বিদেশি বিনিয়োগ মানেই কি উন্নতি?

ইঞ্জিনিয়ার নিজাম উদ্দিন
প্রকাশ : ০২ মার্চ ২০২৫, ১১: ০২

বাংলাদেশ বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের জন্য এখন একটি আকর্ষণীয় বাজার। নির্মাণ, শিল্প, প্রযুক্তি ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে নানা খাতে বিদেশি কোম্পানির সংখ্যা বাড়ছে। সাধারণ ধারণা হলো, এসব কোম্পানির বিনিয়োগ আমাদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে, কর্মসংস্থান বাড়াবে ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান বিনিময়ের সুযোগ তৈরি করবে। কিন্তু বাস্তবতা কি সত্যিই এমন?

প্রশ্ন উঠছে, বিদেশি কোম্পানিগুলো বাংলাদেশ থেকে যে বিপুল পরিমাণ মুনাফা করছে, তার কতটা আমাদের অর্থনীতিতে থেকে যাচ্ছে? প্রকৃতপক্ষে এই কোম্পানিগুলো আমাদের বাজারকে একটি লাভজনক ক্ষেত্র হিসেবে দেখে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে দেশের অর্থনৈতিক ভিত মজবুত করতে তেমন আগ্রহী নয়।

বিজ্ঞাপন

তাদের বেশিরভাগ মুনাফাই সরাসরি বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কর সুবিধা ও নানা ফাঁকফোকর ব্যবহার করে তারা এখানে ব্যবসা পরিচালনা করলেও দেশের শিল্পোন্নয়নে বা স্থানীয় জনশক্তি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাদের বিনিয়োগ অত্যন্ত সীমিত।

বাংলাদেশের শ্রমবাজারের দুর্বলতাকে পুঁজি করে বিদেশি কোম্পানিগুলো কম মজুরিতে দক্ষ ও অদক্ষ কর্মী নিয়োগ করছে। একজন বিদেশি যেখানে পাঁচ হাজার ডলার বেতন পাচ্ছেন, সেখানে একই কাজের জন্য স্থানীয় কর্মীকে ৩০০-৪০০ ডলারে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এভাবে মুনাফার বিশাল অংশ তারা বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে, অথচ স্থানীয় কর্মীদের প্রকৃত উন্নতি বা দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ করছে না।

এখন প্রশ্ন হলো—এই চক্র থেকে উত্তরণের পথ কী?

প্রথমত, বিদেশি কোম্পানিগুলোকে বাধ্য করতে হবে তাদের লাভের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দেশে পুনর্বিনিয়োগ করতে। দ্বিতীয়ত, কর্মসংস্থান নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে, যাতে অন্তত ৮০ শতাংশ কর্মসংস্থান স্থানীয়দের জন্য সংরক্ষিত হয়। পাশাপাশি ন্যূনতম বেতন কাঠামো নির্ধারণ করতে হবে, যা আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।

এ ছাড়া স্থানীয় প্রকৌশলী ও ব্যবস্থাপকরা যাতে উচ্চ পদে সুযোগ পান, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে উচ্চ পদে বিদেশি কর্মীদের জন্য বরাদ্দ বিপুল বেতন দেশীয় অর্থনীতির বাইরে চলে যাচ্ছে। উন্নত দেশগুলোর মতো আমাদেরও নীতিগতভাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ শীর্ষস্থানীয় পদ দেশীয়দের জন্য সংরক্ষিত করা প্রয়োজন।

আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্থানীয় কর্মীদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করতে হবে। শীর্ষ পদে দেশীয়দের অগ্রাধিকার দিতে হবে। ৬০-৮০ শতাংশ উচ্চপদে দেশীয় প্রকৌশলী ও ব্যবস্থাপক নিয়োগ বাধ্যতামূলক করতে হবে।

বিদেশি কোম্পানিগুলোকে অন্তত ৩০-৪০ শতাংশ মুনাফা পুনর্বিনিয়োগে বাধ্য করা উচিত। বিদেশি কোম্পানিগুলোর অনিয়ন্ত্রিত মুনাফা বন্ধে ট্যাক্স মনিটরিং বাড়াতে হবে।

বিদেশি বিনিয়োগ আমাদের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তবে সেটি যেন দেশীয় স্বার্থের বিপরীতে না যায়। আমাদের অর্থনীতি এখন আর আগের জায়গায় নেই। এটি সস্তা শ্রমের দেশ নয়, বরং দক্ষ জনশক্তির এক সম্ভাবনাময় কেন্দ্র। বিদেশি কোম্পানিগুলোকে ‘Win-Win’ পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে, যাতে তারা যেমন লাভবান হয়, তেমনি বাংলাদেশও উপকৃত হয়। নতুবা আমরা কেবল বাজার হয়েই থাকব, আর আমাদের অর্থনীতি থেকে মূলধন ক্রমাগত বেরিয়ে যাবে।

এখনই সময় কঠোর নীতির, দায়িত্বশীল নেতৃত্বের এবং দেশের স্বার্থ রক্ষার।

লেখক : সিনিয়র ব্যবস্থাপক, সিএনসিইসি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত