
মনিরুস সালেহীন

ছবিটা পড়ে ছিল বাতিল জিনিসের স্তূপে। ঘরের জঞ্জাল পরিষ্কার করতে গিয়ে শিহাব সাহেব ছবিটা পেয়েছিলেন। কতদিন পর তিনি ছবিটা দেখলেন। তারর এত প্রিয় ছিল ছবিটা! এটার সঙ্গে কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আর সেই ছবিটাই কিনা অবহেলায় পড়ে আছে গারবেজ হয়ে!
ছোটখাটো বিষয়গুলোও যেন ইদানীং তার কাছে খুব সিগনিফিক্যান্ট হয়ে দেখা দেয়। ছোট্ট ঘটনা, ছোট্ট কোনো কথা যেন অনেক প্রতীকী তাৎপর্য নিয়ে উপস্থিত হয় তার কাছে। এই যেমন এই ছবিটা। যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে—এমনই হয়, প্রয়োজন ফুরালে এভাবেই ভাগাড়ে নিক্ষিপ্ত হয় সবকিছু; মানুষও।
বয়সোচিত নৈরাশ্যকে তিনি চাপা দেন, দিতে জানেন। আজীবন পজিটিভ, আশাবাদী মানুষ হিসেবেই নিজেকে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন তিনি, করেছেনও। লোকদেখানো আশাবাদ নয়, তিনি মনেপ্রাণেই বিশ্বাস করেন প্রিয় কবি খলিল জিবরানের সেই কথা—‘রাত্রির অন্ধকার না পেরিয়ে কেউ ভোরের আলোয় পৌঁছুতে পারে না।’
সাবধানে ধুলোর আস্তরণ সরাতেই দেখেন ছবির ফ্রেমটা ভাঙা, কিন্তু ছবিটা এখনো অক্ষত। লেমিনেট করে বাঁধাই করা হয়েছিল ছবিটা। বত্রিশ বছর আগে। আরেকটা ফ্রেমে একটা অপ্রয়োজনীয় গ্রুপ ছবি। ফ্রেমটি চকচক করছে। শিহাব তখনই সিদ্ধান্ত নেন প্রিয় ছবিটা রাখবেন এই ফ্রেমে।
শিহাব সাহেব ঘর পরিষ্কারের কাজে হেল্প করছিলেন তাদের গৃহপরিচারিকাকে। বাসার স্টোররুম তথা সাময়িক গারবেজ রুম থেকে গৃহপরিচারিকা একটা একটা করে জিনিস বের করে দিচ্ছে। শিহাব সাহেব সেগুলো থেকে কোনোটা ফেলে দেওয়ার জন্য, কোনোটা বিলিয়ে দেওয়ার জন্য, কোনোটাবা গ্রামের বাড়ি পাঠানোর জন্য ঠিক করে দিচ্ছেন। ছবিটা হাতে পেয়ে তিনি অনেকক্ষণ সেটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। গৃহপরিচারিকা তাড়া দেয়, ‘আংকেল, আমি এই চিপা ঘরে গরমে পুড়তাছি আর তুমি কী এক ছবির দিকে তাকায়া আছ!’
শিহাব সাহেবদের গৃহকর্মী রোজিনা। প্রায় পাঁচ বছর আগে সে যখন এসেছিল তখন তার নাম বলেছিল রঞ্জিনা। শুরু থেকেই বাসার সবাই তাকে ডাকছে রোজিনা বলে। মেয়ে মুনিয়া বলেছিল, ‘আমাদের বাসায় আগে একটা মেয়ে ছিল না—শাবানা নাম। ভালোই, এবার পেলাম আরেক নায়িকা—রোজিনা।’ তার বাড়ি দিনাজপুর। সবাইকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করে। শিহাব সাহেবকে আংকেল, আর শায়লাকে আন্টি। তার খবরদারিতে বাসার কেউই মাইন্ড করে না, তেমনি তার ‘তুমি’ সম্বোধনও। রোজিনার বয়স কুড়ি-বাইশ, বয়সের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন অপরিণত শরীর। মুখের শিশুসুলভ কোমলতায় তাকে ১৪-১৫ বছরের কিশোরীর চেয়ে বড় মনে হয় না। হাত-পা দেখলে মনে হয় ঠিকমতো খেতে পায় না। তাকে মোটাতাজা করার কোনো চেষ্টাই বাদ দেননি শায়লা—‘তোকে দেখলে মানুষ ভাববে আমরা তোকে খেতে দিই না।’ কতবার যে তিনি বলেছেন এ কথা! রোজিনা খায় যথেষ্টই, কিন্তু গায়ে লাগে না। শায়লা তাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছেন—ভেতরে কোনো গন্ডগোল আছে কি না, তা বের করতে।
বাসার সবার সঙ্গেই রোজিনার সহজ সম্পর্ক। শিহাব সাহেবের সঙ্গে আরো বেশি। খুব স্নেহ করেন মেয়েটাকে। সেও সুযোগ পেলেই খবরদারি করে তার ওপর। শিহাব সাহেব পান খাওয়ার জন্য কিছু একটা এগিয়ে দিতে বললেই সে পানের সরঞ্জাম এগিয়ে দিতে দিতে বলবেই, ‘পান খাওয়াটা এবার বাদ দাও তো!’
বাসায় টিভি চ্যানেলের একমাত্র দর্শক সে। তাকে টিভি সামনে বসে থাকতে দেখলে শিহাব সাহেব প্রায়ই জিজ্ঞেস করেন, ‘আজ তোমার কয়টা সিরিয়াল আছে?’
রোজিনা চা-পান কিছুই খায় না। সেদিন টিজ করার জন্য শিহাব বলেছিলেন, ‘রোজিনা কফি খাবা?’ সে বলে, না।
—চা?
—না।
—একটা পান খাও তাহলে।
সে বলে, কফি, চা, পান সব তোরাই খা।
ওর কথা শুনে শিহাব হেসেছেন, শায়লাকে বলেছেন। তার ইনোসেন্স এবং নিজের ভাষায় ‘আপনি, তুই, তুমি’ গুলিয়ে ফেলার ভঙ্গিটা সবাই বেশ উপভোগ করে।
ছবি দেখায় মগ্ন শিহাব সাহেবকে আবার তাড়া দেয় রোজিনা—‘আংকেল, কার ছবি দেখো অত নিরিখ কইরে?’
তিনি হাসেন। ছবি দেখিয়ে বলেন, ‘দেখো তো ভালো করে, চিনতে পার কি না?’—ঠিক বুঝতে পারছি না। কার? আন্টির?
ছবিটা এক সুন্দরী তরুণীর—হাসিমুখ করে দাঁড়ানো, পিঠের ওপর খোলা চুল, একটা আয়নায় তরুণীর মুখটা প্রতিফলিত হয়েছে।
‘তোমার আন্টি কি আর এত সুন্দর?’ শিহাব কৌতুক নিয়ে জিজ্ঞেস করেন।
—তাইলে কার ছবি ইডা?
—‘তুমি না দুনিয়ার সব নায়িকাকে চেন। একে চিনতে পারছ না?’
—উমহু।
‘এক নায়িকার ছবি এটা। যুবক বয়সে এর প্রেমে পড়ছিলাম। এজন্যই তো লুকিয়ে রেখেছিলাম। আজ হঠাৎ বের হয়ে এলো। তুমি যেন আবার আন্টিকে সব বলে দিও না।’
রহস্যময় হাসি দিয়ে শিহাব বলেন, রোজিনা কী বোঝে সে-ই জানে। মনে হয় নিজের মনে গজরাতে গজরাতে বলে, ‘বেডা ছেলেগুলা সব একরকম। অত সুন্দর আন্টিটা থাকতে নায়িকার ছবি বাইন্দা রাখে!’
শিহাব হাসেন। বিশ-বাইশ বছর না পেরোতেই জীবনের অনেক কুশ্রী রূপই দেখে ফেলেছে রোজিনা। ক্ষেতমজুর বাবা তার সুশ্রী কন্যাকে বিয়ে দিয়েছিল চৌদ্দ-পনেরো বছর বয়সে। বাহ্যিক শারীরিক লক্ষণে এতটুকু নারীত্ব না ফোটা সত্ত্বেও এ রকম নিছক বালিকাকে কেউ বিয়ে দেয়! স্বামীর অবহেলা, যৌতুক দাবি আর শারীরিক নির্যাতন সয়ে রোজিনা বরের ঘর করেছে দু’বছর। মাও নাকি হয়েছিল। সে সন্তানের কোনো খবর তার কাছে নেই। শায়লার কাছে সে খবর শুনে তার বরের ওপর যতটা না, তার চেয়ে বাবার ওপর মনে মনে বেশি চটে গিয়েছিলেন শিহাব। অথচ মাস শেষে তার বেতনের প্রায় পুরো টাকাই সে বাবার কাছে পাঠায়। শায়লা তাকে অনেক বুঝিয়েছেন, রোজগারের কিছু টাকা নিজের জন্য সঞ্চয় করতে, তাকে ব্যাংক হিসাবও খুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যাংকে সে টাকা রাখবে না। পুরুষদের প্রতি রোজিনার ক্ষোভ অস্বাভাবিক, কিংবা অন্যায্য কোনোটাই নয়। তাই তার সস্নেহ গজরানো দেখে শিহাব একটু হাসেনই শুধু।
শায়লা মেয়ের সঙ্গে বাইরে গেছে। সেই ফাঁকে বিকেলে খুব যত্ন নিয়ে ছবিটা নতুন করে বাঁধাই করেছেন শিহাব। কাঁচি, পেরেক ও স্কচটেপ এগিয়ে দিয়ে সাহায্য করেছে রোজিনা। সাহায্য করেছে চূড়ান্ত অনাগ্রহ দেখিয়ে। বলেছে, ‘ওই নায়িকার ছবি তোমার বান্ধাই করতে হবি ক্যান?’
‘আরে, একজন মানুষকে ভালো লাগলে তার ছবি মানুষ বাঁধাই করে রাখে না! তুমি রাখতে না তোমার বরের ছবি?’ লঘু ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করেন শিহাব।
‘ঝাঁটা মারি বরের ছবিতে!’ রোজিনার ঝাঁঝালো জবাবে শিহাব আর কিছু না বলে নিজের কাজ শেষ করেন। একদম প্রফেশনাল কাজ হয়েছে। সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডে ছবির তরুণীকে ফটোশুটে নায়িকাদের মতোই আকর্ষণীয় মনে হয়। নিজের কাজে নিজেই মুগ্ধ হন তিনি। ড্রয়িং রুমের চেস্ট অব ড্রয়ারের উপর ছবিটা রেখে রোজিনাকে বলেন, ‘ছবিটা সুন্দর দেখাচ্ছে না?’ তেতো ওষুধ গেলার ভঙি করে সে মৃদু জবাব দেয়, ‘হুম।’
সন্ধ্যায় বাসায় ফিরতেই রোজিনা শায়লাকে বলে, ‘আংকেলকে কি তুমি কিছু কবা না?’
শায়লা চমকে জিজ্ঞেস করে, ‘কেন, কী করেছে তোর আংকেল?’
প্রায় হাত ধরেই সে শায়লাকে নিয়ে যায় ড্রয়িং রুমে। ছবিটা দেখিয়ে বলে, ‘এই দেখো আংকেলের কাণ্ড, কোথাকার কোন নায়িকার ছবি বাঁধাই করেছে সারা বিকাল ধরে।’
মুগ্ধ হয়ে তিনি অপলক চেয়ে থাকেন ছবিটার দিকে। চমৎকার বাঁধাই হয়েছে ছবিটা। মনে হয় এইমাত্র দোকান থেকে এসেছে।
‘নিজের বউ থাকতে কেউ ঘরে নায়িকার ছবি টানায়? আংকেলকে ঠিকঠাক শাসন করে বল তো এক্ষুনি এটা সরাতে।’
শায়লা বলেন, ‘কী বলব, বল? আমি বুড়ো হয়ে গেছি, আমাকে বোধহয় তোর আংকেলের আর ভাল্লাগে না।’
‘উহ, বললেই হলো—ভাল্লাগে না!’ উষ্মা প্রকাশ করে রোজিনা বলে। যে কিশোরী রোজিনা বউ হয়ে হয়তো স্বামীকে শাসন করা দূরে থাক, ন্যূনতম অধিকারের কথাও বলতে পারেনি, সে-ই এখন তাকে শেখাচ্ছে স্বামীকে শাসনে রাখার কথা! নিজের মনে হাসেন শায়লা।
‘শোনো আন্টি, তোমাকে তো আমার বিয়ার কত কথাই বলছি। এইটা বলি নাই। মোবাইলে আমার জামাই সারাক্ষণ কার সঙ্গে জানি কথা কইত, আমি পাশে থাকলেই কথা বন্ধ। তার মানিব্যাগে একদিন দেখি এক মেয়ের ছবি। কার ছবি জানতে চাইতেই সে খেইপা যায়। আমারে ধরে মারে—কেন এসব জিজ্ঞেস করি এজন্য। পরে শুনি ওই মেয়েকে সে বিয়া করছে কাউরে না জানায়া! আর কত! সেই রাত্রেই পালাইয়া চইল্যা আসছি বাপের বাড়ি। বেডাগুলান এমনি খবিস।’
শিহাবের কথিত নায়িকাপ্রীতির প্রেক্ষাপটে নিজের গল্প বলে রোজিনা কী বোঝাতে চায়, শায়লা তা বোঝেন। তিনি সেদিকে না গিয়ে বলেন, ‘ছবিটা সুন্দর, না?’
‘হুম।’
নিজের অজান্তে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বের হয়। পরক্ষণেই তিনি সচকিত হয়ে তাকান রোজিনার দিকে। ভালোবাসাহীন এক জীবন পার করছে মেয়েটা। রোজিনার জন্য বড্ড কষ্ট হয় শায়লার। বলেন, ‘তুইও কিন্তু বেশ সুন্দর। কী মিষ্টি তোর মুখের গড়ন। তোর আংকেলকে বলব তোর এমন একটা ছবি তুলে এভাবে বাঁধিয়ে দিতে।’
‘উহ, আমার ছবি কিডা দেখব?’ ঠোঁট উল্টিয়ে বলে রোজিনা।
‘কেন, তুই দেখবি। দেখবি আর ভাববি আমি কত সুন্দর!’
একটু হাসতে গিয়েও যেন থমকে যায় রোজিনা। চকিতে মনে পড়ে বিয়ের পর স্বামীর কথা—শইল্যে নাই কিচ্ছু। এই ছেড়ি নাকি সুন্দর!
হঠাৎ করে অশ্রুসজল হয়ে ওঠে তার চোখ। সেটা সামলে সে বলে, ‘হইছে। তুমি এখনই আংকেলকে জিজ্ঞেস করো—এ ছবি ক্যান রাখছে।’
শায়লার চোখও চকচক করে। ঢেউয়ের তোড়ে বালুকাবেলার রেখা মুছে যাওয়া, রোজিনার জন্য তার কষ্ট নাকি শিহাবের প্রতি কৃতজ্ঞতা—কোনটা যে কারণ ঠিক বোঝা যায় না। রোজিনার মতো তিনিও গোপন করেন অশ্রু, তারপর হেসে বলেন, ‘আমার কথা কি তোর আংকেল শোনে! তুইই বরং শাসন করে দিস তোর আংকেলকে।’

ছবিটা পড়ে ছিল বাতিল জিনিসের স্তূপে। ঘরের জঞ্জাল পরিষ্কার করতে গিয়ে শিহাব সাহেব ছবিটা পেয়েছিলেন। কতদিন পর তিনি ছবিটা দেখলেন। তারর এত প্রিয় ছিল ছবিটা! এটার সঙ্গে কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আর সেই ছবিটাই কিনা অবহেলায় পড়ে আছে গারবেজ হয়ে!
ছোটখাটো বিষয়গুলোও যেন ইদানীং তার কাছে খুব সিগনিফিক্যান্ট হয়ে দেখা দেয়। ছোট্ট ঘটনা, ছোট্ট কোনো কথা যেন অনেক প্রতীকী তাৎপর্য নিয়ে উপস্থিত হয় তার কাছে। এই যেমন এই ছবিটা। যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে—এমনই হয়, প্রয়োজন ফুরালে এভাবেই ভাগাড়ে নিক্ষিপ্ত হয় সবকিছু; মানুষও।
বয়সোচিত নৈরাশ্যকে তিনি চাপা দেন, দিতে জানেন। আজীবন পজিটিভ, আশাবাদী মানুষ হিসেবেই নিজেকে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন তিনি, করেছেনও। লোকদেখানো আশাবাদ নয়, তিনি মনেপ্রাণেই বিশ্বাস করেন প্রিয় কবি খলিল জিবরানের সেই কথা—‘রাত্রির অন্ধকার না পেরিয়ে কেউ ভোরের আলোয় পৌঁছুতে পারে না।’
সাবধানে ধুলোর আস্তরণ সরাতেই দেখেন ছবির ফ্রেমটা ভাঙা, কিন্তু ছবিটা এখনো অক্ষত। লেমিনেট করে বাঁধাই করা হয়েছিল ছবিটা। বত্রিশ বছর আগে। আরেকটা ফ্রেমে একটা অপ্রয়োজনীয় গ্রুপ ছবি। ফ্রেমটি চকচক করছে। শিহাব তখনই সিদ্ধান্ত নেন প্রিয় ছবিটা রাখবেন এই ফ্রেমে।
শিহাব সাহেব ঘর পরিষ্কারের কাজে হেল্প করছিলেন তাদের গৃহপরিচারিকাকে। বাসার স্টোররুম তথা সাময়িক গারবেজ রুম থেকে গৃহপরিচারিকা একটা একটা করে জিনিস বের করে দিচ্ছে। শিহাব সাহেব সেগুলো থেকে কোনোটা ফেলে দেওয়ার জন্য, কোনোটা বিলিয়ে দেওয়ার জন্য, কোনোটাবা গ্রামের বাড়ি পাঠানোর জন্য ঠিক করে দিচ্ছেন। ছবিটা হাতে পেয়ে তিনি অনেকক্ষণ সেটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। গৃহপরিচারিকা তাড়া দেয়, ‘আংকেল, আমি এই চিপা ঘরে গরমে পুড়তাছি আর তুমি কী এক ছবির দিকে তাকায়া আছ!’
শিহাব সাহেবদের গৃহকর্মী রোজিনা। প্রায় পাঁচ বছর আগে সে যখন এসেছিল তখন তার নাম বলেছিল রঞ্জিনা। শুরু থেকেই বাসার সবাই তাকে ডাকছে রোজিনা বলে। মেয়ে মুনিয়া বলেছিল, ‘আমাদের বাসায় আগে একটা মেয়ে ছিল না—শাবানা নাম। ভালোই, এবার পেলাম আরেক নায়িকা—রোজিনা।’ তার বাড়ি দিনাজপুর। সবাইকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করে। শিহাব সাহেবকে আংকেল, আর শায়লাকে আন্টি। তার খবরদারিতে বাসার কেউই মাইন্ড করে না, তেমনি তার ‘তুমি’ সম্বোধনও। রোজিনার বয়স কুড়ি-বাইশ, বয়সের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন অপরিণত শরীর। মুখের শিশুসুলভ কোমলতায় তাকে ১৪-১৫ বছরের কিশোরীর চেয়ে বড় মনে হয় না। হাত-পা দেখলে মনে হয় ঠিকমতো খেতে পায় না। তাকে মোটাতাজা করার কোনো চেষ্টাই বাদ দেননি শায়লা—‘তোকে দেখলে মানুষ ভাববে আমরা তোকে খেতে দিই না।’ কতবার যে তিনি বলেছেন এ কথা! রোজিনা খায় যথেষ্টই, কিন্তু গায়ে লাগে না। শায়লা তাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছেন—ভেতরে কোনো গন্ডগোল আছে কি না, তা বের করতে।
বাসার সবার সঙ্গেই রোজিনার সহজ সম্পর্ক। শিহাব সাহেবের সঙ্গে আরো বেশি। খুব স্নেহ করেন মেয়েটাকে। সেও সুযোগ পেলেই খবরদারি করে তার ওপর। শিহাব সাহেব পান খাওয়ার জন্য কিছু একটা এগিয়ে দিতে বললেই সে পানের সরঞ্জাম এগিয়ে দিতে দিতে বলবেই, ‘পান খাওয়াটা এবার বাদ দাও তো!’
বাসায় টিভি চ্যানেলের একমাত্র দর্শক সে। তাকে টিভি সামনে বসে থাকতে দেখলে শিহাব সাহেব প্রায়ই জিজ্ঞেস করেন, ‘আজ তোমার কয়টা সিরিয়াল আছে?’
রোজিনা চা-পান কিছুই খায় না। সেদিন টিজ করার জন্য শিহাব বলেছিলেন, ‘রোজিনা কফি খাবা?’ সে বলে, না।
—চা?
—না।
—একটা পান খাও তাহলে।
সে বলে, কফি, চা, পান সব তোরাই খা।
ওর কথা শুনে শিহাব হেসেছেন, শায়লাকে বলেছেন। তার ইনোসেন্স এবং নিজের ভাষায় ‘আপনি, তুই, তুমি’ গুলিয়ে ফেলার ভঙ্গিটা সবাই বেশ উপভোগ করে।
ছবি দেখায় মগ্ন শিহাব সাহেবকে আবার তাড়া দেয় রোজিনা—‘আংকেল, কার ছবি দেখো অত নিরিখ কইরে?’
তিনি হাসেন। ছবি দেখিয়ে বলেন, ‘দেখো তো ভালো করে, চিনতে পার কি না?’—ঠিক বুঝতে পারছি না। কার? আন্টির?
ছবিটা এক সুন্দরী তরুণীর—হাসিমুখ করে দাঁড়ানো, পিঠের ওপর খোলা চুল, একটা আয়নায় তরুণীর মুখটা প্রতিফলিত হয়েছে।
‘তোমার আন্টি কি আর এত সুন্দর?’ শিহাব কৌতুক নিয়ে জিজ্ঞেস করেন।
—তাইলে কার ছবি ইডা?
—‘তুমি না দুনিয়ার সব নায়িকাকে চেন। একে চিনতে পারছ না?’
—উমহু।
‘এক নায়িকার ছবি এটা। যুবক বয়সে এর প্রেমে পড়ছিলাম। এজন্যই তো লুকিয়ে রেখেছিলাম। আজ হঠাৎ বের হয়ে এলো। তুমি যেন আবার আন্টিকে সব বলে দিও না।’
রহস্যময় হাসি দিয়ে শিহাব বলেন, রোজিনা কী বোঝে সে-ই জানে। মনে হয় নিজের মনে গজরাতে গজরাতে বলে, ‘বেডা ছেলেগুলা সব একরকম। অত সুন্দর আন্টিটা থাকতে নায়িকার ছবি বাইন্দা রাখে!’
শিহাব হাসেন। বিশ-বাইশ বছর না পেরোতেই জীবনের অনেক কুশ্রী রূপই দেখে ফেলেছে রোজিনা। ক্ষেতমজুর বাবা তার সুশ্রী কন্যাকে বিয়ে দিয়েছিল চৌদ্দ-পনেরো বছর বয়সে। বাহ্যিক শারীরিক লক্ষণে এতটুকু নারীত্ব না ফোটা সত্ত্বেও এ রকম নিছক বালিকাকে কেউ বিয়ে দেয়! স্বামীর অবহেলা, যৌতুক দাবি আর শারীরিক নির্যাতন সয়ে রোজিনা বরের ঘর করেছে দু’বছর। মাও নাকি হয়েছিল। সে সন্তানের কোনো খবর তার কাছে নেই। শায়লার কাছে সে খবর শুনে তার বরের ওপর যতটা না, তার চেয়ে বাবার ওপর মনে মনে বেশি চটে গিয়েছিলেন শিহাব। অথচ মাস শেষে তার বেতনের প্রায় পুরো টাকাই সে বাবার কাছে পাঠায়। শায়লা তাকে অনেক বুঝিয়েছেন, রোজগারের কিছু টাকা নিজের জন্য সঞ্চয় করতে, তাকে ব্যাংক হিসাবও খুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যাংকে সে টাকা রাখবে না। পুরুষদের প্রতি রোজিনার ক্ষোভ অস্বাভাবিক, কিংবা অন্যায্য কোনোটাই নয়। তাই তার সস্নেহ গজরানো দেখে শিহাব একটু হাসেনই শুধু।
শায়লা মেয়ের সঙ্গে বাইরে গেছে। সেই ফাঁকে বিকেলে খুব যত্ন নিয়ে ছবিটা নতুন করে বাঁধাই করেছেন শিহাব। কাঁচি, পেরেক ও স্কচটেপ এগিয়ে দিয়ে সাহায্য করেছে রোজিনা। সাহায্য করেছে চূড়ান্ত অনাগ্রহ দেখিয়ে। বলেছে, ‘ওই নায়িকার ছবি তোমার বান্ধাই করতে হবি ক্যান?’
‘আরে, একজন মানুষকে ভালো লাগলে তার ছবি মানুষ বাঁধাই করে রাখে না! তুমি রাখতে না তোমার বরের ছবি?’ লঘু ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করেন শিহাব।
‘ঝাঁটা মারি বরের ছবিতে!’ রোজিনার ঝাঁঝালো জবাবে শিহাব আর কিছু না বলে নিজের কাজ শেষ করেন। একদম প্রফেশনাল কাজ হয়েছে। সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডে ছবির তরুণীকে ফটোশুটে নায়িকাদের মতোই আকর্ষণীয় মনে হয়। নিজের কাজে নিজেই মুগ্ধ হন তিনি। ড্রয়িং রুমের চেস্ট অব ড্রয়ারের উপর ছবিটা রেখে রোজিনাকে বলেন, ‘ছবিটা সুন্দর দেখাচ্ছে না?’ তেতো ওষুধ গেলার ভঙি করে সে মৃদু জবাব দেয়, ‘হুম।’
সন্ধ্যায় বাসায় ফিরতেই রোজিনা শায়লাকে বলে, ‘আংকেলকে কি তুমি কিছু কবা না?’
শায়লা চমকে জিজ্ঞেস করে, ‘কেন, কী করেছে তোর আংকেল?’
প্রায় হাত ধরেই সে শায়লাকে নিয়ে যায় ড্রয়িং রুমে। ছবিটা দেখিয়ে বলে, ‘এই দেখো আংকেলের কাণ্ড, কোথাকার কোন নায়িকার ছবি বাঁধাই করেছে সারা বিকাল ধরে।’
মুগ্ধ হয়ে তিনি অপলক চেয়ে থাকেন ছবিটার দিকে। চমৎকার বাঁধাই হয়েছে ছবিটা। মনে হয় এইমাত্র দোকান থেকে এসেছে।
‘নিজের বউ থাকতে কেউ ঘরে নায়িকার ছবি টানায়? আংকেলকে ঠিকঠাক শাসন করে বল তো এক্ষুনি এটা সরাতে।’
শায়লা বলেন, ‘কী বলব, বল? আমি বুড়ো হয়ে গেছি, আমাকে বোধহয় তোর আংকেলের আর ভাল্লাগে না।’
‘উহ, বললেই হলো—ভাল্লাগে না!’ উষ্মা প্রকাশ করে রোজিনা বলে। যে কিশোরী রোজিনা বউ হয়ে হয়তো স্বামীকে শাসন করা দূরে থাক, ন্যূনতম অধিকারের কথাও বলতে পারেনি, সে-ই এখন তাকে শেখাচ্ছে স্বামীকে শাসনে রাখার কথা! নিজের মনে হাসেন শায়লা।
‘শোনো আন্টি, তোমাকে তো আমার বিয়ার কত কথাই বলছি। এইটা বলি নাই। মোবাইলে আমার জামাই সারাক্ষণ কার সঙ্গে জানি কথা কইত, আমি পাশে থাকলেই কথা বন্ধ। তার মানিব্যাগে একদিন দেখি এক মেয়ের ছবি। কার ছবি জানতে চাইতেই সে খেইপা যায়। আমারে ধরে মারে—কেন এসব জিজ্ঞেস করি এজন্য। পরে শুনি ওই মেয়েকে সে বিয়া করছে কাউরে না জানায়া! আর কত! সেই রাত্রেই পালাইয়া চইল্যা আসছি বাপের বাড়ি। বেডাগুলান এমনি খবিস।’
শিহাবের কথিত নায়িকাপ্রীতির প্রেক্ষাপটে নিজের গল্প বলে রোজিনা কী বোঝাতে চায়, শায়লা তা বোঝেন। তিনি সেদিকে না গিয়ে বলেন, ‘ছবিটা সুন্দর, না?’
‘হুম।’
নিজের অজান্তে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বের হয়। পরক্ষণেই তিনি সচকিত হয়ে তাকান রোজিনার দিকে। ভালোবাসাহীন এক জীবন পার করছে মেয়েটা। রোজিনার জন্য বড্ড কষ্ট হয় শায়লার। বলেন, ‘তুইও কিন্তু বেশ সুন্দর। কী মিষ্টি তোর মুখের গড়ন। তোর আংকেলকে বলব তোর এমন একটা ছবি তুলে এভাবে বাঁধিয়ে দিতে।’
‘উহ, আমার ছবি কিডা দেখব?’ ঠোঁট উল্টিয়ে বলে রোজিনা।
‘কেন, তুই দেখবি। দেখবি আর ভাববি আমি কত সুন্দর!’
একটু হাসতে গিয়েও যেন থমকে যায় রোজিনা। চকিতে মনে পড়ে বিয়ের পর স্বামীর কথা—শইল্যে নাই কিচ্ছু। এই ছেড়ি নাকি সুন্দর!
হঠাৎ করে অশ্রুসজল হয়ে ওঠে তার চোখ। সেটা সামলে সে বলে, ‘হইছে। তুমি এখনই আংকেলকে জিজ্ঞেস করো—এ ছবি ক্যান রাখছে।’
শায়লার চোখও চকচক করে। ঢেউয়ের তোড়ে বালুকাবেলার রেখা মুছে যাওয়া, রোজিনার জন্য তার কষ্ট নাকি শিহাবের প্রতি কৃতজ্ঞতা—কোনটা যে কারণ ঠিক বোঝা যায় না। রোজিনার মতো তিনিও গোপন করেন অশ্রু, তারপর হেসে বলেন, ‘আমার কথা কি তোর আংকেল শোনে! তুইই বরং শাসন করে দিস তোর আংকেলকে।’

সমকালীন আরবি সাহিত্যে যেসব নারী সাহিত্যিক নিজেদের স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন, তাদের অন্যতম মিসরের সাহিত্যিক ও সাংবাদিক নাদিয়া কিলানি (জন্ম: ১ জানুয়ারি ১৯৫০)। গল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতা, শিশুসাহিত্য—প্রায় সব ধারাতেই তিনি রেখেছেন স্বাক্ষর।
৫ ঘণ্টা আগে
কর্ণফুলী থেকে নাফ দুই নদীর মধ্যবর্তী চট্টগ্রামের এলাকা জীববৈচিত্র্যে যেমন অনন্য, রাজনীতিক বৈশিষ্ট্যেও অনন্য। প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হলো এ অঞ্চল অরণ্যসংকুল, সমুদ্রউপকূলবর্তী ও পর্বতবেষ্টিত। এত বৈচিত্র্য বাংলাদেশের আর কোথাও নেই। মধ্যযুগব্যাপী এ অঞ্চল ছিল আরাকানের অংশ।
৫ ঘণ্টা আগে
হাঙ্গেরীয় নিরীক্ষাপ্রেমী ঔপন্যাসিক ও চিত্রনাট্যকার লাসলো ক্রাসনাহোরকাই। ২০২৫ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পান। ভয়, বিশৃঙ্খলা, বিপর্যয়, চূড়ান্ত হতাশা ও বিভীষিকাময় সময়ের মাঝেও শিল্পের শক্তিকে তিনি তাঁর সাহিত্যকর্মে পুনরুদ্ধার করেছেন।
৬ ঘণ্টা আগে
১৯০৬ সাল বা খ্রিষ্টাব্দের ২৫ অক্টোবর যিনি মা-মাটি-দেশ-জাতিকে ধারণ করে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন, তিনি দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ। একই সময়ে এবং একই ক্ষণে ধরণিতে আরো মানুষের আবির্ভাব স্বাভাবিক। তবে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ কালে কালে বৈদগ্ধ্যে যুগস্রষ্টা হয়ে উঠেছেন বলেই তিনি আলাদা ও অনন্য।
৬ ঘণ্টা আগে