গণগ্রেপ্তার, হত্যা ও নৃশংসতা

আবু সুফিয়ান
প্রকাশ : ২৪ জুলাই ২০২৫, ০৯: ২৫
আপডেট : ২৪ জুলাই ২০২৫, ১০: ৪৯
ছবি: সংগৃহীত

কোটা সংস্কারের দাবিতে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে হওয়া আন্দোলন দমনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ভয়াবহ রক্তাক্ত অভিযান চালায়। ন্যায্য এ আন্দোলন দমনে সরকার দেশজুড়ে চালায় হত্যাযজ্ঞ, গণগ্রেপ্তার করা হয় আন্দোলনকারীদের, চলে গুমের মহোৎসব এবং গুলি করে অন্ধ করে দেওয়া হয় বহু তরুণকে। রিয়া গোপের মতো অনেক শিশুর মৃত্যু সেই বর্বরতার চূড়ান্ত নিদর্শন হয়ে ওঠে।

বিজ্ঞাপন

হাসিনার সরকার গত বছরের ১৭ থেকে ২৪ জুলাইয়ের মধ্যে সারা দেশে অন্তত ৪ হাজার ৫শ’ জনকে গ্রেপ্তার করেছিল। এই সময়কালে ঢাকায় ১ হাজার ৭৫৮ জন, চট্টগ্রামে ৭০৩, গাজীপুরে ৩১২, নারায়ণগঞ্জে ২৩৯, ময়মনসিংহে ১২২, সিলেটে ১২১, টাঙ্গাইলে ১৬৬ ও কুমিল্লায় ১৩৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার অভিযানের লক্ষ্য ছিল হাজারো নিরীহ শিক্ষার্থী ও সাধারণ নাগরিককে হয়রানি এবং ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করা।

নারায়ণগঞ্জের নয়ামাটির ছাদে খেলার সময় বাবার কোলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয়েছিল সাড়ে ছয় বছরের শিশু রিয়া গোপের। পুলিশের ছোড়া গুলি তার মাথায় বিদ্ধ হয়—রক্তে ভিজে যায় বাবার বুক। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের পরে ৭২ ঘণ্টা টিকতে পারেনি সে। তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ লিখেছিল ‘গানশট ইনজুরি’।

এই শিশুটি ছিল দীপক ও বিউটি দম্পতির একমাত্র সন্তান। তার মুখ দেখা মাত্রই স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন, আর বাবা দীপক হাউমাউ করে বলেছিলেন, ‘আমার কোলেই মেয়ের মাথা থেকে রক্ত পড়ছিল।’

জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে কোটা আন্দোলনের সময় গুলিতে আহত হয়ে চিকিৎসা নেন ৪২৪ জন। এর মধ্যে ২৭৮ জনের চোখে অস্ত্রোপচার করতে হয়েছিল। অনেকের চোখে ছররা গুলির ক্ষত এতটাই মারাত্মক ছিল যে চিকিৎসকরাও নিশ্চিত করতে পারেননি তারা আর দুনিয়ার আলো দেখতে পারবেন কি না।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সহিংসতায় ২৪ জুলাই পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা সরকারি হিসাবে বেড়ে দাঁড়ায় ২০১ জনে। প্রকৃতপক্ষে এই সংখ্যা ছিল ৩ শতাধিক। নিহতরা ছিলেন গুলিবিদ্ধ এবং অধিকাংশই আন্দোলন বা পারিপার্শ্বিক ঘটনায় পুলিশি গুলির শিকার। অথচ হাসিনার সরকার কোনো সম্মিলিত মৃতের তালিকা প্রকাশ করেনি।

আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের ও রিফাত রশীদ নিখোঁজ থাকার পর ফিরে এসেছিলেন চোখ বাঁধা ও নিপীড়নের দাগ নিয়ে। তাদের জবানবন্দিতে উঠে এসেছিল—কীভাবে ইনজেকশন দিয়ে অচেতন রাখা হতো, চাপ দেওয়া হতো আন্দোলন স্থগিতের জন্য। একজনকে অন্ধকার কক্ষে আটকে রাখা হয়, আরেকজন প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে ছিলেন এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি।

সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হুমকি

আসাদুজ্জামান খান বলেছিলেন, আমরা আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে তাদের একের পর এক চিহ্নিত করব, আইনের মুখোমুখি করব।

তিনি এর সেনাবাহিনী মোতায়েন, কারফিউ জারি, এবং পুলিশ হত্যা, আগুন ও হামলার অভিযোগ তুলে দমনযন্ত্রকে আরও তীব্র করেন।

আন্দোলনকারীদের স্বাধীনতাবিরোধী, জঙ্গি ও বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে যুক্ত করে সরকার গোটা দেশের শিক্ষার্থীদের রাষ্ট্রদ্রোহী বানিয়ে দেয়।

ছাত্রলীগের পেটানো, মামলার বন্যা

ছাত্রলীগ ১৭ থেকে ২৪ জুলাই প্রকাশ্যে আন্দোলনকারীদের মারধর করে, গুলি ছোড়ে। সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ করা হয়, নেতাকর্মী ও ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করা হয়। শাহবাগ থানায় অন্তত ১১টি মামলা হয়, যেগুলোতে অধিকাংশ অভিযুক্ত ‘অজ্ঞাত’ রাখা হয়—যাতে নির্বিচারে গ্রেপ্তার সহজ হয়।

সেই সময় জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এসব দমননীতি ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নিন্দা জানায়।

আন্দোলনকারীরা চেয়েছিলেন কোটা পদ্ধতির ন্যায্য সংস্কার। কিন্তু হাসিনার সরকার সেই দাবিকে রূপ দিয়েছিল জঙ্গিবাদে, রাষ্ট্রদ্রোহে—এবং রক্তাক্ত এক দমনযন্ত্রে।

এই ইতিহাস হাসিনার শাসনের নির্মম চেহারা তুলে ধরে—যেখানে ছাত্র মানেই জঙ্গি, শিশু মানেই লক্ষ্যবস্তু, প্রতিবাদ মানেই দেশদ্রোহ। ২০২৪ সালের এই অধ্যায় থেকে যাবে গণতন্ত্রের নামে পরিচালিত এক ভয়ংকর ফ্যাসিবাদের কালো দলিল হিসেবে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত