কমডোর জসীম উদ্দীন ভূইয়াঁ (অব.)
রাখাইনের উত্তাল যুদ্ধের ঢেউ এবার সমুদ্রপথে ছড়িয়ে পড়তে পারে। রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের জন্য শুধু মানবিক বা কূটনৈতিক ইস্যু নয়, এটি এক ক্রমবর্ধমান সামরিক নিরাপত্তা হুমকিও। রাখাইন রাজ্য বর্তমানে বার্মিজ সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। আরাকান আর্মি এখনো সমুদ্রের দিকে কার্যক্রম চালায়নি, তবে মিয়ানমার নৌবাহিনীর দুর্বলতা ও নিয়ন্ত্রণহীনতা তাদের উৎসাহিত করতে পারে বঙ্গোপসাগরের দিকে প্রসারিত হতে—বিশেষত অর্থের উৎস খুঁজতে গেলে জলদস্যুতা বা চোরাচালান তাদের বিকল্প পথ হয়ে দাঁড়াতে পারে। অর্থাৎ সমুদ্র ও উপকূলের দিকে তাদের নজর পড়ার আশঙ্কা এখন সময়ের ব্যাপারমাত্র। রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয় বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর রুটিন যাতায়াত এখন আর গোপন খবর নয়। আর বাংলাদেশ? পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বঙ্গোপসাগর-সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় কী হবে, সেজন্য কোনো পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা কৌশল সম্ভবত নেই।
১৭শ শতকের বাংলার ইতিহাসে একজন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কৌশলী হিসেবে যিনি অমর হয়ে আছেন, তিনি হলেন মোগল সুবেদার শায়েস্তা খাঁ। চট্টগ্রাম ও তার আশপাশের উপকূলীয় এলাকায় মগ জলদস্যুদের হাতে যখন জনজীবন বিপর্যস্ত, তখন তিনি একটি সুপরিকল্পিত ও শক্তিশালী নৌ-অভিযানের মাধ্যমে এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করেন। আজ, শতাব্দী পেরিয়ে এসে, ইতিহাস যেন পুনরাবৃত্তি চায়। রাখাইনের অস্থিরতা, রোহিঙ্গা সংকট ও আরাকান আর্মির উত্থান—সব মিলিয়ে আবারও সেই উপকূলীয় নিরাপত্তা প্রশ্নে বাংলাদেশকে নতুন এক কৌশল নির্ধারণ করতে হচ্ছে এবং এই নির্ধারণে নৌবাহিনীর ভূমিকা হতে পারে এক কেন্দ্রীয় স্তম্ভ।
ইতিহাস কী বলে?
১৬২৫ সালে মগদের রাজা আরাকান রাজ শ্রী সুধর্ম মোগল রাজধানী ঢাকায় আক্রমণ করেন। তার কাছে পরাজিত হয়ে সুবাদার আমজাদ খান পালিয়ে যান। ঢাকায় অবস্থান করে মগেরা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে আরাকানে ফিরে যায়। ঢাকার মগবাজার নামটি মগদের আগ্রাসনের একটি জ্বলন্ত সাক্ষ্য! ইংরেজরা চলে যাওয়ার সময় আরাকান রাজ্য বা মগরাজ্যকে বার্মার সঙ্গে একীভূত করে দিয়ে যায়। ‘মগের মুল্লুক’ শব্দটা মগদের অভাবনীয় অত্যাচারের সাক্ষ্য হয়ে বাংলা ভাষায় আজও যেকোনো ভয়াবহ অরাজকতার নির্দেশক শব্দ হয়ে, বেঁচে আছে! প্রায় ২৫০ বছর বাংলায় মগদের অত্যাচার স্থায়ী হয়েছিল! ওই সময় মগ জলদস্যুরা সমুদ্রপথে এসে আমাদের উপকূল দখল করেছিল, যখন মোগল নৌবাহিনী তাদের প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত ছিল না।
মোগল নৌবাহিনীর চট্টগ্রাম পুনরুদ্ধার : ইতিহাস থেকে শিক্ষা
সমুদ্রপথে শক্তির প্রয়োগ ছাড়া উপকূল নিরাপদ রাখা অসম্ভব ছিল এবং এখনো তাই। ১৫৭৫ সালে সম্রাট আকবর চট্টগ্রাম বিজয়ের পরও আরাকানের জলদস্যুদের আক্রমণ কমেনি। এরা চট্টগ্রাম ও খুলনার উপকূলে নিয়মিত লুটপাট চালাত এবং বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকায় সশস্ত্র দখল কায়েম রাখত। এই জলদস্যুদের ‘মগ’ বলা হতো এবং তাদের নৌবাহিনী অত্যন্ত সংঘবদ্ধ ছিল। চট্টগ্রাম ছিল আরাকানিদের জন্য একটি কৌশলগত প্রবেশদ্বার, যা তারা বাংলার ভেতরে প্রবেশের জন্য ব্যবহার করত।
এই সংকট সমাধানে সম্রাট আওরঙ্গজেব ১৬৬৪ সালে বাংলার সুবাদার শায়েস্তা খাঁকে দায়িত্ব দেন। শায়েস্তা খাঁ অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে একটি শক্তিশালী নৌবহর গড়ে তোলেন, যেটি ছিল সমকালীন ভারতীয় উপমহাদেশে সবচেয়ে উন্নত নৌশক্তির একটি। এই নৌবাহিনীর পেছনে কাজ করেছিল বাংলার নদীমাতৃক ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য এবং স্থানীয়দের সমন্বয়ে গঠিত দক্ষ ‘নৌসেনা বাহিনী’।
শায়েস্তা খাঁর নেতৃত্বে বাংলার নৌবাহিনী কর্ণফুলী নদী দিয়ে আরাকানিদের প্রধান ঘাঁটিতে আঘাত হানে। নৌ-অভিযানে ব্যবহৃত হয় ‘গুরাব’, ‘গালিব’, ‘মাজরা’ ও ‘পালানৌকা’ নামক নৌযান, যেগুলোয় আগ্নেয়াস্ত্র বসানো ছিল। বাংলার কৌশল ছিল নদীপথ দখল করে শত্রুকে বিচ্ছিন্ন করা এবং পরবর্তী স্থলসেনা আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া। তার মূল লক্ষ্য ছিল আরাকান ও পর্তুগিজ দস্যুদের (‘মগ-ফিরিঙ্গি’ জোট) দমন করে উপকূলীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কর্ণফুলী নদীপথ দখল করে আরাকানিদের বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং সমন্বিত স্থল ও নৌ আক্রমণের মাধ্যমে শত্রুদের সম্পূর্ণভাবে বিতাড়িত করা হয়। ১৬৬৫-৬৬ সালে তিন ধাপে পরিচালিত অভিযানে তিনি চট্টগ্রাম পুনরুদ্ধার করেন।
ফলাফল : উপকূলীয় নিরাপত্তার একটি মডেল
এই অভিযানের ফলাফল ছিল চরম। আরাকানিদের পরাজিত করে চট্টগ্রামকে মোগল সাম্রাজ্যে সংযুক্ত করা হয় এবং বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলকে জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্ত করা হয়। সন্দ্বীপ থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত গড়ে ওঠে একটি সমন্বিত প্রতিরক্ষা বলয়। এ ছিল বাংলার সামরিক ইতিহাসে অন্যতম বড় একটি নৌজয়, যার গুরুত্ব আজও অনুধাবন করা হয় না। তবে দুঃখজনকভাবে মোগলরা আরাকান পর্যন্ত অগ্রসর হয়নি। ১৭৮৪ সালে বার্মিজ রাজা বোধাপায়া এই শূন্যতাকে কাজে লাগিয়ে আরাকান দখল করে নেন এবং মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা চালান। সেই গণহত্যার ফলেই রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের প্রথম ঢেউ শুরু হয় বাংলায়। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টা স্পষ্ট করে বলেছেন, বাংলাদেশকে নিজেদের সীমান্ত নিজেরাই রক্ষা করতে হবে। এই বাস্তবতায় নৌবাহিনীর ভূমিকা হয়ে উঠছে ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ। আজকের বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সামনে সেই একই কৌশল পুনঃপ্রয়োগের সুযোগ এসেছে, তবে আধুনিক বাস্তবতা ও প্রযুক্তি অনুযায়ী।
নতুন কৌশল : ছোট বোট, বড় প্রভাব; নৌ ও কোস্ট গার্ডের সমন্বয়ে উপকূল রক্ষা
যেমনটি মোগল নৌবাহিনী করেছিল, আজও উপকূলীয় জলসীমা রক্ষা করার জন্য ছোট ও দ্রুতগামী বোট সবচেয়ে উপযোগী। বাংলাদেশের নৌবাহিনী বড় যুদ্ধজাহাজ নয়, বরং ছোট ও দ্রুতগামী বোটই এই মুহূর্তে উপকূলীয় সুরক্ষার জন্য সবচেয়ে উপযোগী। এগুলোর ব্যবহার দ্বিগুণ করা যেতে পারে কক্সবাজার উপকূল, সেন্ট মার্টিন ও নাফ নদীর প্রবেশমুখে। তবে বড় আকারের জাহাজ দিয়ে সব এলাকা কাভার করা সম্ভব নয়। সীমান্তঘেঁষা নদী ও উপকূলীয় অঞ্চলের অনেক জায়গাই অগভীর, সংকীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজন প্রচুর ছোট, দ্রুতগামী ও সহজে মোতায়েনযোগ্য নৌযান, যেগুলো নদীর মোহনা বা মাছ ধরার ট্রলারের ছদ্মবেশে অস্ত্র পরিবহন চিহ্নিত করতে পারবে। এই অপারেশন সফল করতে হলে কোস্ট গার্ড ও নৌবাহিনীর মধ্যে সমন্বয় অপরিহার্য। একটি যৌথ গোয়েন্দা ইউনিট গঠন করে সীমান্তঘেঁষা জলসীমায় নজরদারি বাড়ানো যেতে পারে। প্রতিটি সন্দেহভাজন গতিবিধি সম্পর্কে দ্রুত তথ্য আদান-প্রদান এবং মোতায়েন প্রক্রিয়া সম্ভব হবে কেবল তখনই, যখন পর্যাপ্তসংখ্যক ছোট বোট ও প্রশিক্ষিত ক্রু হাতের কাছে থাকবে। সরকার চাইলে ১০ লাখ আনসার ও ভিডিপির মধ্য থেকে উপকূলীয় এলাকার জন্য একটি রিজার্ভ প্রতিরক্ষা ইউনিট গঠন করতে পারে, যাদের নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ডের নির্দেশনায় মোতায়েন করা যাবে। এতে খরচ কমবে, কিন্তু নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
সম্ভাব্য সহায়তা : যুক্তরাষ্ট্র থেকে নৌযান অনুদান
বাংলাদেশের এই প্রেক্ষাপটে একটি বাস্তবসম্মত কূটনৈতিক পদক্ষেপ হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ব্যবহৃত ছোট প্যাট্রোল বোট ও উপকূলীয় তৎপরতার উপযোগী নৌযান সংগ্রহ। যুক্তরাষ্ট্র এক্সেস ডিফেন্স আর্টিকল্স (EDA) প্রোগ্রামের অধীনে মিত্র দেশগুলোকে এ ধরনের জলযান অনুদান বা নামমাত্র দামে দিয়ে থাকে। রোহিঙ্গা সংকট, মানব পাচার ও চীন-ভারত দ্বন্দ্ব ঘিরে বঙ্গোপসাগরের ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়ছে। এখন সময় এসেছে সেই গুরুত্বকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ব শক্তিদের কাছ থেকে কার্যকর প্রতিরক্ষা সহায়তা আদায় করার।
আঞ্চলিক ভূরাজনীতি : সক্রিয় আত্মরক্ষা, আগ্রাসী নয়
রাখাইন ও বঙ্গোপসাগর আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির একটি উত্তপ্ত ক্ষেত্র। যুক্তরাষ্ট্র এখানে একটি খ্রিষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল গঠনের চিন্তায় চীন-বাংলাদেশ করিডোরের নিরাপত্তা এবং আরাকানে তার কিউকফিউ বন্দর ও ইউনান প্রদেশ সংযোগ রক্ষায় এই অঞ্চলকে স্থিতিশীল দেখতে চায়। আর ভারত চায় উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখতে রাখাইনকে বাফার হিসেবে ব্যবহার করতে এবং রাখাইনে মুসলিম প্রভাব যাতে না বাড়ে সেটি নিশ্চিত করতে। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশ যদি আগ্রাসী হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়বে। এই ভূরাজনীতির মাঝে বাংলাদেশের জন্য সঠিক অবস্থান হতে পারে ‘ডিফেন্সিভ অ্যাকটিভিজম’, অর্থাৎ নিজ সীমান্তে দৃঢ় অবস্থান; আক্রমণ নয়, তবে সার্বক্ষণিক প্রস্তুতি।
সাগরে নজর না দিলে উপকূল জ্বলবে
শায়েস্তা খাঁর চট্টগ্রাম পুনর্দখল ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত—এটি সামরিক অভিযান নয়, ছিল এক রণনীতি, যেখানে কৌশল, তথ্য ও সময়জ্ঞান ছিল মূল অস্ত্র। আজ বাংলাদেশের সামনে এক নতুন চ্যালেঞ্জ, কিন্তু উত্তর হতে পারে ইতিহাসের প্রতিধ্বনি। নৌবাহিনীর আধুনিক রূপ ও উপকূলীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার সমন্বয় এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু রোহিঙ্গা সংকট নয়, বরং সার্বিকভাবে দেশের উপকূলীয় সীমান্ত, ভূরাজনৈতিক অবস্থান ও অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা রক্ষায় এক অপরিহার্য উপাদান।
আর তাই মোগল নৌ-কৌশল থেকে শুরু করে আধুনিক সমুদ্র নিরাপত্তা—সবই আমাদের প্রয়োজন আজকের একটি নতুন, আত্মরক্ষামূলক ও কৌশলনির্ভর নৌ-কৌশল গঠনে। অতএব, এখনই সময় কোস্ট গার্ড ও নৌবাহিনীকেই কৌশলগত কেন্দ্রবিন্দুতে আনার। ইতিহাস আমাদের এই বার্তাই দেয়—যেদেশ জলপথ পাহারা দিতে পারে না, তার ভেতরে আগুন ঢুকে পড়ে নৌকার পথেই। আজ তাই প্রশ্ন নয়, সময় হয়েছে প্রস্তুতির; কারণ নৌপথে যখন আগুন জ্বলে, তখন ভূমির নিরাপত্তাও পুড়ে যায়।
লেখক : সাবেক সহকারী নৌবাহিনী প্রধান ও উপ-উপাচার্য, বিইউপি
রাখাইনের উত্তাল যুদ্ধের ঢেউ এবার সমুদ্রপথে ছড়িয়ে পড়তে পারে। রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের জন্য শুধু মানবিক বা কূটনৈতিক ইস্যু নয়, এটি এক ক্রমবর্ধমান সামরিক নিরাপত্তা হুমকিও। রাখাইন রাজ্য বর্তমানে বার্মিজ সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। আরাকান আর্মি এখনো সমুদ্রের দিকে কার্যক্রম চালায়নি, তবে মিয়ানমার নৌবাহিনীর দুর্বলতা ও নিয়ন্ত্রণহীনতা তাদের উৎসাহিত করতে পারে বঙ্গোপসাগরের দিকে প্রসারিত হতে—বিশেষত অর্থের উৎস খুঁজতে গেলে জলদস্যুতা বা চোরাচালান তাদের বিকল্প পথ হয়ে দাঁড়াতে পারে। অর্থাৎ সমুদ্র ও উপকূলের দিকে তাদের নজর পড়ার আশঙ্কা এখন সময়ের ব্যাপারমাত্র। রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয় বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর রুটিন যাতায়াত এখন আর গোপন খবর নয়। আর বাংলাদেশ? পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বঙ্গোপসাগর-সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় কী হবে, সেজন্য কোনো পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা কৌশল সম্ভবত নেই।
১৭শ শতকের বাংলার ইতিহাসে একজন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কৌশলী হিসেবে যিনি অমর হয়ে আছেন, তিনি হলেন মোগল সুবেদার শায়েস্তা খাঁ। চট্টগ্রাম ও তার আশপাশের উপকূলীয় এলাকায় মগ জলদস্যুদের হাতে যখন জনজীবন বিপর্যস্ত, তখন তিনি একটি সুপরিকল্পিত ও শক্তিশালী নৌ-অভিযানের মাধ্যমে এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করেন। আজ, শতাব্দী পেরিয়ে এসে, ইতিহাস যেন পুনরাবৃত্তি চায়। রাখাইনের অস্থিরতা, রোহিঙ্গা সংকট ও আরাকান আর্মির উত্থান—সব মিলিয়ে আবারও সেই উপকূলীয় নিরাপত্তা প্রশ্নে বাংলাদেশকে নতুন এক কৌশল নির্ধারণ করতে হচ্ছে এবং এই নির্ধারণে নৌবাহিনীর ভূমিকা হতে পারে এক কেন্দ্রীয় স্তম্ভ।
ইতিহাস কী বলে?
১৬২৫ সালে মগদের রাজা আরাকান রাজ শ্রী সুধর্ম মোগল রাজধানী ঢাকায় আক্রমণ করেন। তার কাছে পরাজিত হয়ে সুবাদার আমজাদ খান পালিয়ে যান। ঢাকায় অবস্থান করে মগেরা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে আরাকানে ফিরে যায়। ঢাকার মগবাজার নামটি মগদের আগ্রাসনের একটি জ্বলন্ত সাক্ষ্য! ইংরেজরা চলে যাওয়ার সময় আরাকান রাজ্য বা মগরাজ্যকে বার্মার সঙ্গে একীভূত করে দিয়ে যায়। ‘মগের মুল্লুক’ শব্দটা মগদের অভাবনীয় অত্যাচারের সাক্ষ্য হয়ে বাংলা ভাষায় আজও যেকোনো ভয়াবহ অরাজকতার নির্দেশক শব্দ হয়ে, বেঁচে আছে! প্রায় ২৫০ বছর বাংলায় মগদের অত্যাচার স্থায়ী হয়েছিল! ওই সময় মগ জলদস্যুরা সমুদ্রপথে এসে আমাদের উপকূল দখল করেছিল, যখন মোগল নৌবাহিনী তাদের প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত ছিল না।
মোগল নৌবাহিনীর চট্টগ্রাম পুনরুদ্ধার : ইতিহাস থেকে শিক্ষা
সমুদ্রপথে শক্তির প্রয়োগ ছাড়া উপকূল নিরাপদ রাখা অসম্ভব ছিল এবং এখনো তাই। ১৫৭৫ সালে সম্রাট আকবর চট্টগ্রাম বিজয়ের পরও আরাকানের জলদস্যুদের আক্রমণ কমেনি। এরা চট্টগ্রাম ও খুলনার উপকূলে নিয়মিত লুটপাট চালাত এবং বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকায় সশস্ত্র দখল কায়েম রাখত। এই জলদস্যুদের ‘মগ’ বলা হতো এবং তাদের নৌবাহিনী অত্যন্ত সংঘবদ্ধ ছিল। চট্টগ্রাম ছিল আরাকানিদের জন্য একটি কৌশলগত প্রবেশদ্বার, যা তারা বাংলার ভেতরে প্রবেশের জন্য ব্যবহার করত।
এই সংকট সমাধানে সম্রাট আওরঙ্গজেব ১৬৬৪ সালে বাংলার সুবাদার শায়েস্তা খাঁকে দায়িত্ব দেন। শায়েস্তা খাঁ অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে একটি শক্তিশালী নৌবহর গড়ে তোলেন, যেটি ছিল সমকালীন ভারতীয় উপমহাদেশে সবচেয়ে উন্নত নৌশক্তির একটি। এই নৌবাহিনীর পেছনে কাজ করেছিল বাংলার নদীমাতৃক ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য এবং স্থানীয়দের সমন্বয়ে গঠিত দক্ষ ‘নৌসেনা বাহিনী’।
শায়েস্তা খাঁর নেতৃত্বে বাংলার নৌবাহিনী কর্ণফুলী নদী দিয়ে আরাকানিদের প্রধান ঘাঁটিতে আঘাত হানে। নৌ-অভিযানে ব্যবহৃত হয় ‘গুরাব’, ‘গালিব’, ‘মাজরা’ ও ‘পালানৌকা’ নামক নৌযান, যেগুলোয় আগ্নেয়াস্ত্র বসানো ছিল। বাংলার কৌশল ছিল নদীপথ দখল করে শত্রুকে বিচ্ছিন্ন করা এবং পরবর্তী স্থলসেনা আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া। তার মূল লক্ষ্য ছিল আরাকান ও পর্তুগিজ দস্যুদের (‘মগ-ফিরিঙ্গি’ জোট) দমন করে উপকূলীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কর্ণফুলী নদীপথ দখল করে আরাকানিদের বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং সমন্বিত স্থল ও নৌ আক্রমণের মাধ্যমে শত্রুদের সম্পূর্ণভাবে বিতাড়িত করা হয়। ১৬৬৫-৬৬ সালে তিন ধাপে পরিচালিত অভিযানে তিনি চট্টগ্রাম পুনরুদ্ধার করেন।
ফলাফল : উপকূলীয় নিরাপত্তার একটি মডেল
এই অভিযানের ফলাফল ছিল চরম। আরাকানিদের পরাজিত করে চট্টগ্রামকে মোগল সাম্রাজ্যে সংযুক্ত করা হয় এবং বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলকে জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্ত করা হয়। সন্দ্বীপ থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত গড়ে ওঠে একটি সমন্বিত প্রতিরক্ষা বলয়। এ ছিল বাংলার সামরিক ইতিহাসে অন্যতম বড় একটি নৌজয়, যার গুরুত্ব আজও অনুধাবন করা হয় না। তবে দুঃখজনকভাবে মোগলরা আরাকান পর্যন্ত অগ্রসর হয়নি। ১৭৮৪ সালে বার্মিজ রাজা বোধাপায়া এই শূন্যতাকে কাজে লাগিয়ে আরাকান দখল করে নেন এবং মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা চালান। সেই গণহত্যার ফলেই রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের প্রথম ঢেউ শুরু হয় বাংলায়। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টা স্পষ্ট করে বলেছেন, বাংলাদেশকে নিজেদের সীমান্ত নিজেরাই রক্ষা করতে হবে। এই বাস্তবতায় নৌবাহিনীর ভূমিকা হয়ে উঠছে ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ। আজকের বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সামনে সেই একই কৌশল পুনঃপ্রয়োগের সুযোগ এসেছে, তবে আধুনিক বাস্তবতা ও প্রযুক্তি অনুযায়ী।
নতুন কৌশল : ছোট বোট, বড় প্রভাব; নৌ ও কোস্ট গার্ডের সমন্বয়ে উপকূল রক্ষা
যেমনটি মোগল নৌবাহিনী করেছিল, আজও উপকূলীয় জলসীমা রক্ষা করার জন্য ছোট ও দ্রুতগামী বোট সবচেয়ে উপযোগী। বাংলাদেশের নৌবাহিনী বড় যুদ্ধজাহাজ নয়, বরং ছোট ও দ্রুতগামী বোটই এই মুহূর্তে উপকূলীয় সুরক্ষার জন্য সবচেয়ে উপযোগী। এগুলোর ব্যবহার দ্বিগুণ করা যেতে পারে কক্সবাজার উপকূল, সেন্ট মার্টিন ও নাফ নদীর প্রবেশমুখে। তবে বড় আকারের জাহাজ দিয়ে সব এলাকা কাভার করা সম্ভব নয়। সীমান্তঘেঁষা নদী ও উপকূলীয় অঞ্চলের অনেক জায়গাই অগভীর, সংকীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজন প্রচুর ছোট, দ্রুতগামী ও সহজে মোতায়েনযোগ্য নৌযান, যেগুলো নদীর মোহনা বা মাছ ধরার ট্রলারের ছদ্মবেশে অস্ত্র পরিবহন চিহ্নিত করতে পারবে। এই অপারেশন সফল করতে হলে কোস্ট গার্ড ও নৌবাহিনীর মধ্যে সমন্বয় অপরিহার্য। একটি যৌথ গোয়েন্দা ইউনিট গঠন করে সীমান্তঘেঁষা জলসীমায় নজরদারি বাড়ানো যেতে পারে। প্রতিটি সন্দেহভাজন গতিবিধি সম্পর্কে দ্রুত তথ্য আদান-প্রদান এবং মোতায়েন প্রক্রিয়া সম্ভব হবে কেবল তখনই, যখন পর্যাপ্তসংখ্যক ছোট বোট ও প্রশিক্ষিত ক্রু হাতের কাছে থাকবে। সরকার চাইলে ১০ লাখ আনসার ও ভিডিপির মধ্য থেকে উপকূলীয় এলাকার জন্য একটি রিজার্ভ প্রতিরক্ষা ইউনিট গঠন করতে পারে, যাদের নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ডের নির্দেশনায় মোতায়েন করা যাবে। এতে খরচ কমবে, কিন্তু নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
সম্ভাব্য সহায়তা : যুক্তরাষ্ট্র থেকে নৌযান অনুদান
বাংলাদেশের এই প্রেক্ষাপটে একটি বাস্তবসম্মত কূটনৈতিক পদক্ষেপ হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ব্যবহৃত ছোট প্যাট্রোল বোট ও উপকূলীয় তৎপরতার উপযোগী নৌযান সংগ্রহ। যুক্তরাষ্ট্র এক্সেস ডিফেন্স আর্টিকল্স (EDA) প্রোগ্রামের অধীনে মিত্র দেশগুলোকে এ ধরনের জলযান অনুদান বা নামমাত্র দামে দিয়ে থাকে। রোহিঙ্গা সংকট, মানব পাচার ও চীন-ভারত দ্বন্দ্ব ঘিরে বঙ্গোপসাগরের ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়ছে। এখন সময় এসেছে সেই গুরুত্বকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ব শক্তিদের কাছ থেকে কার্যকর প্রতিরক্ষা সহায়তা আদায় করার।
আঞ্চলিক ভূরাজনীতি : সক্রিয় আত্মরক্ষা, আগ্রাসী নয়
রাখাইন ও বঙ্গোপসাগর আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির একটি উত্তপ্ত ক্ষেত্র। যুক্তরাষ্ট্র এখানে একটি খ্রিষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল গঠনের চিন্তায় চীন-বাংলাদেশ করিডোরের নিরাপত্তা এবং আরাকানে তার কিউকফিউ বন্দর ও ইউনান প্রদেশ সংযোগ রক্ষায় এই অঞ্চলকে স্থিতিশীল দেখতে চায়। আর ভারত চায় উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখতে রাখাইনকে বাফার হিসেবে ব্যবহার করতে এবং রাখাইনে মুসলিম প্রভাব যাতে না বাড়ে সেটি নিশ্চিত করতে। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশ যদি আগ্রাসী হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়বে। এই ভূরাজনীতির মাঝে বাংলাদেশের জন্য সঠিক অবস্থান হতে পারে ‘ডিফেন্সিভ অ্যাকটিভিজম’, অর্থাৎ নিজ সীমান্তে দৃঢ় অবস্থান; আক্রমণ নয়, তবে সার্বক্ষণিক প্রস্তুতি।
সাগরে নজর না দিলে উপকূল জ্বলবে
শায়েস্তা খাঁর চট্টগ্রাম পুনর্দখল ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত—এটি সামরিক অভিযান নয়, ছিল এক রণনীতি, যেখানে কৌশল, তথ্য ও সময়জ্ঞান ছিল মূল অস্ত্র। আজ বাংলাদেশের সামনে এক নতুন চ্যালেঞ্জ, কিন্তু উত্তর হতে পারে ইতিহাসের প্রতিধ্বনি। নৌবাহিনীর আধুনিক রূপ ও উপকূলীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার সমন্বয় এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু রোহিঙ্গা সংকট নয়, বরং সার্বিকভাবে দেশের উপকূলীয় সীমান্ত, ভূরাজনৈতিক অবস্থান ও অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা রক্ষায় এক অপরিহার্য উপাদান।
আর তাই মোগল নৌ-কৌশল থেকে শুরু করে আধুনিক সমুদ্র নিরাপত্তা—সবই আমাদের প্রয়োজন আজকের একটি নতুন, আত্মরক্ষামূলক ও কৌশলনির্ভর নৌ-কৌশল গঠনে। অতএব, এখনই সময় কোস্ট গার্ড ও নৌবাহিনীকেই কৌশলগত কেন্দ্রবিন্দুতে আনার। ইতিহাস আমাদের এই বার্তাই দেয়—যেদেশ জলপথ পাহারা দিতে পারে না, তার ভেতরে আগুন ঢুকে পড়ে নৌকার পথেই। আজ তাই প্রশ্ন নয়, সময় হয়েছে প্রস্তুতির; কারণ নৌপথে যখন আগুন জ্বলে, তখন ভূমির নিরাপত্তাও পুড়ে যায়।
লেখক : সাবেক সহকারী নৌবাহিনী প্রধান ও উপ-উপাচার্য, বিইউপি
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
১৬ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
১৬ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
১৭ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
২ দিন আগে