থাৎ গরবা গুদি মানে মেহমানের রুম। পর্যটকদের আশানুরূপ সাড়া পেয়ে সেখানে তাদের থাকার ব্যবস্থাও শুরু করেন তিনি। নিজেদের থাকার দুটি কক্ষ ছেড়ে দেন পর্যটকদের জন্য। সাদামাটা কিন্তু নান্দনিকভাবে সাজিয়ে তোলেন মাটির ঘরের সেই গৃহকোণ। এভাবেই রাঙামাটি জেলার প্রথম হোমস্টে গড়ে ওঠে নিলার হাত ধরে। এরই মধ্যে নিলা ঢাকা ও চট্টগ্রামে পর্যটন নিয়ে একাধিক ট্রেনিং ও সেমিনারেও অংশগ্রহণ করেন, যাতে পর্যটনশিল্প সম্পর্কে আরো জ্ঞান অর্জন করা যায়।

অনুপ্রেরণা ও অবদানের কথা বলতে গিয়ে নিলা বলেন, ‘যে বড় ভাইয়েরা টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন, যাদের পরামর্শে গড়ে উঠেছে গরবা গুদি, তারাই মূল অনুপ্রেরণা। আর তা ছাড়া আমরা মূলত পরিবারের সব সদস্য মিলে কাজ করছি। মা রাঁধেন, ভাই বাজার করেন, আমি পর্যটকদের সামলাই। তাই গরবা গুদিতে সবচেয়ে বড় অবদান আমার মা আর ভাইয়ের। তারা সহযোগিতা না করলে এতদূর আসা যেত না।’

এই হোমস্টেতে গেলে থাকা-খাওয়া, শীতকালে ক্যাম্পিং, পাহাড়ি খাবারের স্বাদ নেওয়া, নৌকা চালানো, হ্রদের জলে গোসল করা, আদিবাসী গ্রাম ভ্রমণ, ইঞ্জিনচালিত বোট দিয়ে রাঙামাটির দর্শনীয় স্থানে ঘোরা, আদিবাসীদের বিভিন্ন কাপড় ও ফল কেনার সুযোগ পাবেন। এমনকি গরবা গুদির দ্বীপের ফলের গাছ থেকে ফল পেরে খাওয়ার সুযোগও রয়েছে। তিনবেলা খাবারের ভেতর আছে কাপ্তাই হ্রদের সুস্বাদু মাছ, পাহাড়ি মুরগি, নানা রকম ভর্তা ও তাজা সবজি। খাবার পরিবেশন করা হয় মাচাংঘরে। খাবার খেতে হয় হাঁটু মুড়িয়ে পাটিতে বসে, চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী মেজাংয়ে (বাঁশ দিয়ে তৈরি খাবার রাখার এক ধরনের মোড়া) খাবার রেখে। হ্রদ আর পাহাড়ঘেরা পরিবেশ, মিষ্টি হাওয়া সেসব খাবারের স্বাদ আরো বাড়িয়ে তোলে। মাত্র ২৫০-৩০০ টাকায় ভরপেট খাওয়া যায় এই মেহমানখানায়।

Gorba

অন্যদিকে, মাটির ঘর হওয়ার দরুন থাকার জায়গাটিও খুব প্রশান্তির। কামরায় বিশেষ কোনো আসবাব নেই। শুধু খাট একটা কোনায় রাখা, একটা টেবিল এবং টুকটাক সেল্‌ফ। মাঝ বরাবর কাঠ দিয়ে তৈরি রঙের আল্পনা করা জানালা। জানালা দিয়ে দেখা যায় হ্রদ আর পাহাড়ের সৌন্দর্য। আকাশের নিচে রাত কাটাতে চাইলে তাঁবুতেও থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। এমনকি চাইলে বাঁশ দিয়ে তৈরি মাচাংয়েও রয়েছে থাকার সুযোগ। হোমস্টে ও মাচাংয়ে রাত কাটানোর জন্য ৩০০ টাকা আর তাঁবুতে রাত কাটালে ৩৫০ টাকা লাগে প্রতি রাতের জন্য। গরবা গুদির মাত্র চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরে রয়েছে স্থানীয় আদিবাসীদের চাকমা বাজার। স্থানীয়রা অনেকেই একে চেনেন ধনপাতা বা ধানপাতা বাজার হিসেবে। আদিবাসীদের তৈরি নানা রকম পণ্য ও জিনিসপত্র পাওয়া যায় এখানে। গরবা গুদি থেকে নৌকায় চড়ে সেখানে যাওয়ারও সুযোগ আছে পর্যটকদের।

প্রতিবন্ধকতার কথা বলতে গিয়ে নিলা বলেন, ‘আসলে একজন উদ্যোক্তা হওয়া এত সহজ নয়। পদে পদে প্রতিবন্ধকতা, একটা একটা করে সমাধান করছি, করেই যাচ্ছি। তবে সবচেয়ে যে বিষয়টি প্রতিবন্ধকতা মনে হয়, নিজস্ব পার্কিং লট না থাকা। আমাদের গরবায় বাই রোডে আসা যায় না। যেসব গরবা নিজেদের গাড়ি নিয়ে আসেন, তাদের গাড়ি রাখতে বেশ অসুবিধা হয়। সামরিক এলাকা কাছে হওয়ায় বিকাল ৫টার পর গাড়ি রাখতে দেন না। যদি কেউ ভুলে রাখেন, তাহলে শুরু হয় নানা সমস্যা। এ ছাড়া হোমস্টে পরিচালনার জন্য নানা কথা শুনতে হয়েছে। অনেকের ধারণা, আমি মেয়ে বলে আমার হোমস্টেতে পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে। আমার মনে হয়, পর্যটন খাতে পাহাড় কিংবা সমতল এখনো পুরোপুরি উপযোগী নয়। তবে থেমে থাকার সুযোগ নেই। এগোতে হবে, বাধাকে জয় করতে হবে। এভাবেই হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগোচ্ছি।’

পর্যটনশিল্প কিংবা গরবা গুদি নিয়ে নিলার কিছু স্বপ্ন আছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের আশপাশের গ্রামের মানুষ খুব গরিব। বেশিরভাগই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। এসব জনগোষ্ঠীকে পর্যটন খাতে সংশ্লিষ্ট করার ইচ্ছে আছে। যেমন ধরুন, একজন কৃষক তার পণ্য কিংবা জেলেরা তাদের মাছ যেন পর্যটকদের কাছে বিক্রি করতে পারেন। পাহাড়ের নিজস্ব সংস্কৃতি দেখিয়ে যেন আশপাশের মানুষজন চলতে পারেন। যেমন : কোমর তাঁত কীভাবে বুনে, কী কী উপাদান লাগে তা পর্যটকদের দেখানো, তা থেকে সামান্য টাকা নেওয়া ইত্যাদি। আমার পাশাপাশি চারপাশের মানুষজনও যাতে উপকৃত হন পর্যটকদের দ্বারা, এটাই চাওয়া। আর আমি চাই বাংলাদেশে প্রচুর হোমস্টে গড়ে উঠুক। পর্যটনশিল্পে হোমস্টেটা খুব জরুরি। বিভিন্ন দেশেই এই হোমস্টের কালচার বা সুব্যবস্থা থাকলেও আমাদের দেশে তা নেই বললেই চলে। এ ব্যাপারটা নিয়ে ভাবা উচিত।’

নিলা মনে করেন, শুধু কমার্শিয়াল চিন্তার জন্য হোটেল, রিসোর্ট, হোমস্টে করা থেকে বিরত থাকতে হবে। অর্থাৎ, পরিবেশ ধ্বংস করে এ খাতে না আসাই ভালো। এ প্রসঙ্গে নিলা বলেন, ‘পাহাড়, গাছ, নদী-নালা ভরাট করে গড়ে তোলা হয় বড় বড় হোটেল, রিসোর্ট। অথচ পরিবেশকে অক্ষত রেখেই সুন্দর কাজ করা যায়। এই খাত খুবই সম্ভাবনার। এখানে প্রতিটি সেক্টরে লোকবলের দরকার হয়। কিঞ্চিৎ প্রশিক্ষণ নিয়ে হাউস কিপিং, শেপ, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ এমন অনেক কাজ নিয়ে হোটেল ও রিসোর্টে কাজ করা যায়। শুধু কী তাই? বিদেশেও রয়েছে এর বিরাট সম্ভাবনা। আমি মনে করি, এই খাতে বেকারদের যুক্ত হওয়া উচিত।’

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন