ফুটবল মাঠের স্বপ্নপ্রদর্শক জয়া

রাজিয়া সুলতানা
প্রকাশ : ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ১৪: ৫৫
ছবি: সংগৃহীত

পাহাড়ের প্রাকৃতিক সম্পদ আমাদের অপার সৌন্দর্যের নির্মল অনুভূতি দেয়। এই পাহাড়ই যে প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অবদান রাখা রত্নও উপহার দিয়ে চলেছে, তার খোঁজ আমরা কজন রাখি? রাঙামাটির পাহাড়ি ছায়াঘেরা সবুজ প্রকৃতির কোলে বেড়ে উঠেছেন বাংলাদেশের সফল নারী ফুটবলার, দেশের প্রথম আন্তর্জাতিক নারী রেফারি জয়া চাকমা।

বিজ্ঞাপন

ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি এক অদ্ভুত টান অনুভব করতেন তিনি। ফুটবলকে বেছে নিয়েছিলেন তার ভালোবাসা ও দেশসেবার অনুষঙ্গ হিসেবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলোয়াড় কোটায় ভর্তি হওয়ার সুযোগককে তিনি জীবনের মোড় ঘুরে যাওয়া ঘটনা হিসেবে দেখেন। তিনি অনুভব করেন যে, ফুটবল শুধু খেলা নয়; এটি তাকে জীবনের গভীরতা ও নতুন সম্ভাবনার পথ দেখিয়েছে।

অঙ্কুরের গল্প

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম নারী রেফারি হিসেবে পদচিহ্নের স্বপ্ন দেখেন ২০১৩ সালে। সে বছর জয়া বাংলাদেশের হয়ে কলম্বোর একটি টুর্নামেন্টে অংশ নেন। সেখানে গিয়ে তিনি প্রথমবার বুঝতে পারেন, রেফারিং কেবল খেলার একটি অংশ নয়, এটি একটি সম্মানজনক পেশা। অন্যান্য দেশের রেফারিদের দেখে তার নিজেকে দেখার চোখ খুলে যায়। তিনি গভীরভাবে পর্যালোচনা করে দেখেন ভিনদেশি আন্তর্জাতিক রেফারিদের জ্ঞান, ব্যক্তিত্ব, জীবনধারা, মর্যাদা সবকিছু আলাদা। বাংলাদেশ থেকে কোনো ফিফার রেফারি নেই, এই উপলব্ধি তাকে নাড়া দেয়। নিজের ভেতরে এক প্রতিজ্ঞা তৈরি করেন, ‘আমি ফিফার রেফারি হব।’

চ্যালেঞ্জ

এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ ছিল পাহাড়ের মতোই আঁকাবাঁকা, অথচ দৃঢ়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চিরাচরিত দৃষ্টিভঙ্গির বেড়াজালে পড়ে একজন নারী রেফারি হিসেবে তাকে বারবার প্রমাণ করতে হয়েছে নিজের যোগ্যতা। একবার বঙ্গমাতা টুর্নামেন্টে ঢাকার একটি দলের খেলোয়াড়রা ঘোষণা দিল, তারা খেলবে না যদি জয়া ম্যাচ পরিচালনা করেন। অথচ তার জায়গায় একজন কম অভিজ্ঞ পুরুষ রেফারি হলেও আপত্তি করত না কেউ।

এই অভিজ্ঞতাগুলো খুব সহজ ছিল না। তার মনের মধ্যে প্রশ্ন জেগে উঠত, ‘আমি যদি পুরুষ হতাম, তাহলে কি এই একই ব্যবহার পেতাম?’ সঙ্গে ছিল তার নিজস্ব সংখ্যালঘু স্বকীয় পরিচয়, যা চ্যালেঞ্জগুলোকে আরও জটিল করে তুলত কখনও কখনও। কিন্তু জয়া চাকমা অসাধারণ আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন নারী, যাকে এই চ্যালেঞ্জগুলো থামাতে পারেনি। বরং এগুলো তাকে আরও শক্তি দিয়েছে, তার সঙ্গে কথা বললে সে শক্তি আপনিও অনুভব করতে পারবেন।

পূর্ণতার অনুভূতি

কঠোর পরিশ্রম, ধৈর্য আর অধ্যাবসায়ের এক জ্বলন্ত উদাহরণ জয়া চাকমা। ২০১৭ থেকে ২০১৯, পরপর তিনবার তিনি আন্তর্জাতিক রেফারি হওয়ার পরীক্ষায় বসেন। ২০১৯ সালে তৃতীয়বারের চেষ্টায় তিনি ফিফার রেফারি হিসেবে সম্মানজনক স্বীকৃতি পান। ২০১৩-২০২০ নিজের সঙ্গে করা প্রতিজ্ঞা পূরণের এক অসাধারণ যাত্রা; জীবনের এক বিশাল অধ্যায়ের পূর্ণতা। কিন্তু জয়া মনে করেন, জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন বা পুরস্কার অন্য জায়গায়। তিনি বর্তমানে বিকেএসপিতে ফুটবল কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সেখানে আসা ছোট ছোট ছেলেমেয়ের ভালোবাসা, মুগ্ধতা, স্বপ্ন, মেধা, তাকে নীরব অনুসরণ জয়াকে জীবনের সত্যিকারের পূর্ণতা দিয়েছে। তিনি যখন বিভিন্ন দেশের সফর শেষে অভিজ্ঞতার গল্পগুলো বলেন, আর শিশুদের চোখে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখতে পান- এটি তাকে আনন্দ দেয়, পেশাগতভাবে আরও বেশি দায়বদ্ধ করে তোলে।

কেউ যখন বলে ‘আমি তোমার মতো হতে চাই’, জয়া আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। বিনয়ী জয়া সব সময় মনে করেন, যারা তাকে ভালোবাসে বা অনুসরণ করে, তার নির্দেশনা মেনে চলে, সব কৃতিত্ব আসলে তাদের- তারা অসাধারণ, তাই জয়াকে ভালোবাসেন।

নারী ফুটবলের ভবিষ্যৎ

জয়ার মতে, বাংলাদেশে নারী ফুটবলারের অংশগ্রহণ বাড়ছে, কিন্তু এখনও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। বিকেএসপিতে প্রতি বছর ১৫ জন বাচ্চা ভর্তি হলেও, ন্যাশনাল টিমে যায় মাত্র ১১ জন। বাকিদের জন্য বিকল্প ক্যারিয়ার নেই। মেয়েদের টিমের প্রচার, আর্থিক নিরাপত্তা এবং সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা এখনও যথেষ্ট নয়। তবু তিনি স্বপ্ন দেখেন। মনে করেন, যদি মেয়েরা নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণে ধৈর্যশীল হয়, শিক্ষা এবং মানসিক শক্তি থাকে, তবে তারা যে কোনো প্রতিকূলতা অতিক্রম করতে পারে।

শেষ কথা

জয়ার জীবন যেন একটি প্রেরণার উপাখ্যান। অভিজ্ঞতা দিয়ে তিনি শুধু নিজের স্বপ্নই পূরণ করেননি, বরং অনেকের জন্য পথপ্রদর্শক হয়ে উঠেছেন। তার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো ছোট ছোট ছেলেমেয়ের চোখে স্বপ্ন দেখার সাহস জাগিয়ে তোলা।

‘আমি যা পেয়েছি, তা ফুটবলের জন্য। আর আজ আমি যা দিচ্ছি, তা ফুটবলের ঋণ শোধ করার একটি ছোট্ট চেষ্টা,’ বলেন জয়া। তার এই চেষ্টাই বাংলাদেশের নারী ফুটবল এবং ক্রীড়াক্ষেত্রের জন্য এক আলোকবর্তিকা।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত