ফুসতাত থেকে দুবাই

এহসানুল হক জসীম
প্রকাশ : ০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ২১: ৫১

দুবাই। সংযুক্ত আরব আমিরাতের সবচেয়ে বড় শহর। ইউরোপের উন্নত ও জাঁকজমকপূর্ণ শহরগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলছে, অনেক ক্ষেত্রে বিশ্বের অনেক উন্নত শহরকেও ছাড়িয়ে গেছে। মরুর বুকের চোখধাঁধানো আকাশচুম্বী অট্টালিকার এই শহরে ভ্রমণে গিয়ে হারিয়ে যাওয়া ফুসতাত নগরীর কথা মনে পড়ে যায়। বর্তমান মিসরের একটি প্রাচীন নগরীর নাম ফুসতাত। মুসলিমদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ও বিকশিত; মুসলিম সভ্যতার নিদর্শনের অন্যতম ধারক-বাহক। ১২শ শতাব্দীতে সমৃদ্ধির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে গিয়েছিল এই নগরী। মুসলিমদের দ্বারা আরও কয়েকটি নগরী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং বিকশিত হয়েছিল।

বিজ্ঞাপন

মুসলিম বিশ্বের শহর দুবাইয়ের আজকের চাকচিক্য দেখলে মনে পড়ে যায় নগরসভ্যতায় মুসলিমদের অবদানের কথা, প্রাচীন ফুসতাত নগরীর কথা, বাগদাদ কিংবা দামেশকের কথা, গ্রানাডার কথা। দুবাইয়ের সুরম্য প্রাসাদগুলো দেখে মনে পড়ে যায় মুসলিম শাসনামলে স্পেনে নির্মিত মুসলিম স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন আল-হামরা প্রাসাদের কথা। আল-হামরার ভেতরে গিয়ে দাঁড়ালে অনেকে স্তব্ধ হয়ে যায়। এক মহাজাগতিক সৌন্দর্য আচ্ছন্ন করে রাখে। এই প্রাসাদটি ইসলামি স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন ও মুসলিম বিশ্বের সংরক্ষিত প্রাসাদগুলোর মধ্যে একটি। এটি গ্রানাডা শহরে অবস্থিত, যে শহরটির গোড়াপত্তন করে মুসলিমরা। ১২৩৮ সালে প্রথম নাসরি আমির মুহাম্মদ ইবনে আল-আহমার আল-হামরার নির্মাণকাজ শুরু করেন এবং পঞ্চম মুহাম্মদের শাসনামলে নির্মাণকাজ শেষ হয়। স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে ‘রয়্যাল প্যালেস’ বানিয়েছিল মুসলিমরা। এই প্রাসাদে তিন ৪১৮টি কক্ষ আছে, মেঝের আয়তন এক লাখ ৩৫ হাজার বর্গমিটার। প্রাসাদের অভ্যন্তরীণ সজ্জা খুবই চমকপ্রদ। কর্ডোভার উমাইয়াদ আমির প্রথম মুহাম্মদ এই প্রাসাদটি প্রথম নির্মাণ করেন। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সময়ে এর পুনর্নির্মাণ কাজ চলে।

স্পেনে মুসলমানরা আধ্যাত্মিকতার এক নিদারুণ নিদর্শনও রেখে গেছে, যা যে কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এসব স্থাপনার মধ্যে কর্ডোভা জামে মসজিদ একটি। অভিনব নৈপুণ্যশৈলীতে নির্মিত এই স্থাপনা মুসলিম ঐতিহ্যের এক রাজসাক্ষী। খলিফা আবদুর রাহমান আদ দাখেলের আমলে ৭৮৬ সালে স্পেনের তৎকালীন রাজধানী কর্ডোভায় নির্মাণ করা হয় ঐতিহাসিক অনন্য ও অনিন্দ্য সুন্দর এই মসজিদ।

ইস্তানবুলের তোপকাপি প্রাসাদ কি কম আকর্ষণীয়? ১৪৫৯ সালে কনস্ট্যান্টিনোপল বিজয়ের পর সুলতান দ্বিতীয় মুহম্মদ বসফরাস প্রণালীর তীরে এই প্রাসাদের নির্মাণকাজ শুরু করেন। ১৯২৩ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর এটিকে জাদুঘরে পরিণত করা হয়। তুরস্কে আজ এটি একটি পর্যটন কেন্দ্র। মুসলিম শাসনামলে দিল্লিতে গড়ে উঠেছিল যেসব প্রাসাদ, আধুনিক যুগে এসেও আজকের ভারত তেমন করে সুরম্য ভবন গড়ে তুলতে পারেনি। আগ্রার তাজমহলের সৌন্দর্য সবাইকে বিমোহিত করে।

ফিরে আসি ফুসতাতের কথায়। হজরত উমর (রা.)-এর শাসনামলে এই বিখ্যাত শহরটির গোড়াপত্তন হয়েছিল, যখন অমুসলিমরা নগরসভ্যতার কথা কল্পনাও করতে পারেনি। আমর ইবনুল আসের নেতৃত্বে ৬৪১ খ্রিস্টাব্দে মিসর জয়ের পর রাজধানী স্থাপনের উদ্দেশ্যে নীল নদের তীরে এই শহরটি নির্মাণ করা হয়। প্রায় ৫০০ বছর এটি মিসরের রাজধানী ছিল। ফাতেমীয়রা ৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে ফুসতাতের উত্তরে খলিফার রাজকীয় আবাস হিসেবে কায়রো নগরী গড়ে তুলেছিল। আস্তে আস্তে হারিয়ে যায় ফুসতাত।

ইসলাম গরিব-দুঃখী-মেহনতি মানুষবান্ধব ধর্ম; কিন্তু গরিব ধর্ম নয়। আভিজাত্য, রুচিশীলতা ও সভ্যতার ধর্ম ইসলাম। মানবজনমের শুরু থেকে শোভনীয় অবকাঠামো নির্মাণ আর স্থাপত্যকলায় অসাধারণ অবদান রেখে আসছে মুসলিমরা। হযরত আদম (আ.)-এর হাত ধরেই পৃথিবীতে প্রথম স্থাপত্যশিল্পের বিকাশ ঘটে। প্রথম নবীর হাত দিয়ে বানানো ঘরগুলো ছিল বৃহৎ ও লতাপাতায় নির্মিত। কাবাঘরও নির্মাণ করেছেন আমাদের এই আদি পিতা। ইব্রাহীম (আ.) ও তাঁর ছেলে ইসমাইল (আ.) মিলে কাবাঘর পুনর্নির্মাণ করেছেন। আজকের কাবাঘর ইব্রাহীম (আ.)-এর নকশা অনুযায়ী নির্মিত। মুসলমানদের প্রথম কিবলা মসজিদুল আকসাও নির্মিত হয়েছে কয়েকজন নবী ও মুসলিম মনীষীদের হাতে।

হযরত মুহাম্মাদ (সা.) নগরসভ্যতা বিকাশে বেশ ভূমিকা রাখেন। ৬২২ খ্রিস্টাব্দে তিনি মদীনায় হিজরত করার পর প্রথমে মসজিদে কুবা নির্মাণ করেন। কিছুদিন পর নির্মাণ করেন মসজিদে নববী। এর আগে আরবের লোকেরা উট ও ভেড়ার লোম দিয়ে তৈরি তাঁবুতে বসবাস করত। আর ইয়াসরিবের নামই মদিনা বা শহর হয়ে গেছে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমনের সঙ্গে সঙ্গে।

উমাইয়া শাসনামলে নগরায়ণ ও স্থাপত্যশিল্পে বেশ উন্নতি সাধিত হয়। নগরসভ্যতায় নতুন দুয়ার খোলেন আব্বাসীয়রা। ৭৬২ সালে বাগদাদ প্রতিষ্ঠা করেন খলিফা আল-মনসুর। আবহাওয়া, অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা, সামাজিক নিরাপত্তা ও সামরিক দিক বিবেচনায় রেখে শহরটি নির্মাণ করা হয়। বাগদাদ নগর প্রতিষ্ঠার পর ৭৭২ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাক্কা শহর প্রতিষ্ঠা করেন।

এভাবে নগরসভ্যতা বিকাশে মুসলিমরা পৃথিবীতে ব্যাপক অবদান রেখেছিল। একটা পর্যায়ে মুসলিমরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে পড়ে, নগরসভ্যতায় পিছিয়ে পড়ে। ইউরোপের শহরগুলো তখন এগোতে থাকে বা ইউরোপে নগরসভ্যতা বিকশিত হতে থাকে। বর্তমান পৃথিবীতে নগরসভ্যতায় ইউরোপ এগিয়ে। কিন্তু দুবাই শহর যেভাবে উন্নতি করেছে এবং উন্নত হচ্ছে তাতে ইউরোপের বহু উন্নত শহরকে ছাড়িয়ে গেছে। দুবাই শহরের চাকচিক্য মুসলিমদের নগরসভ্যতার অবদানকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ফুসতাতের কথা মনে করিয়ে দেয়।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী, পিএইচডি গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বিষয়:

দুবাই
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত