সুইটির বাঁশ-বেতের ব্যবসা

ওমর শাহেদ
প্রকাশ : ০৭ আগস্ট ২০২৫, ১০: ১৫
আপডেট : ০৭ আগস্ট ২০২৫, ১২: ২৫

সুইটি সূত্রধর বাঁশ-বেত দিয়ে নানা ধরনের পণ্য তৈরি করেন। এর মধ্যে রয়েছে কলমদানি, ফুলের টব, বিভিন্ন ডিজাইনের ল্যাম্প স্ট্যান্ড, টুল, মোড়া, লুকিং গ্লাস, বাঁশ ও বেতের তৈরি সোফা, চেয়ার ইত্যাদি।

বিজ্ঞাপন

সুইটি চেয়েছিলেন সরকারি চাকরি করবেন। অনেক ঘুরেও চাকরি পাননি। আবার প্রাইভেট চাকরিও পোষাচ্ছিল না। কেননা এখানে চাইলেই কিছু করা যাবে না।

সুইটি সূত্রধর একটি মাইক্রো ক্রেডিট কোম্পানিতে চাকরি করতেন। মোট সাত বছর সেখানে ছিলেন। তবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণকালে প্রতিষ্ঠানটি চালিয়ে নেওয়া খুব কষ্টকর হয়ে পড়ে। তিনি তখন ইনচার্জের দায়িত্ব পালন করছিলেন। সব দায়দায়িত্ব তার ওপর ছিল। গ্রাহকরা অফিসে এসে তার কাছে তাদের সঞ্চয়ের টাকা ফেরত চান। এ ব্যাপারে মালিকপক্ষের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হন। তারা তাকে সব চালিয়ে নিয়ে যেতে বলেন। একসময় তাদের গাফিলতির কারণে সুইটি চাকরিটি ছেড়ে দিলেন। এরপর তিনি অনলাইনে ঘাঁটাঘাঁটি করে ঠিক করলেন, অনলাইন ব্যবসা করবেন। এতে খুব বেশি মূলধনের প্রয়োজন হয় না, যা ছিল আরেকটি সুবিধাজনক দিক।

এর মধ্যে সিলেট সদর উপজেলার সমবায় অধিদপ্তর থেকে রেজিস্ট্রেশন করলেন। তারা ২৯ জন মিলে একটি সমিতি করলেন। তার আগের সাত বছরের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থাকায় সাহস পেলেন। অফিসের কার্যক্রম শুরু করতে গিয়ে মনে হলো ডেকোরেশন করা দরকার। অন্য কোনো মেটাল দিয়ে কাজ করালে যে খরচ আসবে, তার পক্ষে তখন সেই খরচ করা সম্ভব ছিল না। ইউটিউবে দেখলেন, বাঁশ দিয়ে খুব সুন্দর সুন্দর জিনিস তৈরি করা যায়। অফিসের জন্য বাঁশ ও বেতের পণ্য কিনলেন। আর তারও খুব ইচ্ছা হলো, অনলাইনে কিছু করবেন। ভেবে দেখলেন, বাঁশ নিয়ে কাজ করলে হাতের কাছে কাঁচামাল পাবেন। এই চিন্তা থেকে ১৫০ টাকার বাঁশ কিনে নিজেই কাজ শুরু করলেন আপন ভুবনে।

প্রথমে ছোট ছোট জিনিস বানানোর চেষ্টা করলেন—ওয়াল ম্যাট, কলমদানি, ফুলের টব ইত্যাদি। বাঁশ ও বেতের কাজের জিনিসপত্র এদেশের ঐতিহ্য। সিলেটের একটি পাড়ায় পুরো বেতের কাজ করে কারিগররা সংসার চালাতেন। হঠাৎ প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় এই শিল্পগুলো প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। করোনা মহামারির পর মানুষ আবার একটু একটু করে এই শিল্পগুলো খুঁজে বের করছেন। দেশের চেয়ে বিদেশে বাঁশ ও বেতের পণ্যের চাহিদা অনেক বেশি। ফলে তিনিও এদিকে ঝুঁকে পড়লেন।

তিনি নানা ধরনের পণ্য তৈরি করেন। ছোট ছোট শোপিস থেকে ঘরের কাজে ব্যবহার হয় এমন পণ্যও তৈরি করেন। তিনি বিভিন্ন ডিজাইনের ল্যাম্প, টুল, মোড়া, লুকিং গ্লাস, বাঁশ ও বেতের তৈরি সোফা এবং চেয়ার তৈরি করে বিক্রি করেন। কাস্টমাইজড প্রোডাক্টগুলো বিক্রি করেন বেশি। প্রথমে তাদের সমিতির অফিসে দু-তিনটা প্রোডাক্ট তৈরি করে অফিস সাজাতেন। এভাবে অনেক পণ্য হয়ে গেল। তার নিজের অনলাইনে পেজ ছিল, সেখানে এ ব্যাপারে পোস্ট করতেন। ধীরে ধীরে এগুলো তার পরিচিতজনদের চোখে পড়ল। তারা খুব ভালো কমেন্ট করতেন। অনেকে বলতেন, খুব সুন্দর বাঁশের তৈরি পণ্য। এতে তার উৎসাহ আরো বেড়ে যেত। অনলাইনের মাধ্যমে তার বিক্রি শুরু। এ পণ্যগুলো তিনি বানাতেন তার বাসার ড্রইং রুমে। প্রথমে তিনি নিজেই তৈরি করতেন। পরে পার্ট টাইম কাজের জন্য এক সহযোগী নিয়ে এলেন। তিনি রাজমিস্ত্রি। সুইটি কাজ দেখিয়ে দিতেন, আর তিনি তৈরি করতেন। মোটামুটি বানাতেন। এরপর আরো একজনকে নিয়ে এলেন। তিনি কাঠমিস্ত্রি ছিলেন। এখন ফুলটাইম-পার্টটাইম মিলে মোট ১৫ জন পুরুষ ও নারী শ্রমিক তার সঙ্গে কাজ করছেন। তার মতে, কারিগরদের সঙ্গে আন্তরিক হয়ে কাজ না করলে এই ব্যবসা ফলপ্রসূ হয় না।

AmarDesh_Suiti-2

তাদের তৈরি পণ্যগুলোর কোয়ালিটি মেইনটেইন করতে গিয়ে দাম একটু বেশি পড়ে। তবে আড়ংয়ের সঙ্গে তুলনা করলে দাম কম। সুইটি জানালেন, পণ্য বুঝে দাম কম-বেশি হয়। তবে এই বাঁশ-বেতের পণ্যগুলোর ক্রেতা এখনো সবাই হয়ে উঠতে পারেননি। ২০২২ সাল থেকে নিজের আলাদা এই পণ্যের ব্যবসা করছেন।

শুরুর দিকের হতাশা তার একদম নেই। তখন এই ব্যবসা নিয়ে প্রায় দেড়টি বছর অনেক স্ট্রাগল করেছেন। প্রথম দিকে লোকজন হাসাহাসি করত; বলত, ‘কে নেবে এই বাঁশের পণ্য?’ নিজেকে সামলে নিয়ে ধৈর্যসহ অনেক ঝড়-তুফান উপেক্ষা করে একটি কারখানা ও একটি শোরুম করেছেন। শোরুম হলো এসএস গ্যালারি ক্র্যাফট। এটি সিলেট সদরে।

Sweety

এই ব্যবসা করতে গিয়ে অনেক মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তার, আছে স্মরণীয় স্মৃতি। জেলা সমবায় অফিস থেকে মেলায় অংশগ্রহণের অফার পেয়েছেন প্রথম বছরেই। যতটুকু পণ্য ছিল তার, সেগুলো নিয়েই মেলায় অংশগ্রহণ করেছেন। বেতের কিছু পণ্য নিয়ে গেছেন। মেলায় তেমন বিক্রি না হলেও সুন্দর পণ্যগুলোর দৌলতে অফিসারদের অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছেন। এসএমই মেলায় একটি বাঁশের গেট তৈরি করে দিলেন। পাঁচ থেকে ১০ হাজার মানুষ গেটের সামনে ছবি তুলেছেন। সিলেটের ডিসি সার্কিট হাউস ও তার বাংলোয় এই গেট ভাড়া করে নিয়েছেন। সিলেট সদর উপজেলার সাবেক ইউএনও নাছরীন আক্তার তাকে অনেক সহায়তা করেছেন। তিনি বিভিন্ন পণ্যের ডিজাইন দিতেন বানিয়ে দেওয়ার জন্য। সেগুলো তৈরি হলে তিনি কিনে অফিসারদের গিফট করতেন। তার এ ধরনের সহযোগিতার ফলে সুইটি হাল ছেড়ে দিতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত হাল ছাড়েননি। তিনি তাকে এত উৎসাহ দিয়েছেন, যে কারণে সুইটি যেকোনো পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পেরেছেন। সুইটি তার (নাছরীন আক্তার) কাছে কৃতজ্ঞ।

এই ব্যবসার পাশাপাশি লেদ মেশিন দিয়ে লোহার নানা ধরনের পণ্য তৈরি করান তিনি। এটি তার পার্টস ব্যবসা। সেখানে কাজ করেন আরো চার কর্মচারী। স্টাফ নিয়ে দুটো কারখানাই নিজে দেখাশোনা করেন। তিনি বললেন, মেয়েমানুষ হয়ে দিনরাত কাজ করা খুব কঠিন। একমাত্র মেয়েকেও খুব একটা সময় দিতে পারেন না। ব্যবসার পেছনে দিনে প্রায় ১৫ থেকে ১৬ ঘণ্টা সময় দিতে হয়। তিনি একা একা এ পর্যন্ত এসেছেন।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত