মমিন সরকারের ‘ই-কৃষি ক্লিনিক’

ফরহাদ আলম
প্রকাশ : ১৮ মার্চ ২০২৫, ১২: ৩৯

তখন করোনার সময়। মো. মমিন সরকার ছিলেন বাড়িতে। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। দেখলেন বেশিরভাগ কৃষক পরামর্শ নেন প্রতিবেশী কৃষক থেকে। আবার কেউ কেউ কীটনাশকের দোকান থেকে। তাদের ভুল পরামর্শে জমি ও পরিবেশের যেমন ক্ষতি হয়, তেমনি বিষাক্ত হয় ফসলও। তাই নিরাপদ ফসল উৎপাদন নিশ্চিতের লক্ষ্যে শুরু করেন ডিজিটাল সেবাকেন্দ্র ‘ই-কৃষি ক্লিনিক’।

যাত্রা শুরু

‘জমি আপনার, দায়িত্ব আমাদের’ প্রতিপাদ্যকে ধারণ করে ২০২০ সালে করোনা মহামারির সময় শুরু । বর্তমানে ‘ই- কৃষি ক্লিনিক’ এক লাখের অধিক চাষির বৃহৎ পরিবার। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলার পাথেয় অত্যধিক পরিশ্রম ও সবার সহযোগিতা। ফসল উৎপাদনে কৃষকদের সঠিক দিকনির্দেশনা, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনসহ রোগবালাইনাশক কীটনাশকের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতকরণ সর্বাত্মকভাবে প্রয়োজন। কৃষকদের সরাসরি প্রশিক্ষণের জন্য কৃষিবিদ কনসালট্যান্সি, রোগ নির্ণয় ও সঠিক পরিচর্যার জন্য ফসলের চিকিৎসা, অনলাইনকে কেন্দ্র করে ই-ফার্মিং, ই-ট্রেনিং, ই-কৃষি ক্লিনিক শপসহ বিনামূল্যে কৃষকদের বিভিন্ন কাজে সরাসরি সেবা দিয়ে থাকেন তারা।

ভাবনায় পুরো দেশ

মমিন সরকারের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা টাঙ্গাইলের ঘাঁটাইল উপজেলায়। শুধু নিজ এলাকা নয়, ভেবেছেন পুরো দেশের কথা। অনলাইনের মাধ্যমে খুব সহজে সারাদেশে সেবা পৌঁছে যাবেÑএ ভাবনা থেকেই কয়েকজন কৃষিবিদকে সঙ্গে নিয়ে ফেসবুকভিত্তিক কার্যক্রম শুরু করেন। মানুষের চিকিৎসার জন্য ক্লিনিক বা হাসপাতাল আছে কিন্তু গাছের চিকিৎসার জন্য এমন কিছু নেই। এ ভাবনা থেকে নাম দেন ই-কৃষি ক্লিনিক। যেখানে মানুষ ঘরে বসে ফসলের সঠিক চিকিৎসা ও পরামর্শ পাবেন। আর চাষি ভাইদের সেবায় কাজ করবে দক্ষ কৃষিবিদ টিম।

যত কাজ

মমিন সরকার বলেন, ‘আমরা একঝাঁক তরুণ কৃষিবিদ টিম নিয়ে কাজ করছি। চাষি ভাইবোনদের জন্য ১০ জনের কোর টিম কাজ করছে। এ ছাড়া আমাদের সহযোগিতা করছেন কৃষি কর্মকর্তা, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক। আমরা সবাই মিলে কৃষির আধুনিকায়নে কাজ করে যাচ্ছি। কনসালট্যান্সি দিয়ে আমাদের কার্যক্রম শুরু করেছিলাম। গত চার বছরে ২০ হাজারের অধিক কৃষক আমাদের থেকে সেবা নিয়েছেন। বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় আমরা কৃষিসেবা পৌঁছে দিতে পেরেছি। এ ছাড়া রয়েছে আমাদের অনলাইন কৃষি প্রশিক্ষণ। কৃষিতে অনেক তরুণ শিক্ষিত যুবক যুক্ত হচ্ছে দিন দিন। তাদের অনেকেই কৃষিতে অনভিজ্ঞ। দক্ষ কৃষি উদ্যোক্তা তৈরিতে আমরাই বাংলাদেশে প্রথম তিন মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ শুরু করি। যেখানে বেসিক থেকে মাঠপর্যায় পর্যন্ত ধরে ধরে শেখানো হয়। ইতোমধ্যে আমরা ৭০০ কৃষক, কৃষি উদ্যোক্তা ও কীটনাশক বিক্রেতাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। অনলাইনের পাশাপাশি আয়োজন করা হয় ফিল্ড ভিজিট। গত বছরের ডিসেম্বরে কৃষি বিষয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী ও কৃষকদের জন্য দুই মাসব্যাপী প্লান্ট ডক্টর কোর্স চালু হয়। যেখানে মাটি, বীজ ও সারের ব্যবহার, ফসলের পোকা ও রোগ শনাক্তকরণ, ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া ও অ্যান্টিবায়োটিক পরিচিতি, কেঁচো স্যার ও ট্রাইকো কম্পোস্ট তৈরি, ধান, ভুট্টা, গম, সরিষা, সূর্যমুখীর সঠিক চাষ পদ্ধতিসহ আধুনিক পদ্ধতিতে সবজি চাষ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হাতেকলমে শেখান ১০-এর অধিক প্রশিক্ষক।

sau e-clinic 2

ই-ফার্মিং প্রজেক্ট

নিরাপদ ফসল চাষ নিশ্চিত করতে ই-ফার্মিং প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করেন তারা। সুনামগঞ্জ, সিলেট, ফরিদপুর, গোদাগাড়ী, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, লালমনিরহাট ও চট্টগ্রামে ই-কৃষি ক্লিনিকের তত্ত্বাবধানে চাষ হয় ফসল। যেখানে সরাসরি প্রান্তিক কৃষকদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে সক্ষম করে তোলা হয়। এই প্রজেক্টের আওতায় কৃষকদের স্বাবলম্বী করাসহ বীজ চারাগাছ সরবরাহও করা হয় । পাশাপাশি নিরাপদ ফসল উৎপাদনবিষয়ক দুটি ক্যাম্পেইন সিলেট ও সুনামগঞ্জে সম্পন্ন হয়। প্রায় ২০০ কৃষক অংশগ্রহণ করেন।

প্রতিবন্ধকতা

কাজের পরিধি বিস্তৃত হওয়ায় চাপ বেড়েছে বলে জানান মমিন সরকার । তিনি বলেন, চাষিদের সব সময় পরামর্শ দিতে হয়। এ জন্য বেশি জনবল প্রয়োজন। আর এ কাজকে টেকসই করতে দক্ষ কনসালট্যান্ট প্রয়োজন, পর্যাপ্ত ফান্ড না থাকায় আমাদের পক্ষে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া এটাকে আরো প্রযুক্তিনির্ভর ও যুগোপযোগী করতেও প্রয়োজন অর্থ। মমিন সরকার বলেন, শুরুর দিকে গাছের সঠিক রোগ নির্ণয় বেশি চ্যালেঞ্জিং ছিল। দেখা যায়, অনলাইনে বিশেষ করে ফেসবুকে অসংখ্য কৃষিভিত্তিক গ্রুপ ও পেজ আছে। কিন্তু সেখানেও একেক রকম পরামর্শে কৃষক আরো চিন্তায় পড়েন, কোনটা অনুসরণ করবেন। সে জায়গা থেকে এখন ই-কৃষি ক্লিনিক সারাদেশে কৃষক ভাইদের আস্থার জায়গা। কারণ সঠিক সমস্যা নির্ণয় না করে তারা পরামর্শ দেয় না। আর এই সঠিক চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে গবেষকদের সহযোগিতা নিয়ে থাকি। যাতে একজন কৃষক সঠিক পরামর্শ পান।

টিমওয়ার্ক

আমাদের সঙ্গে বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিবিদ শিক্ষার্থীরা কাজ করছেন। এ ছাড়া যখন যে এলাকায় যাওয়া হয়, সেখানকার কিছু তরুণ সরাসরি সময় এবং শ্রম দিয়ে সহযোগিতা করে। তারা সেবামূলক মনোভাব নিয়ে আমাদের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। সবাই যার যার জায়গা থেকে অনলাইনে সেবা দিচ্ছে এবং আমাদের কাজে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। এ ছাড়া শুরু থেকেই অনুপ্রেরণা দিয়ে আসছেন শেকৃবির উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক আবুল হাসনাত মো. সোলায়মান, যিনি চিফ অ্যাডভাইজার। এ ছাড়া শেকৃবির উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহমেদ, কৃষি কর্মকর্তা শিবব্রত ভৌমিক আমাদের অ্যাডভাইজার হিসেবে আছেন। তারা সব সময় পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দিয়ে আসছেন। কো-ফাউন্ডার হিসেবে ছিলেন কৃষিবিদ আফরা নাওরান। এ ছাড়া আছেন শেকৃবির মো. সুজন, রাবেয়া খাতুন, সাকিব সামি, নাজমুল হাজি মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সৈয়দা শাহনাজ পারভীন, রায়হান হোসাইন, তানভীর আহমেদ, সীমান্ত, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তাসলিমুন হাসান রাকিব।

sau-e-clinic-3

আগামীর পরিকল্পনা

মমিন সরকার বলেন, ‘আমরা চাই আগামীর কৃষি হবে প্রযুক্তিনির্ভর। কৃষক হবেন চিন্তামুক্ত, ঘরে বসে তাৎক্ষণিক যেকোনো সেবা পাবেন। প্রতিটি কৃষকের দোরগোড়ায় আমাদের সেবা পৌঁছে দিতে চাই। এ জন্য আমরা কৃষি সার্ভিসবিষয়ক আ্যাপস তৈরি করার পরিকল্পনা করেছি, যেখানে কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত সব বিষয়ে সহযোগিতা পাবেন চাষিরা। যাতে তৈরি হবে দক্ষ কৃষক, নিশ্চিত হবে নিরাপদ ফসল উৎপাদন। এ ছাড়া আমরা দক্ষ কৃষি উদ্যোক্তা তৈরি করতে কাজ করে যাচ্ছি। আমরা চাই প্রতিটি উপজেলায় দক্ষ মডেল কৃষি উদ্যোক্তা তৈরি করতে। যারা আগামীর স্মার্ট ও বাণিজ্যিক কৃষিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।

বিষয়:

ফিচার
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত