হিস্ট্রি, কালচার ও পলিটিকসে ‘বাংলাদেশ-ধারণা’ এখনো কেন মিসিং? (২য় পর্ব)

ইমরুল হাসান
প্রকাশ : ৩০ আগস্ট ২০২৫, ১৪: ৩৬
আপডেট : ৩০ আগস্ট ২০২৫, ১৪: ৪৮

(গত সংখ্যার পর)

দুই.

বিজ্ঞাপন

একটা জিনিস তথ্য-প্রমাণসহ একাডেমিক ট্রুথ হিসেবে এস্টাবলিশ হওয়ার আগেও নলেজের কিছু ধাপ আছে; যেমন, আমাদের স্ট্রং হাইপোথিসিস বা অনুমান তৈরি করতে পারতে হয়, যেইগুলারে লজিক ও রেফারেন্সের বেসিসে যাচাই-বাছাই কইরা ভুল বা ঠিক বলব আমরা… এমনকি তারও আগে, হাইপোথিসিসটারে ইমাজিন করতে পারতে হয়… এই রকম ৩টা স্টেইজ আমি দেখি ইমাজিনেশন > হাইপোথিসিস > নলেজ।

তো, এইখানে আমার প্রস্তাবগুলা মোটামুটি ইমাজিনেশন ও হাইপোথিসিসের মাঝামাঝি ঘটনা। যেইখান থিকা একটা হাইপোথিসিস তৈরি করতে চাই বা সেই সম্ভাবনার কথাটা বলতে চাই। আনফরচুনেটলি, প্রি-হিস্ট্রি তো নাই বাংলাদেশ অঞ্চলের। তারপরে যা আছে, সেইখানে ডাইভারসিটির চাইতে একটা লিনিয়ারিটি ক্রিয়েট করার উপরেই জোরটা বেশি দেওয়া হইছে। আর এইসবের পলিটিকাল মোটিভ তো আছেই এবং এই মোটিভগুলা সবসময় একটা সেন্টার পাওয়ারের ফর-এ কাজ করছে, ফলে ডাইভারসিটির জায়গাগুলা একসেপশন হিসাবে ইগনোর করা হইছে।

আমি দেখি যে, এইখানে সময়ের সাথে সাথে অনেকগুলা লেয়ারে ভূমি-গঠনই হয় নাই খালি, বিভিন্ন জায়গাতে মানুষের বসবাস এবং সমাজও তৈরি হইছে, নানান সময়ে। এইটা আমার ফার্স্ট হাইপোথিসিস যে, চিটাগাংয়ে যখন ঘটনাগুলা ঘটতেছে, সিলেটে, কুমিল্লায়, বিক্রমপুরে, রাজশাহীতে একই সময়ে একই রকমের সমাজ ছিল না। এখন অবশ্যই একটা সিনক্রোনাইজেশন খেয়াল করা যাইতেই পারে।

এখন যেইটারে বাংলাদেশ বইলা দেখি আমরা, সেই জায়গাটা সুলতানি আমলের সময় থিকা কিছুটা দেখতে পাইলেও হিস্ট্রিতে স্পষ্ট হইতে শুরু করছে মোগল আমলেই, এরপরে ব্রিটিশদের বেঙ্গল-প্রভিন্স হিসাবে। কিন্তু কীভাবে এই জায়গাগুলা একটা লিনিয়ার ফর্মেশনে আইসা এন্ড-আপ করল? বা কোন কন্ট্রাডিকশনগুলা এইখানে মেইন ফেনোমেনা ছিল?

এইখানে আসে রিলিজিওনের প্রসঙ্গ। যেইভাবে ব্রিটিশ আমলের (এবং তার কন্টিনিউড লিগাসি) হিস্ট্রিকাল বয়ানগুলা আমাদের শিখাইতে চায় যে, এইখানে হিন্দুরা থাকত, তারপরে মুসলমানরা আসছে, এই-সেই। খুবই ভুল ও ভয়ংকর আলাপ বইলা মনে করি আমি!

ধর্মের ব্যাপারে এট লিস্ট তিনটা জিনিস আমাদের খেয়াল করতে পারা উচিত–

১. এখনকার যেই রকম ইউনিভার্সাল ধর্ম আমরা দেখি, এর শুরু তো কৃষি-সমাজের সময় থিকা। শিকার ও পশু-পালনের সমাজে ধর্ম জিনিসটা বরং অনেক বেশি লোকালাইজ ঘটনা ছিল। এবং আমাদের এইখানেও যখন মাছ-ধরা ও অন্যসব প্রডাকশন সিসটেমের বাইরে গিয়া কৃষিকাজ শুরু হইছে, তখন ধর্মের জায়গাগুলা চেইঞ্জ হইছে।

২. ধর্মের একটা পলিটিকাল ইমপ্লিকেশন আছে। যেইখানে রাজার একটা ধর্ম থাকতে হইত, যে ঐশ্বরিক কারণে উনি শাসন করতে পারেন। হিন্দু বা বৌদ্ধ হওয়াটা রাজার জন্য জরুরি ছিল। ব্যক্তির পর্যায়ে বরং নানান ধরনের লোকাল ঘটনাই থাকার কথা। মানে, ধর্ম শুরু থিকাই ব্যক্তিগত পরিচয়ের ঘটনা ছিল না এতটা।

৩. লাস্টলি, এইখানে যখন ল্যান্ড তৈরি হইছে, আবাদের ঘটনা ঘটছে, মানুষ বাড়ছে এবং কমিউনিটি তৈরি হইছে, নতুন কইরা ধর্মও আসছে নানান ফর্মে।

আমার কথা হইতেছে, যখন সমাজের প্রডাকশন সিসটেমটা বদলাইছে, ধর্ম-পরিচয়ের জায়গাটা জরুরি হইতে শুরু করছে, তখন ব্যক্তির ধর্ম কী—এই প্রশ্নটা আসছে; এবং তখন জাত-প্রথার সাথে ইসলাম ধর্মের কনফ্লিক্টের ঘটনাটা ঘটছে। খেয়াল করলে দেখবেন, আমাদের সমাজে কৃষকদের বেশিরভাগই মুসলমান, অন্য পেশা—কামার, কুমার, নাপিত, তাঁতি, জেলে—উনারা হিন্দু না, বরং আপনি মুসলিম জেলে পাইবেন, হিন্দু জেলেও পাইবেন। একটা কমিউনিটি থিকা ব্যক্তি-ধর্মে ট্রান্সফার হওয়ার ঘটনাগুলা ঘটছে।

বলতে চাইতেছি, হিস্ট্রির আলাপে ধর্মের রোল নাই, কিন্তু এইটারে একটা ডিসাইডিং ফ্যাক্টর কইরা তোলাটা খালি প্রবলেমেটিকই না, পলিটিকালি মোটিভেটেড কোশ্চেনও। অই জায়গা থিকাই কোশ্চেনটারে ডিল করাই লাগবে আমাদের।

এইখানে সেন্টার হইতেছে ভূমির পরিবর্তন, প্রডাকশন সিসটেম ও কমিউনিটির অ্যাক্টিভিটি; শিকার ও পশু-পালনের সমাজের যেই কমিউনিটি, সেইটারে কৃষি-ভিত্তিক সমাজে আইসাও আমরা পুরাপুরি ডিজ-অউন করি নাই, অইটা বরং জরুরি সূত্রগুলা, এইখানে হিস্ট্রির আলোচনায়। আর এই আলাপগুলা যদি আমরা করি, তাইলে দেখতে পাব যে, এইখানে অনেকগুলা কমিউনিটির আলাদা আলাদা হয়াও একসাথে থাকার একটা ঘটনা ঘটতেছে।

যেই কারণে ইউনিফাইড কালচারের পরিবর্তে সিমিলার ও কাছাকাছি রকমের অনেকগুলা জিনিস আমরা পাইতেছি; যেমন, বাউল গান, হরে-দরে সবগুলা গানরে ‘বাউল-গান’ বানায়া দেওয়া হইছে। ভাটিয়ালি তো বাউল গান না। মুর্শিদি গানও আলাদা, মারফতি, মাইজভান্ডারিÑ এই রকম না হইলেও ১০-১২টা ক্যাটাগরি আছে বাংলাদেশি ‘ফোক-সং-এর। সুরগুলা-ফিলিংগুলা কাছাকাছি রকমেরই, কিন্তু এক না!

কিন্তু কালচারাল ডিফরেন্সগুলা আবার পাশাপাশি থাকতে পারতেছে। এক ধরনের লেনদেনও চলতেছে, এবং জরুরি জিনিস হইতেছেÑএইখানে একটা কোহেরিয়েন্স তৈরি হইতেছে। ভাষার ক্ষেত্রেও একই কথা। সিলঅটি আর চিটাগাইঙ্গা এক ভাষা না। বরিশাইল্লা ও নোয়াখাইল্লা, রাজশাহী ও খুলনারও খুবই আলাদা আলাদা ধরন। তারপরেও একেকটা জায়গার কিছু শব্দ আমরা না বললেও কানেক্ট করতে পারি। সেইটাও বড় কথা না, শব্দের আসলে আলাদা কোনো মিনিং নাই, মিনিং তৈরি হয় স্ট্রাকচারে, এটিটুডে। আর সেইখানে ভিন্নতাগুলাও একটা স্ট্রাকচার ও এটিটুড তৈরি করতে পারে, যেইখানে মিনিংফুল মিল তৈরি হইতে পারে।

এইটা হইতেছে আমার সেকেন্ড পয়েন্ট—ডিফরেন্স এবং কোহেরিয়েন্সের ঘটনা এইখানে আছে। এই টুল দিয়া আমাদেরকে এক্সপ্লোর করতে পারতে হবে। তাইলে কালচারাল জায়গাগুলারে লোকেট করতে পারা সহজ হবে।

আর এই হিস্ট্রির লেয়ারগুলা এবং কালচারাল কোহেরিয়েন্সের জায়গাগুলারে যদি আমরা সামনে নিয়া আসতে পারি, নতুন পলিটিকসের জায়গাটারেও ভালোভাবে বুঝতে পারব; বাঙালি-জাতিয়তাবাদ আমাদের রাজনীতি হইতে পারে না, বরং এইটা একটা বড় ধরনের অবস্টেকল! এমনকি আমাদের আলাদা কইরা মুসলমান হওয়ারও দরকার নাই তেমন। আপনি যদি কোহেরিয়েন্সের জায়গাটারে বেইজ কইরা বাংলাদেশ-ধারণার কাছাকাছি যাইতে পারেন, দেখবেন সেইটা পলিটিকাল আইডিয়া হিসাবে মুসলমান হওয়ার সাথে কনফ্লিক্টিং তো না-ই, বরং খুব কাছাকাছি ঘটনা। যেই কারণে দেখবেন, বাংলাদেশ ধারণার কথা কইলেই ট্যাগ লাগায়া দেওয়া হয় যে, আপনি ‘ডানপন্থি’ হয়া গেছেন! জিগানো হয়, ‘আপনি কি বাঙালি নাকি মুসলমান?’

অথচ এই কোশ্চেনটাই পলিটিকালি প্রবলেমেটিক! ‘বাঙালি’ হওয়াটা যেইরকম একটা লিনিয়ারিটি, যেন একই রকমের ‘হিন্দু’ বা ‘মুসলমান’ হওয়ার একটা লিনিয়ারিটি আমাদেরকে ক্রিয়েট করা লাগবে! বরং অই পলিটিকাল প্রভোকেশনের এবং সেট কইরা দেওয়া হিস্ট্রি ও কালচারের বেইজ থিকা আমাদেরকে বাইর হইতে হবে, যদি আমরা প্রো-বাংলাদেশি রাজনীতি শুরু করতে চাই!

আর নতুন রাজনীতির বেইজ একটা সেন্ট্রাল রাষ্ট্র কাঠামো তৈরি করার ঘটনা না, বরং পিপলস-পাওয়ার ও কালেক্টিভ কনশাসনেসের জায়গা থিকা আসতে হবে। এই জায়গাগুলা যাতে সবসময় অ্যাক্টিভ থাকতে পারে, সেইজন্য একটা ট্রান্সপারেন্ট কমিউনিটি তৈরি করতে হবে, যেইটা ইন্ডিভিজুয়াল ফ্রিডমের জায়গাটারে আপহোল্ড করবে!

কনক্লুশন

আমার কথা যদি কনক্লুড করতে চাই, ব্যাপারটা এই রকম—১. এইখানে হিস্ট্রি ও সমাজ মাল্টি-লেয়ারড। একেকটা সময়ে সমাজের যেই ট্রান্সফরমেশনের ঘটনাগুলা ঘটছে, তার বেসিসে হিস্ট্রির ফ্লো দেখতে পারতে হবে আমাদের, কোনো পলিটিকাল উদ্দেশ্য-কেন্দ্রিকতা থিকা না। আর সেইটাই ‘বাংলাদেশ ধারণা’র জায়গাটারে তৈরি করতে পারবে, হিস্ট্রিকালি।

২. আর অই হিস্ট্রিকাল বেইজ থিকা যদি দেখি, তাইলে আমি মনে করি (মুসলমান কালচার বা হিন্দু কালচারের মতো কিছু বাইনারি কিছু জিনিস না, বরং) কালচারাল কিছু ডিফরেন্স ও কোহেরিয়েন্সের জায়গাগুলারে আমরা দেখতে পাব।

৩. আর সেই হিস্ট্রিকাল-ন্যারেটিভ ও কালচারাল-ডাইভারসিটির বেসিসে কোনো ‘শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় কাঠামো’ না, বরং ফ্লেক্সিবল ও ট্রান্সপারেন্ট কমিউনিটি তৈরি করার রাজনীতি আমাদের তৈরি করতে হবে। যেইখানে পিপলের ইন্ডিভিজুয়াল ফ্রিডমের জায়গাটা ম্যাক্সিমাইজ করা যাবে।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত