আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

জসীম উদ্‌দীনের ‘কবর’ জীবন

আহসান ইমাম
জসীম উদ্‌দীনের ‘কবর’ জীবন

সার-সংক্ষেপ: ‘কবর’ কবিতা বাংলা সাহিত্যের এক অনবদ্য সৃষ্টি। লোকজীবনের মাধ্যমে জসিম উদ্‌দীন বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতি, আবেগকে বিশেষ ভঙ্গিমায় উপস্থাপন করেছেন। এখানে লোকজীবন আর লোকউপাদানের ব্যবহারের দিকটি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পাঠ বিশ্লেষণের মাধ্যমে বর্ণনাত্মকভাবে বিষয়টি উপস্থাপিত হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

জসীম উদ্‌দীন বাংলা সাহিত্যের এক মহৎ সাহিত্যিক। যিনি বাঙালির আত্মপরিচয়ের সফল শৈল্পিক স্রষ্টা। লোকউপাদান আর লোকজীবনকে যিনি ব্যবহার করেছেন তার শিল্পসৃষ্টিতে। বাঙালির জাতীয়তাবাদের পরিচয় পাওয়া যায় যার জীবনযাপনে, কর্মে। সত্যনিষ্ঠ এবং মহৎ শিল্পী বলাটা তার ক্ষেত্রে অধিক সুবিধাজনক। মা, মাটি, শেকড় তার সাহিত্যের খোড়াক বলে সহজেই অনুমেয়। বাংলা ভাষা, বাঙালি, বাংলা সংস্কৃতি মিলেমিশে আছে জসীম উদ্‌দীনের সাহিত্যকর্মে।

লোকজীবনের সূতায় গাঁথা তার ‘কবর’ কবিতা। লোকউপাদান সেই গাঁথুনির প্রত্যেকটা ফুল। ‘কবর’ কবিতাকে বলা যায় লোকউপাদান আর লোকজীবনের মিশেলে এক অনন্য মালা। সেই সাথে এই মালার গন্ধ বাঙালির সহজ, সুন্দর নির্মল মানুষের। যার সুবাস আর সুগন্ধ পাঠককে আজও মোহিত করে রেখেছে। সব মহৎ সৃষ্টিরই জীবন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। ‘কবর’ কবিতা এই প্রসঙ্গে প্রাসঙ্গিক।

‘কবর’ কবিতার লোকজীবন যেন এদেশের প্রত্যেকটা আবেগী আর সহজ সরল, সৎ মানুষের জীবন। যে গল্প আছে কবিতাটিতে সেই গল্প বা কাহিনি যেন লোককাহিনি। যে আবেগ আছে তা যেন শুদ্ধ, পবিত্র আবেগ। যে পথ-ঘাট আর পরিবেশের কথা বলা আছে তা যেন একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমার মধ্যকার পরিবেশ যে পরিবেশের বা ভৌগোলিক সীমারেখার মানুষ একই ধরনের উদ্দেশ্য নিয়ে একই ধরনের জীবনযাপনে অভ্যস্ত থাকে আমরা যাকে লোকসংস্কৃতির বিদ্যায়তনিক পরিসরের সংজ্ঞায় ফেলতে পারি। অর্থাৎ ‘কবর’ কবিতাটি লোকসংস্কৃতির জীবনের মোড়কে মোরা লোকজীবন ভিত্তিক সাহিত্য।

আবহমান শাশ্বত বাংলার বাড়ির পরিবেশ, স্বর্ণের সাথে নারীর রূপের তুলনা এবং পুতুল খেলার মত লোকক্রীড়ার পরিচয় পাওয়া যায় কবিতাটির প্রথম চারলাইনে:

এইখানে তোর দাদীর কবর ডালিম-গাছের তলে,

তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।

এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,

পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।

(২০০৪:২১)

কবিতার প্রতিটি নারী চরিত্রের সৌন্দর্যের সাথে, ভালোবাসার মানুষের সাথে ‘সোনার মতন মুখ’ বলে সম্বোধন হয়েছে:

কোথাও কোথাও ‘সোনামুখ’, বলতে ভালোবাসার মানুষ তথা ছেলেসন্তানকেও বোঝানো হয়েছে;

ফিরে এসে দেখি সোনার প্রতিমা লুটায় পথের পরে।

সেই সোনামুখ গোলগাল হাত সকলি তেমন আছে,

  • (২০০৪:২৫)

আবার,

সেই সোনামুখ মলিন হয়েছে, ফোটেনা সেথায় হাসি,

  • (২০০৪:২৪)

‘ফুলের মতন মুখ’ উপমাও এসেছে ভালোবাসার মানুষ তথা মেয়ে সন্তানের ক্ষেত্রে:

ফুলের মতন মুখখানি তার দেখিতাম যবে চেয়ে,

  • (২০০৪:২৫)

গড়িয়া দিয়াছি কত সোনামুখ নাওয়ায়ে চোখের জলে।

  • (২০০৪:২২)

কৃষি জীবনের চিত্র, দাম্পত্য জীবনের লোকজ প্রেম, লোকতামাশা যেভাবে প্রকাশ পেয়েছে:

সোনালী ঊষায় সোনামুখে তার আমার নয়ন ভরি

লাঙল লইয়া ক্ষেতে ছুটিতাম গাঁয়ের ও-পথ ধরি।

যাইবার কালে ফিরে ফিরে তারে দেখে লইতাম কত,

এ কথা লইয়া ভাবি-সাব মোরে তামাশা করিত শত।

(২০০৪:২১)

লোকপ্রেমের স্বরূপ যেমন প্রকাশ পেয়েছে তেমনি লোকঅলংকার, লোকখাদ্য, হাট-বাজার, বিকিকিনি, সততা আর পবিত্রতার পরিচয়, সেইসাথে বাংলার বিবাহিত নারীর নাইওর যাওয়ার চিত্র:

বাপের বাড়িতে যাইবার কালে কহিত ধরিয়া পা,

আমারে দেখিতে যাইও কিন্তু উজান-তলীর গাঁ!

(২০০৪:২১)

আবার,

শাপ্লার হাটে তরমুজ বেচি ছ’পয়সা করি দেড়ী,

পুঁতির মালার এক ছড়া নিতে কখনও হতনা দেরি।

দেড় পয়সার তামাক এবং মাজন লইয়া গাঁটে,

সন্ধ্যা বেলায় ছুটে যাইতাম শ্বশুরবাড়ির বাটে!

হেস না- হেস না- শোন দাদু, সেই তামাক মাজন পেয়ে,

দাদী যে তোমার কত খুশী হত দেখতিস যদি চেয়ে।

(২০০৪:২১)

লোকঅঙ্গভঙ্গি:

নথ নেড়ে নেড়ে হাসিয়া কহিত, ‘এতদিন পরে এলে,

পথ পানে চেয়ে আমি যে হেথায় কেঁদে মরি আঁখিজলে।’

(২০০৪:২১)

লোকসরঞ্জাম, লোকপ্রযুক্তি, লোকপ্রবাদ আর লোকচিত্রকল্প ‘কবর’ কবিতাকে বিশেষভাবে সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছে:

ঘরের মেঝেতে সপ্টি বিছায়ে কহিলাম, বাছা শোও,

(২০০৪:২২)

আবার,

তোমার বাপের লাঙল-জোয়াল দুহাতে জড়ায়ে ধরি

তোমার মায়ে যে কতই কাঁদিত সারা দিনমান ভরি,

(২০০৪:২২)

লোকপ্রযুক্তি মাথান, হাট-বাজার এসেছে বারে বারে:

স্বামীর মাথার ‘মাথাল’ খানিরে ঝুলাইয়া দিও বায়।

  • (২০০৪:২৩)

হাট বাজার,

একদিন গেনু গজনার হাটে তাহারে রাখিয়া ঘরে,

(২০০৪:২৫)

প্রবাদ,

হাতেতে যদিও না মারিত তারে শত যে মারিত ঠোঁট।

(২০০৪:২৪)

লোকচিত্রকল্প,

কবরে তাহার জড়ায়ে রয়েছে বুনো ঘাস্‌গুলি কালো।

(২০০৪:২৪)

আবার,

বনের ঘুঘুরা উহু উহু করি কেঁদে মরে রাতদিন,

পাতায় পাতায় কেঁপে উঠে যেন তারি বেদনার বীণ।

(২০০৪:২৪)

আবার,

জোনাকী মেয়েরা সারারাত জাগি জ্বালাইয়া দেয় আলো,

ঝিঁঝিঁরা বাজায় ঘুমের নূপুর কত যেন বেসে ভালো।

(২০০৪:২৪)

লোকজীবনের প্রার্থনা আর সকল মৃতের প্রতি দোয়া যেন মহানুভবতার এক অনন্য সেন্দৗর্য। ‘কবর’ কবিতায় সাধারণ সহজ-সরল সৎ আর উদার মানসিকতার পরিচয় স্পষ্ট:

জোড়হাতে দাদু মোনাজাত করি ‘আয় খোদা! রহমান,

ভেস্ত নাজেল করিও সকল মৃত্যু-ব্যথিত-প্রাণ!’

(২০০৪: ২৬)

লোকভাষার ব্যবহার ‘কবর’ কবিতাকে বিশেষ ব্যঞ্জনাময় করে তুলেছে:

আথাল, এক ছড়া, গাঁট, বাটে, মাঙ, ভেস্ত, গোর, বু-জী, গেনু।

শব্দগুলি লোকমানুষের নিজস্ব। কবি সম্মানের সাথে পরম মমতায় শব্দগুলির সংযোজন করেছেন।

জসিম উদ্‌দীন যেন এক চিত্রশিল্পী। কবিতাটি তার চিত্রপট। চিত্রশিল্পীর চিত্রপট ‘কবর’। লোকজীবনের চিত্রপট। লোকজীবনের নিঁখুত চিত্রকর্ম এই কবিতা। বাঙালির আত্মপরিচয়ের নানা অনুষঙ্গের বলিষ্ঠ আর চিরন্তর নান্দনিক সম্পদ কবিতাটি। জসিম উদ্‌দীনের ‘কবর’ কবিতার জীবন প্রকৃতপেক্ষ চিরায়ত বাংলার সাধারণ গ্রামীণ মানুষেরই লোকজীবন।

সহায়কগ্রন্থ

১. জসীম উদ্‌দীন, (২০০৪) রাখালী, পলাশ প্রকাশনী (নবম), ঢাকা।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন