লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের সাক্ষাৎকার

নকিব মুকশি

হাঙ্গেরীয় নিরীক্ষাপ্রেমী ঔপন্যাসিক ও চিত্রনাট্যকার লাসলো ক্রাসনাহোরকাই। ২০২৫ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পান। ভয়, বিশৃঙ্খলা, বিপর্যয়, চূড়ান্ত হতাশা ও বিভীষিকাময় সময়ের মাঝেও শিল্পের শক্তিকে তিনি তাঁর সাহিত্যকর্মে পুনরুদ্ধার করেছেন। প্রায় বিরামচিহ্নহীন, দীর্ঘ ও জটিল বাক্যবিন্যাসই তার রচনাশৈলীর প্রধান বৈশিষ্ট্য। এ সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে তার উপন্যাসের ভাষার কারুকাজ ও নিজস্ব বাগ্প্রণালির স্বরূপ।
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন ঔপন্যাসিক মাউরো হাভিয়ের কারদেনাস। ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর মিউজিক অ্যান্ড লিটারেটার-এর অনলাইনে এটি প্রকাশিত হয়। ইংরেজি থেকে বাংলা করেছেন কবি ।
কারদেনাস : ‘স্যাটানট্যাঙ্গো’ ও ‘দ্য মেলানকলি অব রেজিস্ট্যান্স’-এর মধ্যে শৈলীর কিছু মিল আছে, তবু আমার কাছে দ্বিতীয় বইটার বাক্যগুলো একদম ভিন্ন মনে হয়েছে—আরো দীর্ঘ, আরো বন্ধনীবদ্ধ। আপনি বলেছিলেন ‘স্যাটানট্যাঙ্গো’ লিখেছিলেন আপনার চারপাশের মানুষের বিষণ্ণতার কারণ অনুসন্ধানের জন্য। তো এই নতুন শৈলী বা বাক্যরীতির বিকাশটা ঘটল কীভাবে?
ক্রাসনাহোরকাই : ‘স্যাটানট্যাঙ্গো’ নিয়ে আমি খুব সন্তুষ্ট ছিলাম না। এটা আমার স্বাভাবিক রূপ, কিন্তু আমি একটু পারফেকশনিস্ট। ‘স্যাটানট্যাঙ্গো’ প্রায় ঠিক ছিল, কিন্তু এই ‘প্রায়’ শব্দই আমাকে ভেঙে দিচ্ছিল। আপনি জানেন, বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় হওয়া দারুণ ব্যাপার, কিন্তু দ্বিতীয় সেরা হওয়া—বেদনাদায়ক। তাই ‘প্রায় ভালো’, ‘প্রায় সেরা’ উপন্যাস আমার কাছে অসহনীয়। এ কারণেই আমি আবার চেষ্টা করি। আমার চোখে আমার লেখা প্রতিটি বই-ই ছিল একটি নিরীক্ষা, একটি চ্যালেঞ্জ—হয়তো এবার আমি সেই বই লিখতে পারব, যা আমি সত্যিই লিখতে চাই। তাই আমার বইগুলোর মধ্যে আপনি পার্থক্য পাবেন, কখনো বড় পার্থক্য।
আর আমার জীবনে একটি প্রক্রিয়া চলছিল—কল্পভাষার সঙ্গে কথ্য ভাষার (সুর ও ভঙ্গিগত) সম্পর্ক ক্রমেই ঘনিষ্ঠ হচ্ছিল। দেখবেন, যখন আপনি কাউকে কিছু বোঝাতে চান, কাউকে কনভিনস করতে চান, তখন নিজের অজান্তেই আপনি দীর্ঘ বাক্য ব্যবহার করতে থাকেন, প্রায় সময় দেখা যায়, পুরোটা যেন একটিমাত্র বাক্য। কারণ, তখন ‘ডট’ (পূর্ণবিরাম) লাগে না—ডট দিয়ে কথা বলাটা স্বাভাবিক নয়। যদি আমি আপনাকে বোঝাতে চাই—‘পৃথিবী এমন-তেমন’, তাহলে বাক্যগুলো স্বাভাবিকভাবে দীর্ঘ হতে থাকে। কারণ, তখন ডটের (দাঁড়ি) প্রয়োজন কমে যায়। আমি আমার বাক্যে ডটের এই কৃত্রিম সীমারেখা টেনে দিই না। আমি শুধু বিরতি ব্যবহার করি, আর সেটা কমা দিয়ে। ইংরেজিতে, বিশেষ করে আমার দুর্বল ইংরেজির কারণে আমি বিরতি রাখি, তাই আমার টোন একটু নিচে নেমে যায়। কিন্তু এটা ‘ডট’ নয়, এটা ‘কমা’। ‘দ্য মেলানকলি অব রেজিস্ট্যান্স’–এ আমি আবার চেষ্টা করি তেমন পরিপূর্ণ বই লেখার এবং আমার বাক্যগুলো আরো সুন্দর হয়ে ওঠে। যদিও বিষয়বস্তু, আমার বার্তা ‘স্যাটানট্যাঙ্গো’–এর পরে জীবনের এসব উপলব্ধির পরও বদলায়নি, কিন্তু ভাষা বদলেছে—আরো সুন্দর হয়েছে। কারণ, ভাষার সৌন্দর্য আমার কাছে ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আমি হয়তো একটি স্তরে পৌঁছেছি, হয়তো ‘সেইওবো দেয়ার বিলো’—এ আমি বাক্যের সৌন্দর্যের প্রতি আমার আকাঙ্ক্ষার সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছি।
কারদেনাস : আমি দীর্ঘ বাক্যকে সুন্দর ও স্বাভাবিক মনে করি। লাতিন আমেরিকান সাহিত্যে অনেক দীর্ঘ বাক্য আছে…
ক্রাসনাহোরকাই : লাতিন আমেরিকান সাহিত্য আমার খুবই আগ্রহের জায়গা। আলেহো কারপেন্তিয়ের, কোর্তাসার, অবশ্যই রোবের্তো বোলানিও—এক বড় আবিষ্কার। আর হুয়ান রুলফো তো আছেনই।
প্রথমবার যখন আমি কোর্তাসার ও কারপেন্তিয়েরকে পড়ি, বেশ প্রভাবিত করে তারা; অবশ্যই বোর্হেসও, তবে তাকে নিয়ে আমি একটু খোলামেলা বলি। কখনো কখনো, বিশেষ করে যখন তার কথা শুনি বা সাক্ষাৎকার পড়ি, মনে হয় তিনি খুব বুদ্ধিমান নন। কিন্তু তার রচনায় তিনি অসাধারণ।
যখন বোর্হেসের বক্তব্য শুনি, মাঝে মাঝে আমার মধ্যে বাজে অনুভূতি বা অস্বস্তি তৈরি হয়—তিনি যেন একটু বেশি অদ্ভুত, হয়তো একটু বেশি কৃত্রিম। যখন কেউ সবসময় খুব বুদ্ধিদীপ্ত ও আকর্ষণীয় হতে চায়…কিন্তু বোর্হেসের কাজ অসাধারণ এবং একেবারে অনন্য, ছোট ছোট রচনা। আমার কাছে বোর্হেসের মানসপট দ্বিমুখী হিসেবে ধরা দেয়।
কারদেনাস : ‘এল উলতিমো লোবো’ (শেষ নেকড়ে) গল্পে, যা আসলে একটি দীর্ঘ বাক্য, আমি দেখেছি—যেহেতু প্রকাশের একক ছিল এই দীর্ঘ বাক্য, তাই এটি আমাকে একটি আবেগের কেন্দ্রে স্থির থাকতে বাধ্য করে। কারণ, আমি সেই আবেগের চারপাশে বারবার আবর্তন করছিলাম।
ক্রাসনাহোরকাই : হ্যাঁ। কারণ, এটি আমার বইয়ের আরেকটি দিক, যা আমার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং আশা করি পাঠকদের জন্যও, প্রধানত পুনরাবৃত্তি। অবশ্যই এ ধরনের বাক্যের, ভাষার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে পুনরাবৃত্তি। আমি এটি ব্যবহার করি, কারণ হাঙ্গেরীয় ভাষা খুব সংগীতময়। কিন্তু এখানে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে: কোনো কিছু পুনরাবৃত্তি করার মানে কী?
আমি যখন প্রথমবারের মতো পূর্ব এশিয়ায় যাই—চীন ও জাপানে এবং এরপর বারবার যাই দশ বছরের বেশি সময় ধরে—সেখানে আমি কেবল একটি বিষয় বুঝতে পারি, বলা ভালো, অনুমান করতে পারি—তা হলো চিরকালীনতা। এটি কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়, বরং রোজকার বাস্তবতা। আমি বহুবার দেখেছি, শ্রমিকেরা পবিত্র স্থাপনা মন্দির-গির্জা নির্মাণ করছেন, বিশেষ করে জাপানের বৌদ্ধপ্রধান অঞ্চলে। আসলে কীভাবে তারা কাজটা করছেন, তা দেখা আমার কাছে ক্রমেই আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, অর্থাৎ একটা কাঠ, কাঠের টুকরাকে কেন এত ভীষণভাবে মসৃণ করতে হয়—একদম নিখুঁত, নির্ভুল। আমি শ্রমিকদের দেখছিলাম, কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না। কারণ, আমার মনে হচ্ছিল, এটি তো ইতোমধ্যেই নিখুঁত, কিন্তু তার (অর্থাৎ কারিগরের) কাছে এটি যথেষ্ট নিখুঁত ছিল না। আমি দেখার চেষ্টা করলাম, বোঝার চেষ্টা করলাম—কেন একইভাবে বারবার নাড়াচাড়া করা এত জরুরি? অবশেষে আমি বুঝলাম, হয়তো আন্দাজ করলাম—কাঠের সঙ্গে কী ঘটছে, সেটি মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো নাড়াচাড়া করার পুনরাবৃত্তি। কাঠের টুকরার সেই নিখুঁত গঠন ছিল মূলত এই পুনরাবৃত্ত চলনেরই ফল।
আমি চেষ্টা করছিলাম ব্যাপারটা বুঝতে, হয়তো আমি চিরকালীনতাকে খুব সহজভাবে বুঝতে পেরেছি—যেমন কাউকে দেখার মাধ্যমে, একজন কর্মী, একজন নারী, যিনি তার কাজে একই চলন, একদম একই রকম চলন বজায় রেখেছেন। আমি তখন দেখতে শুরু করি, ধরুন, একটি জলকল—জল কীভাবে পড়ে, জলের একটি ফোঁটা কীভাবে কলের কিনারা থেকে ঝরে পড়ে। এই চিরন্তন চলনভঙ্গি আমাকে নিয়ে যায় জলপ্রপাতের দিকে।
উদাহরণস্বরূপ বলি, শাফহাউজেন শহরে একটি অপূর্ব জলপ্রপাত আছে, যার একদম কাছে, এক মিটার বা তারও কম দূরত্বে আপনি যেতে পারবেন এবং এক ফোঁটা জলের চলনভঙ্গি কাছ থেকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন।
আমি আপনাকে বলতে সাহস পাই না, কতক্ষণ আমি সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম কেবল ফোঁটাগুলোর পথ অনুসরণ করতে। কারণ, স্বাভাবিকতা ও পাগলামির মাঝের সীমানা এটাই।
কারদেনাস : ‘এল উলতিমো লোবো’ ও ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’—এই দুই উপন্যাসেই দেখা যায়, নায়কেরা তাদের স্বগতোক্তি বলছেন এমন কাউকে, যে আসলে শুনছেই না। যেন একধরনের বিচ্ছিন্নতা কাজ করছে নায়কদের কিছু বলা বা শোনার অস্বাভাবিক ভঙ্গি ও তাদের কথা শ্রোতাদের শুনতে না চাওয়ার মাঝে।
ক্রাসনাহোরকাই : এর কারণ আমি সংলাপে নয়, শুধু মনোলগে বিশ্বাস করি। আমি শুধু সেই মানুষকে বিশ্বাস করি, যে মনোলগ শোনে। এবং আমি এও বিশ্বাস করি, পরেরবার আমি হতে পারি সেই ব্যক্তি, যে তোমার মনোলগ শুনবে।
মানবজগতে আমি শুধু মনোলগে বিশ্বাস করি। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার গদ্য সংলাপপ্রধান হয়ে ওঠে। সত্যি বলতে, আমেরিকাতেই আছেন সংলাপ লেখার সেরা লেখকেরা। কিন্তু আমার লেখায় সংলাপ কাজ করে না। কারণ, আমি সংলাপে বিশ্বাস করি না।
কারদেনাস : তাহলে বিষয়টা এমন নয় যে কেউ কথা বলছে আর ভুল বোঝা হচ্ছে বা কেউ শুনছে না…
ক্রাসনাহোরকাই : না, এটা মানুষের মধ্যে যোগাযোগের অক্ষমতা নয়। বরং একজন কথা বলছে, আরেকজন শুনছে—এটাই যোগাযোগ। আমি এ ধরনের যোগাযোগে বিশ্বাস করি।

হাঙ্গেরীয় নিরীক্ষাপ্রেমী ঔপন্যাসিক ও চিত্রনাট্যকার লাসলো ক্রাসনাহোরকাই। ২০২৫ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পান। ভয়, বিশৃঙ্খলা, বিপর্যয়, চূড়ান্ত হতাশা ও বিভীষিকাময় সময়ের মাঝেও শিল্পের শক্তিকে তিনি তাঁর সাহিত্যকর্মে পুনরুদ্ধার করেছেন। প্রায় বিরামচিহ্নহীন, দীর্ঘ ও জটিল বাক্যবিন্যাসই তার রচনাশৈলীর প্রধান বৈশিষ্ট্য। এ সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে তার উপন্যাসের ভাষার কারুকাজ ও নিজস্ব বাগ্প্রণালির স্বরূপ।
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন ঔপন্যাসিক মাউরো হাভিয়ের কারদেনাস। ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর মিউজিক অ্যান্ড লিটারেটার-এর অনলাইনে এটি প্রকাশিত হয়। ইংরেজি থেকে বাংলা করেছেন কবি ।
কারদেনাস : ‘স্যাটানট্যাঙ্গো’ ও ‘দ্য মেলানকলি অব রেজিস্ট্যান্স’-এর মধ্যে শৈলীর কিছু মিল আছে, তবু আমার কাছে দ্বিতীয় বইটার বাক্যগুলো একদম ভিন্ন মনে হয়েছে—আরো দীর্ঘ, আরো বন্ধনীবদ্ধ। আপনি বলেছিলেন ‘স্যাটানট্যাঙ্গো’ লিখেছিলেন আপনার চারপাশের মানুষের বিষণ্ণতার কারণ অনুসন্ধানের জন্য। তো এই নতুন শৈলী বা বাক্যরীতির বিকাশটা ঘটল কীভাবে?
ক্রাসনাহোরকাই : ‘স্যাটানট্যাঙ্গো’ নিয়ে আমি খুব সন্তুষ্ট ছিলাম না। এটা আমার স্বাভাবিক রূপ, কিন্তু আমি একটু পারফেকশনিস্ট। ‘স্যাটানট্যাঙ্গো’ প্রায় ঠিক ছিল, কিন্তু এই ‘প্রায়’ শব্দই আমাকে ভেঙে দিচ্ছিল। আপনি জানেন, বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় হওয়া দারুণ ব্যাপার, কিন্তু দ্বিতীয় সেরা হওয়া—বেদনাদায়ক। তাই ‘প্রায় ভালো’, ‘প্রায় সেরা’ উপন্যাস আমার কাছে অসহনীয়। এ কারণেই আমি আবার চেষ্টা করি। আমার চোখে আমার লেখা প্রতিটি বই-ই ছিল একটি নিরীক্ষা, একটি চ্যালেঞ্জ—হয়তো এবার আমি সেই বই লিখতে পারব, যা আমি সত্যিই লিখতে চাই। তাই আমার বইগুলোর মধ্যে আপনি পার্থক্য পাবেন, কখনো বড় পার্থক্য।
আর আমার জীবনে একটি প্রক্রিয়া চলছিল—কল্পভাষার সঙ্গে কথ্য ভাষার (সুর ও ভঙ্গিগত) সম্পর্ক ক্রমেই ঘনিষ্ঠ হচ্ছিল। দেখবেন, যখন আপনি কাউকে কিছু বোঝাতে চান, কাউকে কনভিনস করতে চান, তখন নিজের অজান্তেই আপনি দীর্ঘ বাক্য ব্যবহার করতে থাকেন, প্রায় সময় দেখা যায়, পুরোটা যেন একটিমাত্র বাক্য। কারণ, তখন ‘ডট’ (পূর্ণবিরাম) লাগে না—ডট দিয়ে কথা বলাটা স্বাভাবিক নয়। যদি আমি আপনাকে বোঝাতে চাই—‘পৃথিবী এমন-তেমন’, তাহলে বাক্যগুলো স্বাভাবিকভাবে দীর্ঘ হতে থাকে। কারণ, তখন ডটের (দাঁড়ি) প্রয়োজন কমে যায়। আমি আমার বাক্যে ডটের এই কৃত্রিম সীমারেখা টেনে দিই না। আমি শুধু বিরতি ব্যবহার করি, আর সেটা কমা দিয়ে। ইংরেজিতে, বিশেষ করে আমার দুর্বল ইংরেজির কারণে আমি বিরতি রাখি, তাই আমার টোন একটু নিচে নেমে যায়। কিন্তু এটা ‘ডট’ নয়, এটা ‘কমা’। ‘দ্য মেলানকলি অব রেজিস্ট্যান্স’–এ আমি আবার চেষ্টা করি তেমন পরিপূর্ণ বই লেখার এবং আমার বাক্যগুলো আরো সুন্দর হয়ে ওঠে। যদিও বিষয়বস্তু, আমার বার্তা ‘স্যাটানট্যাঙ্গো’–এর পরে জীবনের এসব উপলব্ধির পরও বদলায়নি, কিন্তু ভাষা বদলেছে—আরো সুন্দর হয়েছে। কারণ, ভাষার সৌন্দর্য আমার কাছে ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আমি হয়তো একটি স্তরে পৌঁছেছি, হয়তো ‘সেইওবো দেয়ার বিলো’—এ আমি বাক্যের সৌন্দর্যের প্রতি আমার আকাঙ্ক্ষার সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছি।
কারদেনাস : আমি দীর্ঘ বাক্যকে সুন্দর ও স্বাভাবিক মনে করি। লাতিন আমেরিকান সাহিত্যে অনেক দীর্ঘ বাক্য আছে…
ক্রাসনাহোরকাই : লাতিন আমেরিকান সাহিত্য আমার খুবই আগ্রহের জায়গা। আলেহো কারপেন্তিয়ের, কোর্তাসার, অবশ্যই রোবের্তো বোলানিও—এক বড় আবিষ্কার। আর হুয়ান রুলফো তো আছেনই।
প্রথমবার যখন আমি কোর্তাসার ও কারপেন্তিয়েরকে পড়ি, বেশ প্রভাবিত করে তারা; অবশ্যই বোর্হেসও, তবে তাকে নিয়ে আমি একটু খোলামেলা বলি। কখনো কখনো, বিশেষ করে যখন তার কথা শুনি বা সাক্ষাৎকার পড়ি, মনে হয় তিনি খুব বুদ্ধিমান নন। কিন্তু তার রচনায় তিনি অসাধারণ।
যখন বোর্হেসের বক্তব্য শুনি, মাঝে মাঝে আমার মধ্যে বাজে অনুভূতি বা অস্বস্তি তৈরি হয়—তিনি যেন একটু বেশি অদ্ভুত, হয়তো একটু বেশি কৃত্রিম। যখন কেউ সবসময় খুব বুদ্ধিদীপ্ত ও আকর্ষণীয় হতে চায়…কিন্তু বোর্হেসের কাজ অসাধারণ এবং একেবারে অনন্য, ছোট ছোট রচনা। আমার কাছে বোর্হেসের মানসপট দ্বিমুখী হিসেবে ধরা দেয়।
কারদেনাস : ‘এল উলতিমো লোবো’ (শেষ নেকড়ে) গল্পে, যা আসলে একটি দীর্ঘ বাক্য, আমি দেখেছি—যেহেতু প্রকাশের একক ছিল এই দীর্ঘ বাক্য, তাই এটি আমাকে একটি আবেগের কেন্দ্রে স্থির থাকতে বাধ্য করে। কারণ, আমি সেই আবেগের চারপাশে বারবার আবর্তন করছিলাম।
ক্রাসনাহোরকাই : হ্যাঁ। কারণ, এটি আমার বইয়ের আরেকটি দিক, যা আমার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং আশা করি পাঠকদের জন্যও, প্রধানত পুনরাবৃত্তি। অবশ্যই এ ধরনের বাক্যের, ভাষার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে পুনরাবৃত্তি। আমি এটি ব্যবহার করি, কারণ হাঙ্গেরীয় ভাষা খুব সংগীতময়। কিন্তু এখানে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে: কোনো কিছু পুনরাবৃত্তি করার মানে কী?
আমি যখন প্রথমবারের মতো পূর্ব এশিয়ায় যাই—চীন ও জাপানে এবং এরপর বারবার যাই দশ বছরের বেশি সময় ধরে—সেখানে আমি কেবল একটি বিষয় বুঝতে পারি, বলা ভালো, অনুমান করতে পারি—তা হলো চিরকালীনতা। এটি কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়, বরং রোজকার বাস্তবতা। আমি বহুবার দেখেছি, শ্রমিকেরা পবিত্র স্থাপনা মন্দির-গির্জা নির্মাণ করছেন, বিশেষ করে জাপানের বৌদ্ধপ্রধান অঞ্চলে। আসলে কীভাবে তারা কাজটা করছেন, তা দেখা আমার কাছে ক্রমেই আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, অর্থাৎ একটা কাঠ, কাঠের টুকরাকে কেন এত ভীষণভাবে মসৃণ করতে হয়—একদম নিখুঁত, নির্ভুল। আমি শ্রমিকদের দেখছিলাম, কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না। কারণ, আমার মনে হচ্ছিল, এটি তো ইতোমধ্যেই নিখুঁত, কিন্তু তার (অর্থাৎ কারিগরের) কাছে এটি যথেষ্ট নিখুঁত ছিল না। আমি দেখার চেষ্টা করলাম, বোঝার চেষ্টা করলাম—কেন একইভাবে বারবার নাড়াচাড়া করা এত জরুরি? অবশেষে আমি বুঝলাম, হয়তো আন্দাজ করলাম—কাঠের সঙ্গে কী ঘটছে, সেটি মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো নাড়াচাড়া করার পুনরাবৃত্তি। কাঠের টুকরার সেই নিখুঁত গঠন ছিল মূলত এই পুনরাবৃত্ত চলনেরই ফল।
আমি চেষ্টা করছিলাম ব্যাপারটা বুঝতে, হয়তো আমি চিরকালীনতাকে খুব সহজভাবে বুঝতে পেরেছি—যেমন কাউকে দেখার মাধ্যমে, একজন কর্মী, একজন নারী, যিনি তার কাজে একই চলন, একদম একই রকম চলন বজায় রেখেছেন। আমি তখন দেখতে শুরু করি, ধরুন, একটি জলকল—জল কীভাবে পড়ে, জলের একটি ফোঁটা কীভাবে কলের কিনারা থেকে ঝরে পড়ে। এই চিরন্তন চলনভঙ্গি আমাকে নিয়ে যায় জলপ্রপাতের দিকে।
উদাহরণস্বরূপ বলি, শাফহাউজেন শহরে একটি অপূর্ব জলপ্রপাত আছে, যার একদম কাছে, এক মিটার বা তারও কম দূরত্বে আপনি যেতে পারবেন এবং এক ফোঁটা জলের চলনভঙ্গি কাছ থেকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন।
আমি আপনাকে বলতে সাহস পাই না, কতক্ষণ আমি সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম কেবল ফোঁটাগুলোর পথ অনুসরণ করতে। কারণ, স্বাভাবিকতা ও পাগলামির মাঝের সীমানা এটাই।
কারদেনাস : ‘এল উলতিমো লোবো’ ও ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’—এই দুই উপন্যাসেই দেখা যায়, নায়কেরা তাদের স্বগতোক্তি বলছেন এমন কাউকে, যে আসলে শুনছেই না। যেন একধরনের বিচ্ছিন্নতা কাজ করছে নায়কদের কিছু বলা বা শোনার অস্বাভাবিক ভঙ্গি ও তাদের কথা শ্রোতাদের শুনতে না চাওয়ার মাঝে।
ক্রাসনাহোরকাই : এর কারণ আমি সংলাপে নয়, শুধু মনোলগে বিশ্বাস করি। আমি শুধু সেই মানুষকে বিশ্বাস করি, যে মনোলগ শোনে। এবং আমি এও বিশ্বাস করি, পরেরবার আমি হতে পারি সেই ব্যক্তি, যে তোমার মনোলগ শুনবে।
মানবজগতে আমি শুধু মনোলগে বিশ্বাস করি। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার গদ্য সংলাপপ্রধান হয়ে ওঠে। সত্যি বলতে, আমেরিকাতেই আছেন সংলাপ লেখার সেরা লেখকেরা। কিন্তু আমার লেখায় সংলাপ কাজ করে না। কারণ, আমি সংলাপে বিশ্বাস করি না।
কারদেনাস : তাহলে বিষয়টা এমন নয় যে কেউ কথা বলছে আর ভুল বোঝা হচ্ছে বা কেউ শুনছে না…
ক্রাসনাহোরকাই : না, এটা মানুষের মধ্যে যোগাযোগের অক্ষমতা নয়। বরং একজন কথা বলছে, আরেকজন শুনছে—এটাই যোগাযোগ। আমি এ ধরনের যোগাযোগে বিশ্বাস করি।

ছবিটা পড়ে ছিল বাতিল জিনিসের স্তূপে। ঘরের জঞ্জাল পরিষ্কার করতে গিয়ে শিহাব সাহেব ছবিটা পেয়েছিলেন। কতদিন পর তিনি ছবিটা দেখলেন। তারর এত প্রিয় ছিল ছবিটা! এটার সঙ্গে কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আর সেই ছবিটাই কিনা অবহেলায় পড়ে আছে গারবেজ হয়ে!
৩ ঘণ্টা আগে
সমকালীন আরবি সাহিত্যে যেসব নারী সাহিত্যিক নিজেদের স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন, তাদের অন্যতম মিসরের সাহিত্যিক ও সাংবাদিক নাদিয়া কিলানি (জন্ম: ১ জানুয়ারি ১৯৫০)। গল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতা, শিশুসাহিত্য—প্রায় সব ধারাতেই তিনি রেখেছেন স্বাক্ষর।
৫ ঘণ্টা আগে
কর্ণফুলী থেকে নাফ দুই নদীর মধ্যবর্তী চট্টগ্রামের এলাকা জীববৈচিত্র্যে যেমন অনন্য, রাজনীতিক বৈশিষ্ট্যেও অনন্য। প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হলো এ অঞ্চল অরণ্যসংকুল, সমুদ্রউপকূলবর্তী ও পর্বতবেষ্টিত। এত বৈচিত্র্য বাংলাদেশের আর কোথাও নেই। মধ্যযুগব্যাপী এ অঞ্চল ছিল আরাকানের অংশ।
৫ ঘণ্টা আগে
১৯০৬ সাল বা খ্রিষ্টাব্দের ২৫ অক্টোবর যিনি মা-মাটি-দেশ-জাতিকে ধারণ করে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন, তিনি দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ। একই সময়ে এবং একই ক্ষণে ধরণিতে আরো মানুষের আবির্ভাব স্বাভাবিক। তবে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ কালে কালে বৈদগ্ধ্যে যুগস্রষ্টা হয়ে উঠেছেন বলেই তিনি আলাদা ও অনন্য।
৬ ঘণ্টা আগে