মানুষের ভাষার যেমন ইতিহাস আছে, কবিতারও আছে এক গভীর আরম্ভ-বিন্দু। ভাষা শুধু মানুষের যোগাযোগের মাধ্যম নয়—এটি মানুষের অভিজ্ঞতা, চেতনা, আকাঙ্ক্ষা, রূপান্তর ও সভ্যতার নীরব দলিল। ভাষাকে বলা যায় মানব ইতিহাসের ছায়ালিপি। আর সেই ভাষাকে সবচেয়ে জীবন্ত, স্পর্শকাতর ও বিশুদ্ধ আবেগে রূপ দেন কবি।
কবিরা ভাষার বিবর্তনে কী যোগ করেন—এই প্রশ্নের নিশ্চয় কোনো সহজ-সরল উত্তর নেই। কবিরা কল্পনার জগতে কেন আশ্রয় নেন, কেন অসম্ভবকে আকাঙ্ক্ষা করেন, কেন প্রতিদিনের বাস্তবতার ভেতর থেকেও এক অতিরিক্ত বাস্তব তৈরি করেন—এসবের পেছনে লুকিয়ে আছে মানুষের আদিম মনস্তত্ত্ব এবং বোধের এক অন্তর্গত ইতিহাস।
টমসনের ভাষায়—‘অসম্ভবের আকাঙ্ক্ষা’ই কবিতার জন্মসূত্র। এই আকাঙ্ক্ষাই মানুষকে ভাষা দিয়েছে, আর ভাষাই হয়ে উঠেছে কবিতার প্রথম পদধ্বনি। সেই ধ্বনিতে মানুষ তার অস্তিত্বকে শনাক্ত করে; তার ভেতরের আলো, বেদনা, নৈঃসঙ্গ্য, বিস্ময়, ভক্তি—সবকিছুর গভীরতম রূপ খুঁজে পায়। ভাষার ধ্বনি বদলায়, কাল বদলায়, আর সেইসঙ্গে বদলায় কবিতার ধ্বনিও—নতুন নতুন আদলে আবির্ভূত হয় কাব্য।
একসময় ভাবা হতো, কবি মানে যিনি পৃথিবীর যথার্থ ও স্বাভাবিক চিত্রপট আঁকতে পারেন। কিন্তু দৃশ্যমানতা একমাত্র পথ নয়। কবিতার চিত্রকল্প চোখে দেখা কোনো বস্তুর পুনরুৎপাদন নয়; চিত্রকল্প হতে পারে গন্ধ, স্পর্শ, স্বাদ, শব্দ—একাধিক সংবেদী অঙ্গের যৌথ অনুভূতি, এমনকি বিমূর্ত বোধেরও প্রকাশ। এমিলি ডিকিনসন, এডিথ সিটওয়েল ও জীবনানন্দ দাশ যেভাবে গন্ধে আলো, সুরে রঙ, কুয়াশায় নারীর চলন বা ধানচালের ধূসর সুবাস অনুভব করান—সেইসবই দেখায়, চিত্রকল্প প্রকৃত অর্থে এক গভীর সংবেদনস্রোত।
তবু কেবল চিত্রকল্প দিয়েই কবিতা হয়, এমন নয়। চিত্রময়তা, বেদনা, আবেগ, রূপ—সবই কবিতার একেকটি অনুষঙ্গ; কিন্তু কবিতার মূল সত্তা তার ভাষার মধ্যে। প্রতিদিনের ব্যবহৃত শব্দই যখন কোনো অদৃশ্য জাদুতে এক নব অর্থমালা পায়, তখন শব্দ হয়ে ওঠে কবিতা। প্রশ্ন আসে—এই রূপান্তরের সূত্র কী? কেন সাধারণ শব্দ বিশেষ বিন্যাসে চিরন্তন হয়ে ওঠে? হয়তো কবিতা জীবনের প্রয়োজনের অতিরিক্ত আরেক প্রয়োজন, যেখানে শব্দ অনুভব-অতিব্যক্তির এক স্বাধীন স্থাপত্যরীতি লাভ করে। যেখানে কবির রক্তের ভেতরে গোপন থাকে তার অভাব, বেদনা, স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা।
কবির কাজ হলো অনুভূতির রূপান্তর—উদ্বেগ থেকে অনুধ্যানের প্রশান্তিতে উত্তরণ। কবিতা জন্মায় এই রূপান্তর-ক্রিয়ায়।
রোমান্টিক যুগে যেমন, আধুনিক যুগেও কবি জীবনের অবলোকন থেকে নতুন ভাষা তৈরি করেন। জন ডান যখন মাছির রক্তপান থেকেই প্রেমের একাত্মতা খুঁজে পান, তখন তিনি বাস্তবের গণ্ডি ছাড়িয়ে কল্পনার এক বৃহৎ জগৎ খুলে দেন, যা কবিতারই কাজ। বিনয় মজুমদার মজার ভাষায় দেখিয়েছিলেন, ‘রাস্তায় রিকশা নেই’ আর ‘পৃথিবীর রাস্তায় রিকশা নেই’—দুই বাক্যের পার্থক্যই আসলে কবিতা ও অ-কবিতার পার্থক্য। কারণ কবিতা সীমিত ঘটনা থেকে সৃষ্টি করে সর্বজনীনতা।
মানুষের জন্মগত আকাঙ্ক্ষা, ভয়, লড়াই, মায়া—এসবই কবিতার জন্মমাটি। ধর্ম, মিথ, রহস্য, ইন্দ্রজাল—এসব মানুষের চেতনায় যেভাবে প্রবেশ করে, সেভাবেই কবিতা মানুষের অভিজ্ঞতাকে ঐন্দ্রজালিক করে তোলে। কবিতার ঐন্দ্রজালিকতার এক দিক ছন্দ, সুর, ধ্বনি; আরেক দিক তার অলৌকিক অভিব্যক্তি। ভার্জিলের ‘এইনিড’, মিল্টনের ‘প্যারাডাইজ লস্ট’—সবখানেই কবিতা ঐশ্বরিক অনুপ্রেরণায় আবিষ্ট।
কিন্তু সমাজের এত মানুষের মধ্যে কবিকে চিনব কী করে? আর্তুর র্যাবো এই প্রশ্নের চমৎকার উত্তর দিয়েছেন: কবি নিজেকে এক দর্শনীয় মাধ্যমে রূপান্তরিত করেন; উন্মাদনা, যন্ত্রণা, বিষাদ, উন্মত্ততা—সব অনুভব তিনি একাগ্র সমর্পিতির মাধ্যমে ধারণ করেন, পরিশোধন করেন, তারপর শব্দরূপে প্রকাশ করেন। কবি কখনো অপরাধী, কখনো বেখেয়ালি, কখনো বিচ্ছিন্ন; তবু তিনি এক ধরনের অতিমানবীয় দৃষ্টিশক্তি নিয়ে পৃথিবীকে দেখেন এবং দেখান।
কবির হৃদয়ের বেদনা—ব্যক্তিগত হলেও—কল্পনার সাহায্যে যখন সর্বজনীন রসে রূপ পায়, তখনই কবিতা হয়ে ওঠে সৌন্দর্যময়। রিলকে তরুণ কবিকে লিখেছিলেন, শিল্পকর্ম শুধু তখনই ভালো, যখন তা আসবে অন্তর্গত প্রয়োজন থেকে। পৃথিবীর শব্দ না-শুনলেও, শৈশবের স্মৃতি একজন কবির ভেতরে অবারিত সম্পদের ভান্ডার হয়ে থাকে; সেই গভীর তলদেশ থেকেই আসে কবিতা।
কাফকা বলেছিলেন, কবি সবসময় এমন কিছু বলতে চান, যা ভাষায় রূপ দেওয়ার নয়, যা হাড়ের গভীরে অনুভূত। কবিতা আসলে অসংলগ্ন অনুভূতিকে সংলগ্ন করে তোলার শিল্প।
হরাক্লিটাস যেমন বলেছিলেন, ‘সূর্য প্রতিদিন নতুন’—কবিতার সূর্যও প্রতিদিন নতুন, কারণ প্রতিদিন মানুষের অভিজ্ঞতা নতুন। কবিতার রহস্যময় ঘূর্ণিতে প্রতিটি পাঠক তার নিজস্ব আকাশ খুঁজে পায়। কবিতা অসমাপ্ত শিল্প। কোনো কবি তার চিন্তার সব রূপ কখনোই ধরতে পারেন না—বছরের পর বছর ধরে তিনি এক কবিতাকেই বিভিন্নভাবে সম্পাদনা করেন মনে-মনে। একটি কবিতা আসলে আজীবন ধরে লেখা হয়।
তবু কবিতা শুধু ব্যক্তিগত অনুভূতির স্তূপ নয়। নিজের চোখ দিয়ে নয়—অনেক মানুষের চোখ দিয়ে দেখতে না পারলে কবিতার দর্শন অসম্পূর্ণ থাকে। স্ব-অভিজ্ঞতার স্বাদ যদি সীমিত কল্পনার স্তরে আটকে থাকে, তবে তা কবিতা হয় না—তা হয় ব্যক্তিগত বাক্যব্যায়াম মাত্র। কবিতার কাজ হলো এক বিকল্প বাস্তবতার নির্মাণ করা, যেখানে দুঃখও সুন্দর, হারানোও জ্যোৎস্নায় ভেজা, হাহাকারও আলোড়নে পূর্ণ। এই বিকল্প বাস্তব মানুষকে তাড়িত করে, কখনো মুগ্ধ করে, কখনো প্রতিবাদী করে।
কবিতা শব্দের নিছক ঝংকার নয়—কবি পাঠকের কাছে একটি চিঠি পাঠান, যা পাঠক তার নিজের অভিজ্ঞতায় নতুনভাবে পাঠ করে। কবিতার অন্দরমহলের সূত্র পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে কবি কখনো ছন্দ, কখনো দ্যোতনা, কখনো ভাবের গোপন দ্বার খুলে দেন। ছন্দের নির্দিষ্ট নিয়ম নেই; এজরা পাউন্ডের ভাষায়—যদি ছন্দে লিখতেই হয়, তবে এমন ছন্দে লেখা উচিত, যেটিতে আগে কেউ লেখেনি।
কবির কাজ হলো জীবনের অভ্যন্তরীণ সত্য অনুসন্ধান করা। তিনি জানেন না কোথায় কবিতা তাকে খুঁজে নেবে। কখনো অন্ধের মতো তিনি অনুভবের ভেতর হাঁটেন; জটিলতা, বিকল্প আশা, অবিশ্বাস, আকাঙ্ক্ষা—সবই তাকে ধাক্কা দেয়। ভাষার ধ্বনি তাকে অনুসরণ করে। শব্দ বাতাসে হাঁটে। কবির চোখ বন্ধ অথচ দৃষ্টি খোলা—এই দ্বৈততায় জন্ম নেয় কবিতার অভ্যন্তরীণ আলোক।
শেষ পর্যন্ত, কবিতা মানুষের যতখানি বাস্তব, ঠিক ততখানি অতিবাস্তব; যতখানি স্পর্শযোগ্য, ততখানি অস্পর্শীয়। কবির বেঁচে থাকা মানে নিজের অনুভূতির সঙ্গে নিত্য লড়াই, নিজের বেদনার সঙ্গে নিবিড় আলাপন, নিজের আনন্দের সঙ্গে গভীর উপলব্ধি। সেখান থেকেই উঠে আসে কবিতার সত্য, যা জীবনের অনুলিপি নয়; বরং জীবনের আরেক আয়োজন, আরেক বাস্তবতা, আরেক বিশুদ্ধ অস্তিত্ব।

