হয়তো পোয়েটিক জাস্টিস, হয়তো দুর্ভাগ্য

আহমদ সাব্বির
প্রকাশ : ১২ জুলাই ২০২৫, ১৪: ৩১
আপডেট : ১৪ জুলাই ২০২৫, ১৭: ৪৭

নাস্তার টেবিলে বসে সকাল সকাল মেজাজটা বিগড়ে গেল।

সবই ঠিক আছে প্রায়, একটা কাপে উষ্ণ গরম জলে ভিনেগার দেওয়া হয়েছে, সাদা পিরিচে এক মুঠো কাজু বাদাম, পাতলা শাঁস-সহযোগে এক গেলাশ ডাবের পানি, ফালি ফালি করে কাটা কচি শসা এবং কমলা রঙের গাজর—সবই আছে নিয়মমতো। শুধু ডিম পোচ দুটো নেই। বদলে রুই মাছের বড় একটা পেটি অলিভ অয়েলে সামান্য ভেজে পরিবেশন করা হয়েছে। আর তাতেই মেজাজটা বিগড়ে গেছে ফারুক সাহেবের। বারবার করে বলা হয়েছে, সকালে যেন ডিম পোচই দেওয়া হয়।

বিজ্ঞাপন

সারা দিনের প্রোটিনের চাহিদা পূরণে ডিমপোচের বিকল্প কী! তৈলাক্ত মাছ হয়তো বিকল্প হতে পারে, কিন্তু সকাল সকাল শুধু শুধু ভাপ দেওয়া মাছ খেতে তার রুচিতে বাঁধে। বিবমিষা জাগে। মনে হয় যেন, ভাজা নয়, কাঁচা মাছই গজগজ করে চিবুচ্ছেন। এমনিতেই ডিম পোচেও তার ঘোর অস্বস্তি। হাফ সেদ্ধ কুসুমের গন্ধে তার গা গোলায়। তবু অনন্যোপায় হয়ে খেতে হয়। ডায়াবেটিসের সিরিয়াস রোগী তিনি। হাঁটাচলা মোটামুটি নিয়ম মেনেই করার চেষ্টা করে এসেছেন এযাবৎকাল। তবু কন্ট্রোলে থাকে না। শেষমেষ নাতি-নাতনিরা এই ডায়াট-চিকিৎসা খুঁজে এনেছে।

এতে নাকি মরতে বসা ডায়াবেটিক রোগীও প্রাণ ফিরে পায়! তা পেতে পারে! কিন্তু এসব ঘাসপাতা চিবুনোর কী অর্থ আছে! এর চেয়ে তো মরে যাওয়াই ভালো। রসে টইটম্বুর রসগোল্লা, বেশি করে মসলা দেওয়া কষানো গরুর মাংস, কচি খাসির তেল জবজবে কাচ্চি, ইলিশ মাছের দোপেঁয়াজাই যদি খেতে না পারা গেল, তবে সে জীবনের অর্থ কী! তবু নাতি-নাতনির আবদারে এই ঘোড়ার জীবনযাপনে রাজি হয়েছেন তিনি। বিশেষ করে নাতনি তিন্নি। তাকে অসম্ভব স্নেহ করেন ফারুক চৌধুরী। অনেক ঘেঁটেঘুঁটে বেশ কয়েকজন চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদের সঙ্গে পরামর্শ করে তিন্নি তার জন্য এই ডায়াট প্লান তৈরি করেছে। ফলে ‘না’ করতে পারেন না। কিন্তু তাই বলে কাঁচা মাছ! ডিম পোচ তবু গেলা যায়! এই সাতসকালে কাঁচা মাছ তিনি কীভাবে মুখে দেবেন!

বাড়িতে রান্নাবান্নার তদারকি করে ছেলের বৌ, তিন্নির মা। মেজাজ দেখানোর জন্য তাকে তো আর ডাকা যায় না! ঝিকে মেরে বৌকে শেখানোর মতো করেই মেজাজটা দেখানোর জন্য তিনি নিজের বৌকে উদ্দেশ করে হাঁক পাড়লেন—‘আজাদের মা, মাছ দিছো ক্যান! সকালে না ডিম পোচ দেওনের কথা! ডিম পোচ কই? এই মাছ নিয়া যাও। ডিম দাও।’

বৌকে ডাকলেও হাজির হলো ছেলের বৌ। লায়লা বেশ হাসিখুশি উৎফুল্ল স্বভাবেরই মেয়ে। তা সত্ত্বেও কেন যেন বাড়ির প্রায় সকলেই তার সামনে তটস্থ থাকে। ঠিক তটস্থ নয়, সবাই তাকে বোধহয় সমীহই করে। ফারুক চৌধুরি তার বড় ছেলের এই বৌকে ঠিক ভয় পান না, তবু মনে মনে একটু কেমন যেন বোধ করেন লায়লার উপস্থিতিতে। তার সামনে গম্ভীর হয়ে বা মেজাজ দেখিয়ে কিছু বলে উঠতে পারেন না তিনি। আর তার ফলেই মেজাজ কখনো বিগড়ে গেলে লায়লাই তার সামনে এসে হাজির হয়। ফারুক চৌধুরির ধারণা, তার বউই এমন সব মুহূর্তে লায়লাকে তার সামনে পাঠায়। তার বউ নানা ধরনের কৌশল জানে। এটা নিঃসন্দেহে ওই মহিলাটারই কোনো কৌশল।

লায়লা যথারীতি হাসি হাসি মুখ করেই বলে, ‘ডিম পাওয়া যাচ্ছে না, আব্বা। আরিফ কয়েকবার গিয়ে ফিরে এসেছে।’

এবারে তিনি মেজাজ দেখানোর জন্য মোক্ষম একটা ক্ষেত্র পেয়ে গেলেন বোধহয়। তার সব ক্ষোভ গিয়ে পড়ে আরিফের ওপর। অনেক দিন ধরেই দেখে আসছেন, কাজের ছেলে হিসেবে আরিফ ছেলেটা যথেষ্ট ফাঁকিবাজ। অলস। তারপরও লায়লা যে কেন তাকে ছাঁটাই করছে না!

‘শুয়োরটা কই। আরিফ! এই আরিফ!’

আরিফ রান্নাঘরেই ছিল। বাজারের ব্যাগ থেকে বাজার বের করে জায়গামতো রাখছিল সব। ফারুক চৌধুরির চিৎকারে দৌড়ে ছুটে আসে। কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে একটা চেয়ারের পেছনে। ফারুক চৌধুরিকে তার বেজায় ভয়। আসলে ঠিক ফারুক চৌধুরিকে নয়, লোকটার মুখের ভাষা যে বিশ্রী তাকেই মূলত ভয় করে আরিফ। শুয়োর-জানোয়ার আরো আরো উচ্চারণ-অযোগ্য যেসব ভাষায় তিনি নিত্য কথাবার্তা বলেন, সেসব শুনলে আরিফের গা গোলায়। রাস্তার মানুষের ভাষাও এর চাইতে অনেক ভালো। এই মানুষটা মুখের এই ভাষা নিয়ে মহল্লার এমন সম্মানী ব্যক্তি কীভাবে হয়ে উঠতে পারলেন—বিষয়টা মাঝেমধ্যে গ্রাম থেকে আসা আরিফকে ভীষণ ভাবায়।

‘এই জানোয়ার, ডিম পাস নাই মানে? কই কই খুঁজছোস? বাজারে কি ডিমের আকাল পড়ছে! মুরগিরা কি সব ধর্মঘট ডাকছে! ডিম পাও না মানে কী! বালছাল বুঝাও!’

শেষের এই শব্দটা উচ্চারণ করেই ফারুক চৌধুরির মনে পড়ল, লায়লা সামনেই আছে। তার সামনে তাকে কথাবার্তায় আরো সাবধানী হতে হবে। কিন্তু কী করার, এত দিনকার অভ্যাস! মুখে এসেই যায়।

কথা বলে লায়লাই। সদ্য ভাজা গরম পরোটাগুলো প্লেটে সাজাতে সাজাতে সে বলে, ‘আরিফের কী দোষ দেবেন, আব্বা! রাস্তাঘাটের অবস্থা তো ভালো নয়। আপনার ছেলে কইল, যাত্রাবাড়ী থেকে কাঁচপুর ব্রিজ পর্যন্ত নাকি জাম হয়া আছে। গত দিন বিকাল থেইকাই। গাড়িগুড়ি কিছু ঢুকবার পারতাছে না। কাঁচামালের পিকআপ ট্রাক সব রাস্তায়ই। আড়তে না ঢুকলে মহল্লার বাজারে আসবে কোত্থেইকা! ডিমেরও একই অবস্থা! তরিতরকারিও তো পায় নাই বাজারে। একটু শুকনা ফুলকপি, বুড়া লাউ আর মিষ্টিকুমড়া পাইছে। মাছও নাই। ফ্রিজে কিছু মাছ-মাংস আছে, এইটাই ভরসা। ঝামেলা-ঝুমেলা না কমলে বাজার-সদাইয়ের যে কী অবস্থা হইবো আল্লাহই জানে!’

কথা শেষ করেই লায়লা ছেলে আর মেয়েকে নাস্তার টেবিলে আহ্বান করে। স্বামীকেও ডাকে।

‘কই, আসো। নাস্তা দিসি। ঠান্ডা হয়ে গেলে আবার ভাল্লাগবে না। তাড়াতাড়ি আসো।’

লায়লা রান্নাঘরে ফিরে গেলে ফারুক চৌধুরির মনে পড়ে—হুম, কদিন ধরে পরিবেশ একটু উত্তপ্তই হয়ে আছে। ছাত্ররা আবারও কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে সরব হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে কিছু সংঘর্ষও বেধেছে তাদের। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু হতাহতের ঘটনাও ঘটে গেছে। পুলিশ আর ছাত্রলীগ-যুবলীগ কিছু জায়গায় বাড়াবাড়িও করেছে বটে। সেটা আন্দোলন দমন করতে গিয়ে একটু-আধটু ঘটেই ঘটে। অতশত হিসাব করে কি আর আন্দোলন দমানো যায়! কিন্তু তাই বলে সড়ক অবরোধের মতো সাহস তাদের কীভাবে হয়! সামান্য একটা আন্দোলন ঘিরে এত এত মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তোলার হিম্মত তারা কোথায় পায়! নির্ঘাত একাত্তরের পরাজিত শক্তি এখানে ঢুকে গেছে। তাদের উপস্থিতি ছাড়া সাধারণ ছাত্রদের পক্ষে এত বড় অবরোধ সামলানো সম্ভব নয়।

এক ফালি কচি শসা মুখে পুরে ফারুক চৌধুরি চিবুতে থাকেন। বিস্বাদ লাগে। তার চেহারায় গভীর ভাবনার ছাপ ফুটে ওঠে।

‘রাজাকারগুলারে একাত্তরেই নির্বংশ করে দেওয়া উচিত ছিল। তাইলে সময়ে সময়ে আর ফোঁসফাঁস করার মতো কেউ থাকত না’—স্বগতোক্তির মতো উচ্চারণ করেন ফারুক চৌধুরি, মুক্তিযোদ্ধা ফারুক চৌধুরি।

‘একা একা কার লগে আলাপ পারতেছেন, আব্বা!’

‘কার লগে আর, নিজের লগেই। তোমরা কী করতাছো! পোলাপানের একটা ক্যাচাল থামাইবার পারতাছো না!’

‘ক্যাচাল তো আব্বা, আর ছোটো নাই। ডালপালা গজায়া বিরাট মহিরুহ হইবার লাগছে। আমরা তো গুটায়াই আনছিলাম। আপনাগো মুরব্বি নেতারাই না ক্যাচালডা বাড়াইলো! কোটা সংস্কার হইবো না তো হইবো না। ব্যস, পোলাপানরে হাই কোর্ট-সুপ্রিম কোর্ট-রাষ্ট্রপতি চেনাইতে যাওনের দরকারডা আছিলো কী! আপনাগো মুরব্বিরাই তো নাবালক পোলাপানগো সাবালক বানাইলো। লাই দিয়া সবগুলারে মাথায় তুলছেন, এবার নামান।’

‘শোনো, আজাদ, মুরব্বিরা পলিটিশিয়ান। হ্যারা তো হ্যাগো পলিটিক্স করবই। তোমরা তোমাগো মতো কাম কইরা যাবা। তাগো কথা দিয়া তোমাগো কী কাম!’

‘আমরা আব্বা, আমাগো কাম তো করলামই। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিকলীগ, হকার্সলীগ—কেউই বাদ নাই নামতে। ডলা তো কম দিলাম না। এবারে হাওয়া অন্য রকম লাগতাছে। সুবিধার মনে হইতাছে না।’

‘তোমগোর বয়স অহনও কম। অল্পতেই ঘাবড়ায় যাও।’

‘কী কন আব্বা! পলিটিক্স আপনেরা করেন ঠিকাছে। কিন্তু রাজপথের লড়াইটা তো আমরাই ফাইট দিই। তেরোতে ঘাবরাইলাম না, আঠারোর কোটা আন্দোলনে ঘাবরাইলাম না, বিরোধী দলের এত এত নাশকতায় ঘাবরাইলাম না, মোদিবিরোধী আন্দোলনে ঘাবরাইলাম না, আর এহন আইসা ঘাবরামু! এইবারের ঘটনা সত্যই অন্য লাগতেছে আমার কাছে।’

‘আমিও তো হেই কথায় কই, তোমরা রাজপথের লড়াকু সৈনিক। এত এত আন্দোলন থামানোর অভিজ্ঞতা তোমাগো। তোমরা দমে গেলে চলে! এই দলের প্রাণই তো হইল গিয়া তোমরা!’

‘আমরা! দলের প্রাণ! ওই কথা কয়েন না, আব্বা!’

‘কী আজাদ, দলের ওপর নাখোশ নাকি!’

‘আব্বা, আমরা তো হইলাম সাধারণ কর্মী। আমাগো খুশি-না খুশিতে দলের কী আসে যায়, কন!’

‘হ, বুঝছি! দল যে গতবার তোমারে নমিনিশন দিল না, সেই ঘটনা অহনও ভুলবার পারতাছ না। আজাদ, তুমি আমার ছেলে। আমাদের রক্তের সম্পর্ক। তোমারে আগেও কইছি, কমিশনার না হইতে পারনের দুঃখ তোমারে ভুলতে হইবো! তুমি ফারুক চৌধুরির পোলা। তোমার নজর অত নিচে থাকব ক্যান! তুমি হইবা এমপি। সামনের বার এমপিতে যেন তুমি নমিনেশন পাও—আমি সেই চেষ্টা করতেছি। আর তুমি অহনও কমিশনার হইতে না পারার অভিমান লইয়া পইড়া রইছো। এগুলান ভালা ব্যাপার নয়, আজাদ। স্বপ্ন বড় করো। মানুষ তার স্বপ্নের লাহান বড়।’

‘না আব্বা, আপনার বড় নেতাগো লাহান আপনে ভি আমারে ভুল বুঝতাছেন। আমি কোনো অভিমান পুইষা নাই। থাকলে পোলাপান নিয়ে এই কদিন এমনে ঝাপায়া পড়তাম না।’

‘যাকগা, তয় কী বুঝতাছো! আমি তো অসুস্থতার লাইগা ওদিককার কিছু খোঁজই নিবার পারতাছি না।’

‘আপনার, আব্বা, এসব নিয়া ভাবনের কাম নাই। হুদা স্ট্রেস নিয়েন না। আপনে রিলাক্স থাকেন।’

‘এত সামান্যতে স্ট্রেস নেওয়ার মতো মানুষ তো তোমার বাপ না, আজাদ! তোমার বাপের কলিজা শক্ত আছে। একাত্তরে রাজাকার কোপানো মানুষ তোমার বাপ! আমি রিলাক্সই আছি।’

‘এই তো আপনে উত্তেজিত হয়া যাইতাছেন। শোনেন, ঘটনা তেমন কিছু না। এই কয়দিনে পুলিশের লগে মিইলা আমাগো পোলাপান কম চেষ্টা করে নাই। আমরা নিজেরাও রাস্তায় আছিলাম। সরাসরি ট্যাকেল দিসি। বোঝেন তাইলে অবস্থা। এইবারের কাহিনি আঠারোর মতোন না। পুলিশ একটারে মারে, ওই একটায় যায়, বাকিডি যায় না। সটান খাড়ায়া থাহে। আমরা তারপরও মাঠে থাকতাম। উপর থিকা অর্ডার আইলো উইঠা যাওনের। বাকিডা নাকি প্রশাসনই দেখব। ঠিক আছে, উইঠা গেলাম আমরা। প্রশাসনই সামলাক। আমরা উঠা মাত্রই স্টুডেন্টরা রাস্তা আটকাইলো। যাত্রাবাড়ী-কাঁচপুর পুরা ব্লক। আমরা মাঠে থাকতে এইটা হইতে দিই নাই। প্রশাসন নাকি সামলাইবো। সামলাক। আমরা আর নাই। বাড়িত বইসা তামশা দেখনই অহন আমগো কাম।’

দুটো গরম পরোটা এনে আজাদের প্লেটে তুলে দিয়ে চেয়ার টেনে বসলো লায়লা।

‘কয়দিন পরপর কোটা নিয়া ক্যাচাল লাগে। কোটা তুইলা দিলেই তো পারে সরকার। মাঝে না তুইলাই দিসিলো। ওই মুক্তিযোদ্ধার নাতিরে কেউ কয়ছিল আবার রিট করতে! কয়দিন পরপর এই ঝামেলা আর ভাল্লাগে না।’

লায়লার এই কথায় প্রায় তেড়ে উঠলো আজাদ। গরম পরোটা মুখের মধ্যে পুরে তা আর গেলারও অপেক্ষা করল না। ফুঁসে উঠল যেন—‘এইসব নিয়া তোমার মাথা ঘামানো লাগব না। তুমি তোমার কাম করো। পলিটিক্স পলিটিশিয়ানদেরকেই করতে দাও।’

‘মাথা না ঘামায়া উপায় আছে! তিন্নির মতো ছেলেমেয়েরা কয়দিন পরপর রাস্তায় নামে। তোমাগো হাতে মার খাইয়া রক্তাক্ত পইড়া থাকে। এইবার তো আরো ভয়াবহ অবস্থা। একটা ছেলেরে দেখলাম কোপায়া মাথা এক্কেবারে আর্ধেক কইরা ফালাইছে। গা শিউরে ওঠে। দেখা যায় না।’

‘তোমার এইসব দেখনের কাম কী!’

‘দেখি নাকি! সামনে চইলা আসে। পোলা-মাইয়াগুলা রাস্তায় মাইর খাইতাছে। বুকের মধ্যে কেমন হু-হু করে। সরকার চাইলেই তো পারে দাবি মাইনা নিতে।’

‘আবার তুমি এইসব নিয়া মাথা ঘামাইতাছো। সবকিছু চাইলেই হয় না। সবকিছুরই একটা সিস্টেম আছে। তুমি আর এই ব্যাপারে একটা কথাও কইবা না। যাও, ওঠো, রান্নাঘরে যাও। আর নাহয় চুপচাপ নাস্তা করো। একটা কথাও কইবা না।’

এই পর্যায়ে এসে আজাদের গজগজানি আরো তীব্র মাত্রা পায়। খাদ্যের কণা মুখের গহ্বর থেকে ছিটকে বেরিয়ে টেবিলের ইতিউতি ছড়িয়ে পড়ে। লায়লা কিছুটা ঘাবড়ে যায়। তার মাথা ও গলার স্বর দুই-ই যথেষ্ট নত হয়ে আসে।

‘মা, লায়লা!’

ফারুক চৌধুরির সম্বোধন-ধ্বনি বড় ধীর, বড় মোলায়েম। অন্য সময় লায়লার সঙ্গে যে স্বরে তিনি কথা বলেন তার চেয়েও নরম। তিনি ব্যবসায়ী মানুষ। কণ্ঠের কারুকাজ বেশ ভালোই রপ্ত আছে তার।

‘তুমি পোলাপানের কোন দাবি মাইনা নেওনের কথা কও, মা! কোটার সংস্কারের পক্ষে আমরা কীভাবে থাকতে পারি! যুদ্ধ করছি, জীবন হাতে নিয়া পাকিস্তানি গো তাড়ায়ছি। দেশটারে স্বাধীন করছি। তার একটা প্রতিদান দেশ কি আমাগোরে দিব না! অনেকে কইতাছে যে, নাতিপুতিরা পাইবো ক্যান! সন্তান পর্যন্তই ঠিক আছিল! আরে, নাতি-পুতিরা কি আমাগো সন্তান না! তারা কি দাদা-নানার সম্মানের ভাগীদার হইব না! এই যে, তোমার মাইয়া, তিন্নি, সে যে এইবার ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পাইল, তা তো ওর দাদার কোটার কারণেই, নাকি! আজাদের বড় বোনের পোলা, তোমাগো ভাইগ্না আবির, সে যে সচিবালয়ে চাকরিটা পাইল, কোন যোগ্যতাবলে সে এই সোনার হরিণটা বাগাইল! কোটা না হইলে কি সম্ভব হইতো! আমাগো এই যে এত সব ব্যবসা-বাণিজ্য, আজাদের কাম-কাজ—মুক্তিযোদ্ধার সনদটা যদি আমার না থাকত তাইলে এইগুলা এমন তরতর কইরা আগাইতো! বুঝতে হবে মা, পোলাপান তো না বুইঝা অনেকের উসকানিতে পা দিয়া কোটা বাতিলের দাবি করবই! হ্যারা তো অবুঝ! কিন্তু কও, যুদ্ধে জান বাজি রাইখা যারা ফাইট দিল রাষ্ট্র তাগোরে, তাগোর পরিবাররে কি সম্মান দিব না! এইডা তো তাদের প্রাপ্য। তাগোর হক। হক নষ্টের পক্ষে কথা কইবা তুমি!’

যদিও শ্বশুরের সামনে এমন নীরব নিস্তব্ধ থাকার মতো মানুষ লায়লা নয়, যদিও লায়লা তার শ্বশুরের এইমাত্র আলাপেও দ্বিমত করার মতো অনেক কিছুই পেয়েছে, তবুও লায়লা নিশ্চুপই থাকে। টুঁ শব্দটাও করে না। এমনকি নীরবতার আধিক্যে আলুভাজি-সহযোগে তার পরোটা চিবুনোর শব্দটাও বুঝি প্রকট হয়ে শোনা যেতে থাকে। লায়লা কোনোই কথা বলে না।

কথা বলে আজাদ।

‘পোলাপানের দাবিও তো, আব্বা, আর কোটা সংস্কারের মধ্যে নাই। হ্যারা তো এখন যা কইতাছে তার অর্থ দাঁড়ায়—সরকার পতন। তারা এখন প্রায় সরকার পতনের মতো দাবিরই আওয়াজ তুলতাছে। তাদের এই ৯ দফা যদি মাইনা নেওয়া হয়, এর অর্থ দাড়াইবো সরকার আর থাকবার পারব না। এই সরকার পইড়া গেলে আমাগোর কী হবে, তার কোনো বিবেচনা আছে! ব্যবসা-বাণিজ্য মার্কেট-বাড়িঘর কিছু থাকব! আগুন জ্বালায় সব ছারখার কইরা দিয়া যাইব পাবলিকে। লাশ ভি খুঁইজা পাওন যাইবো না দাফন-কাফনের লাইগা।’

‘পাবলিকের উপরে যে জুলুম করছেন এতকাল, পাবলিক সুযোগ পাইলে তার বদলা নিতে ছাড়ব ক্যান, বদলা নিব না! বদলা তো নিবই! আগুন আপনেরা কি কম জ্বালাইছেন!’

এই জবাবটা লায়লার মনে অতিশয় উচ্চগ্রামে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। তবে তা মনে মনেই। লায়লা মুখে তার কিয়দংশও উচ্চারণ করে না, কিংবা করতে পারে না। সে বরং নীরবে মাথা নিচু করে ঘিয়ে ভাজা গরম পরোটা চিবুতে থাকে।

‘কীসের আওয়াজ, আজাদ! কিছু কি শুনতাছো!’

ফারুক চৌধুরির উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর শোনা যায়।

‘এত দ্রুতই নাইমা গেছে। আরো পরে না নামনের কথা!’

আজাদের কণ্ঠে উচ্ছ্বাস ঝরে পড়ে।

‘হেলিকপ্টার মনে হচ্ছে!’

কৌতূহল নিয়ে ফারুক চৌধুরি চেয়ে থাকেন বড় ছেলে আজাদের দিকে।

আজাদ সে মুহূর্তে পানির গেলাশে লম্বা চুমুক দিচ্ছিলো বলে বাবার প্রশ্নমাত্রই জবাব দিয়ে উঠতে পারে না। গেলাশের সবটুকু পানি নিঃশেষ করে আজাদ বাবার জিজ্ঞাসার জবাব দিতে মুখ খোলে। কিন্তু তার আগেই নাস্তার টেবিলে এতক্ষণ নিশ্চুপে পরোটা চিবুতে থাকা আজাদের ৯ বছর বয়সী ছেলে সিয়াম বড় উচ্ছ্বসিত স্বরে বলে ওঠে—‘হ্যাঁ দাদু, কপ্টার। জানালা দিয়ে মাত্রই দেখলাম আমি। ভুস করে উড়ে গেল। ভালো দেখা গেল না। যাই, ছাদে গিয়ে দেখি।’

আজকালকার উৎসাহী বালকেরা যেমন চঞ্চল হয়ে থাকে, বলামাত্রই সিয়াম সিঁড়ি ভেঙে সোজা ছাদে উঠে যেতে থাকল। পেছনে পড়ে রইল মা লায়লার বিরক্তিমিশ্রিত আবদার—‘পরোটাটুকু শেষ করে যাও সিয়াম।’

সিয়াম চোখের আড়াল হয়ে পড়লো। হয়তোবা সে সাদেই উঠে গেল। ব্যবসায়ী কাম পলিটিশিয়ান দাদু, দলীয় নেতা কাম এমপি পদপ্রত্যাশী বাবা, কিংবা স্বামী কর্তৃক সদ্য অপমানিতা মা কেউই আর সিয়ামকে নিয়ে ভাবিত রইল না।

‘র‌্যাবের হেলিকপ্টার নাইমা গেছে। রাস্তা দেখবেন আধা ঘণ্টার মধ্যে ফাঁকা হয়া যাইবো।’ আজাদের এই সংলাপের মধ্যস্থতায় সকলেই আবার বর্তমান উদ্ভূত পরিস্থিতির মধ্যে ফিরে এলো।

‘কী করে, গুলি করতাছে নাকি! গুলিরই তো শব্দ মনে হইতাছে! দেখেন আব্বা, হেলিকপ্টার থেইকা কেমন ধোঁয়াও উড়তাছে!’

জানালার বাইরে চোখ ফেলে লায়লা আর নিশ্চুপ থাকতে পারে না। বড় উদ্বিগ্ন দেখায় তাকে। বড় চিন্তিত।

আজাদ এবারে লায়লাকে আর ধমক দিয়ে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে না। বরং সঠিক তথ্য সরবরাহ করে তার মনে উদ্ভূত আতঙ্ক দূরীভূত করতেই তাকে সচেষ্ট হতে দেখা যায়।

‘আরে না, গুলিই। তয় সত্যিকার বুলেট না। রাবার বুলেট। এতে প্রাণহানি ঘটে না। হেলিকপ্টার থেকে রাবার বুলেট আর টিয়ার শেল ছুড়তাছে। ধোঁয়া ওই টিয়ারশেলেরই। ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করতে রাবার বুলেট কিংবা টিয়ারশেল মারার বিকল্প কী, কও!’

আজাদের এই আন্তরিক হয়ে তথ্য সরবরাহের ফলে লায়লার আতঙ্ক কিংবা উদ্বেগ দূর হয় কি না, বোঝা যায় না। সে কপাল ও চোখমুখ যথাসম্ভব কুঁচকে রেখে প্লেটের অবশিষ্ট নাস্তাটুকু শেষ করে দ্রুত টেবিল থেকে উঠে যেতে প্রয়াসী হয়।

এই যখন পরিস্থিতি, তখন আজাদদের দোতলার ভাড়াটিয়া ভদ্রলোকের বালক ছেলেটা হন্তদন্ত হয়ে আজাদদের নাস্তার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। ছেলেটা বেশ হাঁপাচ্ছে। লায়লা পানি পান করা ভুলে গিয়ে ফুসফুস তড়পানো বালকের দিকে কৌতূহল-ভরা চোখে চেয়ে থাকে। বালক ঠিকঠাক তার বয়ে আনা কথাটুকু বলে উঠতে পারে না। কেবল বলে, ‘ছাদে, সিয়াম, রক্ত’—এই তিন শব্দ উচ্চারণ করতে না করতেই বালক আবারও হাঁপাতে শুরু করে। তবে টেবিলে বসে থাকা লায়লা, কিংবা আজাদ, কিংবা তিন্নি, কিংবা ফারুক চৌধুরি যা বোঝার বুঝে ওঠেন এবং দ্রুতই ছাদের উদ্দেশে প্রায় একযোগে ছুটে যান।

ছাদে তখন এক অকল্পনীয় দৃশ্য রচিত হয়ে আছে। সিয়াম পড়ে আছে সাদের কার্নিশের গা ঘেঁষে। তার সারা শরীর যেন রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ছাদে উপস্থিত মানুষেরা তখন বিস্ময়ে কি পরিস্থিতির আকস্মিকতায় বিমূঢ় কিংবা স্তব্ধবাক হয়ে আছে! কারো মুখে কোনো কথা সরে না। কারো চোখের পলক পড়ে না। কারো নিঃশ্বাসের শব্দও বুঝি আঁচড় কাটে না বাতাসের গায়ে। বাতাসে তখন একটাই ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে—‘তুমি না কইলা রাবার বুলেট। রাবার বুলেটে নাকি রক্ত ঝরে না। মিথ্যা গুলিতে নাকি প্রাণ যায় না! তাইলে বলো, আমার সিয়ামের রক্ত কেন ঝরে যায়! আমার সিয়ামের প্রাণ কেন বেরিয়ে যায়! বলো, কথা কও, আমার সিয়াম কেন নিথর স্তব্ধ হইয়া পইড়া রইছে! কথা কও, কথা কও, কইতাছি।’

কিন্তু কেউ কথা বলে না। পৃথিবীতে তখন অদ্ভুত এক নীরবতা নেমে আসে। মাছের চোখের মতোন নীরবতা। দিঘির শান্ত জলের মতোন নীরবতা।

বিষয়:

হাসিখুশি
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত