আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

প্রেমের কবি, সুফি ও দার্শনিক

জালালউদ্দিন রুমি আজও কেন প্রাসঙ্গিক

তারিক হাসান

জালালউদ্দিন রুমি আজও কেন প্রাসঙ্গিক

আটশ বছরেরও বেশি আগে (৩০ সেপ্টেম্বর, ১২০৭ সাল) আফগানিস্তানের বালখ শহরে জন্ম নেন ত্রয়োদশ শতকের প্রখ্যাত আধ্যাত্মিক কবি ও দার্শনিক মাওলানা জালালউদ্দিন মোহাম্মদ রুমি। বালখ তখন খোরাসান প্রদেশের অন্তর্গত এক পার্সিয়ান শহর। শুধু রুমি নামেও তিনি পরিচিত পশ্চিমে। রুমির জন্ম এমন একসময়ে, যখন মঙ্গলদের আক্রমণে বিপর্যস্ত মধ্য এশিয়া। ত্রয়োদশ শতকে আব্বাসীয়দের সোনালি যুগ সমাপ্ত, সেলজুকদের শক্তিও ক্ষয়িষ্ণু, স্পেনে মুরিশদের নিয়ন্ত্রণ ক্রমেই কমে আসছে। সে সময়ে বালখ শহর ছিল খোয়ারিজমিয়ান সাম্রাজ্যের অন্তর্গত।

মঙ্গলদের আক্রমণে জনজীবনে আতঙ্ক নেমে এসেছিল সাম্রাজ্যজুড়ে। ১২১৮ সালে রুমি তার পরিবারসহ বাগদাদ চলে যান। এরপর মক্কা, সিরিয়ার দামেস্ক ও আলেপ্পো, ইরানের নিশাপুরসহ বিভিন্ন শহর ঘুরে ১২২৮ সালে রুমি পরিবারসহ বর্তমান তুরস্কের কোনিয়া শহরে থিতু হন। কোনিয়া সে সময় ছিল সেলজুক সাম্রাজ্যের অন্তর্গত। রুমির পরিবার ছিল সম্ভ্রান্ত মুসলিম। বাবা বাহাউদ্দিন ভেলেদ ছিলেন নামকরা পণ্ডিত, দাদাও ছিলেন তেমনই, রুমির ভবিষ্যৎও এমন পাণ্ডিত্যময় হবেÑএমনটাই ছিলও সমাজে কাঙ্ক্ষিত। সেলজুক সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদ রুমির পরিবারকে রাজধানী কোনিয়া শহরে আসার অনুরোধ জানালে তারা রাজি হয়ে যান। দেশান্তরী হতে হতে রুমি লিখেছেন

বিজ্ঞাপন

‘আজ আশায়েজ বেগরিজ, ঈমানি রা ফারামোশ কোন,

ভা দার যায়ী জিনদেগি কোন কে আজ আন মিতারসি’

এর ভাবার্থ দাঁড়ায় আরামদায়ক গৃহত্যাগ করো, ভুলে যাও নিরাপত্তা, চলে যাও সেথা, যেখানে রয়েছে অনিশ্চয়তা।

রুমির বিখ্যাত হওয়ার পেছনে রয়েছে পার্সিয়ান কবি শামস তাবরিজি। দিন চলে যাচ্ছিল ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে আর টুকটাক কিছু লেখালেখিতে। এমন সময় ১২৪৪ সালে শামসের সঙ্গে রুমির প্রথম সাক্ষাৎ হয় এক সরাইখানায়। আলাপচারিতার একপর্যায়ে শামস এক ঢিলে রুমির লেখা বইটি পানিতে ফেলে দেন, কিন্তু বইটি পানিতে ভিজে নষ্ট হয়নি দেখে রুমি জিজ্ঞাসা করেন, এটি ভিজল না কেন? শামস জবাব দেন, এটি বোঝার যোগ্য তুমি এখনি হওনি। শামসের সংস্পর্শে রুমি আরো আধ্যাত্মিক হয়ে ওঠেন। শামসের সান্নিধ্যে যুবক রুমি এতটাই মজে যান যে, একবার তাকে খুঁজতে রুমি তার ছেলেকে দামেস্ক শহরে পাঠান। ১২৪৮ সালে ওস্তাদ শামসের সঙ্গে রুমির শেষবার দেখা হয়, শামস হারিয়ে কোথায় যেন চলে যান, অনেক খোঁজা খুঁজি করেও রুমি আর তাকে পাননি। শামসকে হারানোর বেদনা থেকেই রুমি লেখেন বিখ্যাত দিওয়ান ই শামস ই তাবরিজি, এই বইয়ে রয়েছে চল্লিশ হাজার চরণ ও তিন হাজার গজল। তিনি লিখেছেনকে বলেছে মহাকালের শামস গত হয়েছে? কে বলেছে আশার প্রভাকর হারিয়ে গেছে?’

ধর্মীয় পণ্ডিত রুমির খ্যাতি তখন মুসলিম বিশ্ব ছাড়াও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যেও পৌঁছেছে। একবার কনস্টান্টিনোপল (আজকের ইস্তানবুল) থেকে একজন যাজক রুমির গল্প শুনে কোনিয়া আসেন সাক্ষাৎ করতে। রুমিকে খুঁজতে বের হতেই পথিমধ্যে রুমির সঙ্গে দেখা। যাজক তাকে দেখে প্রণাম করতে থাকেন মাটিতে মাথা ছুঁয়ে। কথিত আছে যাজক ৩০-বার মাটিতে মাথা ছুঁয়ে উঠে দেখেন রুমি তখনো তার দিকে ফিরে মাথা ঝোঁকাচ্ছেন, রুমি ৩৩-বার মাটিতে মাথা ছুঁয়েছেন শ্রদ্ধাবনত হয়ে। যাজক রুমির বিনয়ে এতটাই বিমোহিত হন যে, যাজকের পোশাক খুলে তিনি রুমির সঙ্গে পোশাক বিনিময় করেন এবং রুমির শীর্ষত্ব গ্রহণ করেন। রুমি ধর্মীয় গৃহে ফিরে ছেলেকে বলেন, ‘আজকে এক যাজক আমাদের নম্রতা ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু নবীর সহায়তায় এবং সৃষ্টিকর্তার কৃপায় তিনি তা পারেননি।’

পজমহ

একবার কোনিয়া শহরের সেনাপতি মঈন উদ্দিন পারভানে রুমিকে দাওয়াত দেন একটি ঘূর্ণি (Whirling) নৃত্যানুষ্ঠানে। রুমি প্রাসাদে প্রবেশের আগে প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে ছিলেন শেষ অতিথি না আসা পর্যন্ত। এমনকি অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর সর্বশেষ অতিথি না যাওয়া পর্যন্ত তিনি দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। ছেলের জিজ্ঞাসার জবাবে রুমি বলেন, ‘আমি যদি একজন অতিথিকে রেখেও ভেতরে চলে যাই, তাহলে জান্নাতে কীভাবে আমি আমার শীর্ষদের নিয়ে যাব!’

রুমিকে পশ্চিমে পরিচয় করিয়ে দেন মার্কিন লেখক মূলত কোলমেন বার্কস। তবে ঊনবিংশ শতাব্দীতে কয়েকজন জার্মান লেখক রুমির বই থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বই লিখেছিলেন। ১৯৭৬ সালে কোলমেন রুমির কবিতাগুলো আমেরিকান ছন্দে প্রকাশ করেন। দি এসেনশিয়াল রুমি বইটি ইংরেজিতে অনূদিত হওয়ার পর থেকে বেশ সাড়া জাগায়। রুমির শব্দ ও বাক্যের আক্ষরিক অনুবাদ করা যায়নি, তবে মূল ভাবার্থ ঠিক রেখে অনুবাদ করেছেন কোলমেন। ২৩টি ভাষায় প্রায় ২ মিলিয়ন কপি বই বিক্রি হয় প্রকাশক হারপারওয়ানের প্রকাশনা থেকে। বইটি মার্কিন অভিনেতা-অভিনেত্রী, লেখক ও সাধারণ পাঠকের মনে স্থান করে নেয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচুর পাতা খোলা হয় রুমির রুবাইয়াত (চার লাইনের চরণ) প্রকাশ করতে। বোদ্ধামহল মনে করে, মার্কিন পুঁজিবাদী সমাজে হতাশা ও বিষণ্ণতা এতটাই ছেয়ে গেছে, মানুষ রুমির আধ্যাত্মিক কবিতাগুলো পড়ে মানসিক প্রসাদ খুঁজতে চেয়েছেন। রুমি যেমন লিখেছেন

‘পাহস জখমা ইয়ে মাহান চাই,

নুর আজমিয়া ইন জখমা হা ভারেদ মিশাবাদ’

অর্থাৎ ক্ষত হলো সেই স্থান, যেখান দিয়ে আলো প্রবেশ করে। এই চরণ দিয়ে তিনি কাউকে কষ্ট পেতে নিষেধ করেছেন, বরং বলেছেন ব্যর্থতা থেকেই তুমি শিখবে, আলোকিত হবে আরো। রুমির সৃষ্টি সময়, স্থান ও সংস্কৃতিকে অতিক্রম করেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। এর কারণ সম্পর্কে আধ্যাত্মিক কবি এন্ড্রু হার্ভে বলেছেন, রুমির লেখনীতে রয়েছে আধ্যাত্মিক দৃষ্টি, প্লেটোর মতো গভীর বুদ্ধিদীপ্ত অন্তর্দৃষ্টি এবং মতপ্রকাশের লক্ষ্যে জুতসই শব্দের গাঁথুনি, যা অনেকটাই শেকসপিয়ারের মতো। শেকসপিয়ারের জন্ম রুমির অনেক বছর পরে হলেও যেহেতু পশ্চিমে শেকসপিয়ার সাহিত্যে বিশেষ স্থান দখল করেছেন, তাই মুসলিম বিশ্ব থেকে পশ্চিমে তফাতে আসা কোনো সাহিত্যকে পশ্চিমারা রেনেসাঁ যুগের লেখকদের সঙ্গে তুলনা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তবে পাঠকমহল এমনও বলে, কোলমেন রুমিকে আমেরিকায় পরিচয় করিয়ে দেন একজন ধর্মহীন মানুষ হিসেবে। তিনি রুমির লেখা থেকে ইসলামকে অনেকখানি বাদ দিয়ে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। ফলে খ্রিষ্টান প্রভাবান্বিত পশ্চিমে রুমির বিকশিত হতে অসুবিধা হয়নি। কিন্তু রুমি তার লেখনীতে আল্লাহ ও রাসুলকে কে বহুবার এনেছেন।

‘দর মিয়াঁ-ই উম্মত-ই মরহুম ব্যাশ,

সুন্নত-ই আহমাদ মা-হেল, মাহকুম ব্যাশ’

অর্থাৎ তোমরা বিশ্বাসীদের দলভুক্ত হও, যা স্বর্গীয় আশীর্বাদপুষ্ট, নবীজির পথ থেকে চ্যুত হয়ো না, তার নির্দেশ মেনে চলো।

রুমির লেখা মসনভীতে রয়েছে পঞ্চাশ হাজার চরণ। এই বইয়ে আছে বাইবেল, কোরআন, হাদিসের প্রসঙ্গ, দৈনন্দিন জীবন থেকে নেওয়া ঘটনা। এছাড়া আছে রানি শেবার সঙ্গে রাজা সলোমনের মিলনের প্রেক্ষাপট। রুমির রুবাইয়াত ও গজলে রয়েছে সৃষ্টির সব জীবের মধ্যে ভালোবাসার তাগিদ রয়েছে দুঃখ-বেদনা থেকে মুক্তির আহুতি। নদীর তীরে ইঁদুর ও ব্যাঙের মধ্যে গড়ে ওঠা অকৃত্রিম বন্ধুত্বের অবতারণা করেছেন তিনি এক গল্পে। দুটো প্রাণী নিরাপত্তার শঙ্কা এড়িয়ে জীবনের গল্প, আনন্দ, নিগূঢ় সত্য বলতে চেয়েছেন পরস্পরকে প্রতিনিয়ত নিয়ম করে। যেন একজন ইহুদি ও একজন ফিলিস্তিনি প্রতি সন্ধ্যায় নিজেদের মেলে ধরেছেন কোনো এক পানশালায়। রুমির আরেকটি অনবদ্য সৃষ্টি হলো ঘূর্ণি নৃত্য (whirling dance)। কথিত আছে, রুমির জীবন থেকে শামস হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে রুমি বেদনায় ডুবে যান। একদিন তিনি ঘরের বাইরে বসে ছিলেন। ঘরের বাইরে অনেকগুলো লম্বা লম্বা পরস্পর সংযুক্ত স্তম্ভ ছিল, যা বেয়ে আঙুর ও ডুমুর ফল হতো প্রতিবছর। রুমি আনমনে বেদনায় একটি স্তম্ভ ধরে ঘুরতে থাকেন, ঘূর্ণি বেগ বেড়ে গেলে রুমি ভুলে যান শামসকে হারানোর বেদনা। এরপর থেকে রুমির শীর্ষরাও মাঝে মাঝে এই ঘূর্ণিনৃত্যের আয়োজন করতেন, যা কোনিয়ার সুলতান, আমির ও সেনাপতিদের মধ্যেও জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই ঘূর্ণিনৃত্যে একজন ব্যক্তি সাদা পোশাক পরে পবিত্র হয়ে দুই হাত মেলে ঘুরতে থাকে। এক হাত আকাশের দিকে মুখ করে থাকে, যার মধ্য দিয়ে সৃষ্টিকর্তার কৃপা লাভ করে, অন্য হাতের কবজি পৃথিবীর দিকে তাক করা থাকে, যার মধ্য দিয়ে সৃষ্টিকর্তার কৃপা মানবজাতির কাছে পৌঁছায়। রুমির জন্মদিন ও মৃত্যুদিবস ইরান, তুরস্ক, পাকিস্তানসহ অনেক মুসলিম দেশেই উদযাপন করা হয়। ইউনেসকো ২০০৭ সালে রুমির জন্মের আটশ বছর পূর্তি উদযাপন করেছিল। বাংলাদেশে রুমিকে নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক কোনো আলোচনা বা অনুষ্ঠান হয়েছে বলে শোনা যায়নি। কবি, দার্শনিক জালালউদ্দিন রুমি বিশ্বময় আজও জনপ্রিয়। দেশে দেশে রুমির চর্চা হয়। এত জনপ্রিয়তার কারণ তার সুফি দর্শন, গভীর আধ্যাত্মিকতা ও প্রেমময় কবিতার জন্য। তার অমর সৃষ্টি মসনভী। রুমির কর্ম ও প্রাক-মধ্যযুগের মুসলিম বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও লেখকদের নিয়ে গবেষণা করার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান করা সময়ের দাবি। যে প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের সঙ্গে বিকাশমান মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর বহুমাত্রিক সংযোগ ঘটাতে পারে।

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন