বৃষ্টিহীন জনপদে

আহমেদ দীন রুমি
প্রকাশ : ৩১ আগস্ট ২০২৫, ১৬: ১৫

যেকোনো জনপদের চাইতে বাংলার আজান ব্যতিক্রম

যেন দিনে পাঁচবার আর্তনাদ করেন মুয়াজ্জিন

বিজ্ঞাপন

কণ্ঠে ঝরে পড়ে শত বছরের নিগৃহীত জীবনের মর্সিয়া।

মুয়াজ্জিন বুঝেননি এখনো

শ্রোতারা এখানে বসবাস করে অতীতের কোলাহলে,

নিমগ্ন বাগদাদ, কর্ডোবা, কায়রো ও ইস্তাম্বুলের জৌলুসে,

পরিবর্তন নেই বিদ্যমান দুর্ভাগ্যে,

অতীতের সামর্থ্য থাকলে তো আর অতীতকে অতীত হতে হতো না,

দাঁড়িয়ে থাকত অনিবার্য বর্তমান রূপে

মানুষের পা পশ্চাৎ-মুখী নয়, চোখও দেখতে পায় না পেছনে

তবু কেন যৌবন হারিয়ে ফেলা বৃদ্ধের ন্যায় স্মৃতিচারণ?

কেন অতীতের সমাধিতে বর্তমানকে ঠেলে দেওয়া বারবার?

বর্তমান কি শত্রু?

নাকি অতীত সামেরির বাছুর?

থামুন মুয়াজ্জিন, সমাপ্তি টানুন পৌনঃপুনিক মর্সিয়ায়,

তারচেয়ে ছড়িয়ে দিন বেলালের ‘আহাদ, আহাদ’

রুহ পাক বৃদ্ধ আত্মাগুলো

নির্মাণ করুক ভবিষ্যৎ

এ মাটিতে জন্ম নিক এ সময়ের পবিত্র আত্মারা;

বিলাপ নয়, এই উত্তপ্ত গ্রীষ্মের বারুদে

এখন সময় শুধু ইসতিসকার;

যতক্ষণ না এ বন্ধ্যত্ব বর্ষার তোপে হয় দূর

যতক্ষণ না উঁকি দেয় নয়া সম্ভাবনা

যতক্ষণ না ভেসে যায় বহুরূপী সামেরির জাদুর বাছুর।

জীবন যেমন

কাউরে বোঝাইতে পারি নাই আমার দেহা জীবন

কথা আছিল শাহজালালের শিষ্য হইয়া রওনা হইমু নিরুদ্দেশ

ইয়ামেনের শান্তি ছাইড়া পইড়া থাকুম বোরহানুদ্দিনের এলাকায়;

কিংবা হুজভেরির জলসায় বইসা শিখমু পাপ ধুইবার খেলা

আচমকা পাগলা বানাইবো গায়েবের রূপ,

তা আর হইলো কই?

জিন তাড়াইবার লাহান তারা আমারে ঠাইসা ধরে মরিচপোড়া ধোঁয়ায়,

শোনায় লিফটের গড়গড় শব্দ আর নয়টা-পাঁচটার অফিস।

কাউরেই বোঝাইতে পারি নাই আমার দেহা জীবন,

সেই কবে ঋণ রাইখা গেছে মাগরেবের ইবনে বতুতা

কাউরে তো শোধাইতে হইবো সেই ঋণ

বাংলা থাইকা যাইতে হইবো বাগদাদ, মরক্কো, কর্ডোবা আর ইস্তাম্বুল;

হইলো না, না ঘর ছাড়া হইলো, না ঘর ছাড়লো আমারে

অথচ কথা আছিল পথের প্রতিডা পাথর শোনাইবো ইতিহাস

প্রতিডা গাছ, প্রতিডা তারা আর প্রতিডা রাইত

শুনাইবো চাইপা রাখা বেবাক গোপন কথা;

তা আর হইলো কই?

দাগি আসামির মতো আমারে বাইন্দা রাখা হয় মাথা উবু কইরা

শিখান হয় ব্যাংকের চেক বই আর একটা নরম শইলের গন্ধ।

শূন্যায়ন

তিনশো ষাটটি মূর্তি সরানোর পর

কা’বার ভেতরে যা পড়ে থাকে, তার নাম শূন্যতা;

ব্যাখ্যাহীন, ভাষ্যহীন

অনুমান ও বৈষয়িক বিশেষণবিহীন শূন্যতা,

সবকিছু যদি লাত, মানাত আর ওজ্জায় মিশে যায়

কোন পথে নেমে আসবে খোদায়ি আলোক?

ধূলায় পূর্ণ গ্লাসে স্বর্গের শরাব আটকায়?

বহু যুগ চলে গেছে, দেখেনি মুমিন

মূর্তি এসেছে ফিরে নতুন পোশাক আর নতুন ভাষায়

ক্ষমতা, অর্থ, বিত্ত, সম্মান কিংবা পূর্বপুরুষ

দল, চেতনা, মতবাদ কিংবা জাত্যাভিমান

বসে আছে উপাস্যের মসনদে

এবং হাসছে রাত-দিন

নয়া চেহারায়,

হৃদয়ে তাই দারুণ ভিড়, জাহেলি যুগের কা’বা যেন

তিনশো ষাট মূর্তির বোঝা নিয়ে

নিশ্চিন্তে ঘুরছে মুমিন, বুঝেনি এখনো।

অথচ শূন্য হতে হয় আগাগোড়া

যতদিন না তৈরি হয় মূর্তিমুক্ত বিশুদ্ধ হৃদয়

শূন্যগর্ভ কা’বার মতো,

ততোদিন সকল চিন্তা মরিচিকাময়,

সমস্ত কাজ মনগড়া।

ঐকান্তিক

সবাই যখন ঘুমিয়ে গেছে, তখন তোমার সামনে দাঁড়াই

লজ্জা এবং শঙ্কা ছাড়াই

এক নাগাড়ে বলতে থাকি সকল কথা

ভুল বৃক্ষের তলায় যাওয়া আদম হাওয়ার যে ব্যর্থতা

সেটাই ভারী হচ্ছে ক্রমে

অর্ধজীবন ফসকে গেছে আটকে থেকে সে গন্ধমে,

সম্ভবত তারচেয়ে বেশি; লাত, মানাত আর ওজ্জা ছেড়ে

ঘুরছি মাথায় নানান মতের মূর্তি ধরে,

বুকের ভেতর প্রচণ্ড ভিড়, তোমায় রাখার জায়গাখানি

নিঃসঙ্গতার ক্ষণ না এলে হয় না জোগাড় কেমন জানি।

তাই তো সবাই ঘুমিয়ে গেলে দাঁড়াই এসে

যেমন ফেরে সন্ধ্যা হলে দুষ্ট ছেলেও মায়ের পাশে;

আহ, দয়াময়!

মুখ ফেরানো আমার স্বভাব, তোমার তো নয়,

এ দুর্বোধ্য জীবন নিয়ে

কার কাছে আর জায়গা পাব? ডাকব কাকে জবাব চেয়ে?

আর কে এমন সর্বগ্রাসী অন্ধকারে

অবাধ্যতার ফরদি শুনেও ভরসা দেবে নতুন করে?

সব কোলাহল থমকে গেলে যখন নিজের সত্তা খুঁজি,

তখন যেন সামনে তোমার দাঁড়াই একা,

গাফেল মনে তখন বুঝি

‘তোমায় ভুলে থাকার মানে নিজের থেকেই পালিয়ে থাকা’।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত