
এলাহী নেওয়াজ খান

একটা রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার কতটা নিশ্চিত হয়েছে, তার ওপর নির্ভর করে দেশটির সুখ ও সমৃদ্ধি। ন্যায়বিচার ছাড়া কোনো রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না, সেটি যত বড় ও শক্তিশালী রাষ্ট্র হোক না কেন। শুধু সময়ের ব্যাপার। অতীতে অন্যায় শাসন ও ন্যায়বিচারহীনতার কারণে কত জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে, তার ইয়াত্তা নেই। গত ২৫ ডিসেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমদ সে কথাই স্মরণ করিয়ে দিলেন দেশবাসীকে।
কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তন আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি বলেন, আইন শুধু নিয়মের সমষ্টি নয়, এটি জাতির নৈতিক বিবেকের প্রতিফলন। ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হলে রাষ্ট্র দৃঢ় হয় আর ন্যায় ব্যর্থ হলে সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রও ভেঙে পড়ে। ফ্যাসিবাদী শাসন-উত্তর বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রধান বিচারপতির ওই কথাগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
কারণ এদেশের মানুষ দেখেছে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনকালে ন্যায়বিচারের অভাবের ফলে কীভাবে বিবেকবর্জিত মানবতাবিরোধী অপরাধ সব সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল মানবাধিকারের সব বাণী, যা কার্যত একটি স্বাধীন রাষ্ট্রকে খাদের কিনারায় দাঁড় করে দিয়েছিল। জুলাই বিপ্লব খাদের কিনারায় প্রায় হেলে পড়া রাষ্ট্রকে দাঁড় করিয়ে ন্যায়বিচারভিত্তিক একটি মানবিক রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষা জনমনে জাগ্রত করেছে। আর সে আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করছে দেশটির ভবিষ্যৎ সাফল্য। প্রধান বিচারপতি সেটাই বলার চেষ্টা করেছেন।
মানব ইতিহাসজুড়েই দেখা যাচ্ছে, অন্যায় শাসন ও অবিচার বহু বড় বড় দেশকে খণ্ড-বিখণ্ড করে দিয়েছে। বিদ্রোহের আগুন জ্বলে আসছে বিভিন্ন দেশে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। অনেক দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধেই শুরু হয়েছে অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মাধ্যমে, বাংলাদেশ যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ন্যায়ভিত্তিক শাসন ও বিচারের অভাব থেকে এদেশের মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠেছিল। তাই মানুষ ১৯৭১ সালে বিদ্রোহ করে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে।
কোরআনুল কারিমে এ রকম অন্যায় ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ শাসনের ফলে ধ্বংস হয়ে যাওয়া বহু জাতির কাহিনি বিধৃত আছে। মোদ্দা কথা, অতীতের সব সভ্যতাই ধ্বংস হয়েছে ন্যায়বিচারের অভাবে, যা অন্যায় শাসন ও একগুঁয়েমিপনা দ্বারা পরিচালিত হয়েছে।
বাংলাদেশেও ন্যায়বিচারহীনতা চলছে স্বাধীনতার পর থেকে বিগত ৫৪ বছর ধরে। বিশেষ করে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের নিবর্তনমূলক শাসনামলে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে যারা ভিন্নমত পোষণ করতেন তাদের পক্ষে ন্যায়বিচার পাওয়া রীতিমতো অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। বিচারকদের ওপর সরকারের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত থাকায় গুম ও খুনের শিকার মানুষ কোনো বিচার পায়নি। পাকিস্তান আমলে আমরা দেখেছি, উচ্চ আদালত তো দূরের কথা, নিম্ন আদালতের বিচারকরা কখনো পাবলিক ফাংশনে অংশ নিতেন না। এমনকি বিয়ের অনুষ্ঠানেও যেতেন না। কিন্তু আওয়ামী লীগের আমলে দেখেছি, রাজনৈতিক নেতারা হরহামেশা বিচারকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন এবং গর্বের সঙ্গে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতে দ্বিধাবোধ করতেন না।

এদিকে বাংলাদেশের মতো মুসলিম দেশের মুসলিম বিচারকদের মূলত দায়বদ্ধতা থাকার কথা ছিল সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালার কাছে, কোনো নেতানেত্রীর কাছে নয়। কিন্তু তা হয়নি। অথচ শেষ বিচারের দিনে বিচারকরা কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হবেন। কারণ আল্লাহতায়ালা কোরআনুল কারিমে বারবার ন্যায়বিচারের তাগিদ দিয়েছেন। যেমন—আল্লাহ বলেছেন, ‘হে ঈমানদাররা তোমরা ন্যায়ের ওপর অবিচল থাকো আল্লাহর জন্য সাক্ষীস্বরূপ, যদিও তা তোমাদের নিজেদের অথবা বাবা-মা এবং আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে হয়। সে বিত্তবান হোক বা বিত্তহীন হোক আল্লাহ উভয়েরই ঘনিষ্ঠতর। সুতরাং ন্যায়বিচার করতে খেয়ালখুশির অনুগত হয়ো না। (সুরা নিসা, আয়াত : ১৩৫)
আবার সুরা হুজরাওয়ের ১৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা দুটো দলের মধ্যে ন্যায় ও ইনসাফের সঙ্গে ফয়সালা করে দেবে এবং তোমরা ন্যায়বিচার করবে। নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়বিচারকদের ভালোবাসেন।’
পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা আরো বলেন, ‘অবশ্যই আমি আমার রাসালদের পাঠিয়েছি স্পষ্ট প্রমাণসহ এবং আমি তাদের সঙ্গে পাঠিয়েছি কিতাব ও ওজন (ন্যায়দণ্ড), যেন মানুষ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। (সুরা হদিদ, আয়াত : ২৫)
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আরো অনেক আয়াতে রয়েছে। শুধু তাই নয়, এ ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা কঠোরভাবে বলেছেন, ‘যারা আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান অনুযায়ী বিচার করে না তারা কাফের। (সুরা মায়িদা, আয়াত : ৪৪)
এছাড়া বহু হাদিসে এ ব্যাপারে উল্লেখ রয়েছে। যেমন : রাসুল পাক (সা.) বলেছেন, তোমাদের কেউ যখন নেতৃত্বের বোঝা বহন করে, তখন সে যেন ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে। তবে স্বয়ং রাসুল (সা.)-এর একটি ন্যায়বিচারের ঘটনা মুসলিম বিশ্বে ব্যাপকভাবে প্রচারিত। এটা ছিল বিখ্যাত মাখজম গোত্রের এক সম্ভ্রান্ত মহিলা চোরের বিচারের ঘটনা। এ ব্যাপারে কোরাইশের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। কারণ মহিলাদের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের। কিন্তু এ ব্যাপারে রাসুল পাক (সা.)-কে কোনো সুপারিশ করার সাহস ছিল না কারো। তাই তারা রাসুল (সা.)-এর অতিপ্রিয় ওসামা বিন জায়েদ (রা.)-কে সুপারিশ করার জন্য পাঠান।
হজরত ওসামা বিন জায়েদ (রা.) বিষয়টি রাসুল (সা.) অবহিত করেন। তখন নবী (সা.) ওসামা (রা.)-কে বললেন, তুমি কি আল্লাহর সীমালঙ্ঘনকারীর সাজা মওকুফের সুপারিশ করছো? অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে খুতবায় বললেন, তোমাদের আগের জাতি এ কাজ করে ধ্বংস হয়েছে, যখন তাদের মধ্যে কোনো বিশিষ্ট অভিজাত লোক চুরি করত, তখন তাদের বিনা সাজায় ছেড়ে দেওয়া হতো। অন্যদিকে যখন অসহায় গরিব কোনো লোক চুরি করত, তখন তাদের দণ্ডবিধি অনুযায়ী সাজা দেওয়া হতো। আল্লাহর কসম, মোহাম্মদ (সা.)-এর মেয়ে ফাতিমাও যদি চুরি করত, তাহলে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী তার হাত কাটার অনুমতি দিতাম।
এখানে কোরআন ও হাদিসের মূল কথা হচ্ছে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। আমাদের সামনে এমন অনেক দেশের উদাহরণ আছে, সেসব দেশের মানুষ অমুসলিম হয়েও আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। যেমন : আমেরিকা বা ইউরোপের মতো দেশগুলো টিকে আছে সুশাসন ও ন্যায়বিচারের ওপরের ওপর ভিত্তি করে। অথচ একদা অনেক মুসলিম শাসক ও বিচারক সুশাসন এবং ন্যায়বিচারের জন্য ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। আজ মুসলিম দেশগুলো সুশাসন ও ন্যায়বিচার থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। আমরা যদি আমেরিকা ও ব্রিটেনের কথা বলি, এরা বিদেশের মাটিতে যাই করে থাকুক না কেন, অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে তাদের রয়েছে সুশাসন ও ন্যায়বিচারে দীর্ঘ ইতিহাস।
লৌহমানবীখ্যাত মার্গারেট থ্যাচার যখন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী, তখন তার ছেলে ট্রাফিক আইনলঙ্ঘন করার দায়ে জরিমানার শিকার হয়েছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সন্তান বলে রক্ষা পাননি। কারণ ইংল্যান্ডে কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়, প্রধানমন্ত্রী, লর্ড, ব্যারন কিংবা সাধারণ মানুষ যেই হন না কেন। এই তো অতিসম্প্রতি ব্রিটেনের পাশের দেশ ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজির পাঁচ বছরের জেল হয়েছে দুর্নীতির অভিযোগে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, তিনি বেআইনিভাবে নির্বাচনি তহবিল সংগ্রহ করেছিলেন। যে অভিযোগে তার বিরুদ্ধে পাঁচ বছরের সাজা হয়েছে, তা আমলে নিলে বাংলাদেশের কম রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা সাজা থেকে রক্ষা পাবেন।
অন্যদিকে আমেরিকার কথাই ধরুন, এই দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ হিসেবে টিকে আছে সুশাসন ও ন্যায়বিচারের ওপর নির্ভর করে। এই দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, আইনের শাসন, সাংবিধানিক অধিকার এবং একটি স্বাধীন বিচার বিভাগের মাধ্যমে। এখানে সংবিধান ও আইনের মাধ্যমে নাগরিকের অধিকার সংরক্ষিত হয়, যা বিচার বিভাগকে নির্দেশ করে এবং প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ থেকে রক্ষা করে।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে সব নাগরিকের জন্য আইনি সহায়তা নিশ্চিত করা হয়েছে, যাতে তারা তাদের আর্থিক অবস্থা বা ব্যক্তিগত পরিস্থিতি নির্বিশেষে আইনি সুরক্ষা চাইতে পারে। ঠিক এভাবেই বহু দেশে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হয়েছে।
এই পটভূমিতে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রিফাত আহমেদের ভাষণটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তিনি বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের ন্যায়বিচারহীনতার কথা ভেবে বিচার বিভাগের সংস্কারের কথাও তার বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে প্রশাসনিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ, নৈতিকভাবে সাহসী ও সংবিধানিকভাবে শক্তিশালী বিচার বিভাগ বিনির্মাণ করতে হবে।’
কিন্তু প্রধান বিচারপতি আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী ওই ধরনের একটি বিচার বিভাগ নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই আগামীতে আইনপ্রণেতাদের এটি নিশ্চিত করতে হবে, প্রশাসন কোনো অবস্থাতেই যেন আর বিচার বিভাগে হস্তক্ষেপ করতে না পারে। আর তখনই শুধু একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ কার্যকর হয়ে উঠবে। তা না হলে বিচারের বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কেঁদেই চলবে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

একটা রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার কতটা নিশ্চিত হয়েছে, তার ওপর নির্ভর করে দেশটির সুখ ও সমৃদ্ধি। ন্যায়বিচার ছাড়া কোনো রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না, সেটি যত বড় ও শক্তিশালী রাষ্ট্র হোক না কেন। শুধু সময়ের ব্যাপার। অতীতে অন্যায় শাসন ও ন্যায়বিচারহীনতার কারণে কত জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে, তার ইয়াত্তা নেই। গত ২৫ ডিসেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমদ সে কথাই স্মরণ করিয়ে দিলেন দেশবাসীকে।
কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তন আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি বলেন, আইন শুধু নিয়মের সমষ্টি নয়, এটি জাতির নৈতিক বিবেকের প্রতিফলন। ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হলে রাষ্ট্র দৃঢ় হয় আর ন্যায় ব্যর্থ হলে সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রও ভেঙে পড়ে। ফ্যাসিবাদী শাসন-উত্তর বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রধান বিচারপতির ওই কথাগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
কারণ এদেশের মানুষ দেখেছে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনকালে ন্যায়বিচারের অভাবের ফলে কীভাবে বিবেকবর্জিত মানবতাবিরোধী অপরাধ সব সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল মানবাধিকারের সব বাণী, যা কার্যত একটি স্বাধীন রাষ্ট্রকে খাদের কিনারায় দাঁড় করে দিয়েছিল। জুলাই বিপ্লব খাদের কিনারায় প্রায় হেলে পড়া রাষ্ট্রকে দাঁড় করিয়ে ন্যায়বিচারভিত্তিক একটি মানবিক রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষা জনমনে জাগ্রত করেছে। আর সে আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করছে দেশটির ভবিষ্যৎ সাফল্য। প্রধান বিচারপতি সেটাই বলার চেষ্টা করেছেন।
মানব ইতিহাসজুড়েই দেখা যাচ্ছে, অন্যায় শাসন ও অবিচার বহু বড় বড় দেশকে খণ্ড-বিখণ্ড করে দিয়েছে। বিদ্রোহের আগুন জ্বলে আসছে বিভিন্ন দেশে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। অনেক দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধেই শুরু হয়েছে অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মাধ্যমে, বাংলাদেশ যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ন্যায়ভিত্তিক শাসন ও বিচারের অভাব থেকে এদেশের মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠেছিল। তাই মানুষ ১৯৭১ সালে বিদ্রোহ করে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে।
কোরআনুল কারিমে এ রকম অন্যায় ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ শাসনের ফলে ধ্বংস হয়ে যাওয়া বহু জাতির কাহিনি বিধৃত আছে। মোদ্দা কথা, অতীতের সব সভ্যতাই ধ্বংস হয়েছে ন্যায়বিচারের অভাবে, যা অন্যায় শাসন ও একগুঁয়েমিপনা দ্বারা পরিচালিত হয়েছে।
বাংলাদেশেও ন্যায়বিচারহীনতা চলছে স্বাধীনতার পর থেকে বিগত ৫৪ বছর ধরে। বিশেষ করে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের নিবর্তনমূলক শাসনামলে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে যারা ভিন্নমত পোষণ করতেন তাদের পক্ষে ন্যায়বিচার পাওয়া রীতিমতো অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। বিচারকদের ওপর সরকারের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত থাকায় গুম ও খুনের শিকার মানুষ কোনো বিচার পায়নি। পাকিস্তান আমলে আমরা দেখেছি, উচ্চ আদালত তো দূরের কথা, নিম্ন আদালতের বিচারকরা কখনো পাবলিক ফাংশনে অংশ নিতেন না। এমনকি বিয়ের অনুষ্ঠানেও যেতেন না। কিন্তু আওয়ামী লীগের আমলে দেখেছি, রাজনৈতিক নেতারা হরহামেশা বিচারকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন এবং গর্বের সঙ্গে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতে দ্বিধাবোধ করতেন না।

এদিকে বাংলাদেশের মতো মুসলিম দেশের মুসলিম বিচারকদের মূলত দায়বদ্ধতা থাকার কথা ছিল সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালার কাছে, কোনো নেতানেত্রীর কাছে নয়। কিন্তু তা হয়নি। অথচ শেষ বিচারের দিনে বিচারকরা কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হবেন। কারণ আল্লাহতায়ালা কোরআনুল কারিমে বারবার ন্যায়বিচারের তাগিদ দিয়েছেন। যেমন—আল্লাহ বলেছেন, ‘হে ঈমানদাররা তোমরা ন্যায়ের ওপর অবিচল থাকো আল্লাহর জন্য সাক্ষীস্বরূপ, যদিও তা তোমাদের নিজেদের অথবা বাবা-মা এবং আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে হয়। সে বিত্তবান হোক বা বিত্তহীন হোক আল্লাহ উভয়েরই ঘনিষ্ঠতর। সুতরাং ন্যায়বিচার করতে খেয়ালখুশির অনুগত হয়ো না। (সুরা নিসা, আয়াত : ১৩৫)
আবার সুরা হুজরাওয়ের ১৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা দুটো দলের মধ্যে ন্যায় ও ইনসাফের সঙ্গে ফয়সালা করে দেবে এবং তোমরা ন্যায়বিচার করবে। নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়বিচারকদের ভালোবাসেন।’
পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা আরো বলেন, ‘অবশ্যই আমি আমার রাসালদের পাঠিয়েছি স্পষ্ট প্রমাণসহ এবং আমি তাদের সঙ্গে পাঠিয়েছি কিতাব ও ওজন (ন্যায়দণ্ড), যেন মানুষ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। (সুরা হদিদ, আয়াত : ২৫)
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আরো অনেক আয়াতে রয়েছে। শুধু তাই নয়, এ ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা কঠোরভাবে বলেছেন, ‘যারা আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান অনুযায়ী বিচার করে না তারা কাফের। (সুরা মায়িদা, আয়াত : ৪৪)
এছাড়া বহু হাদিসে এ ব্যাপারে উল্লেখ রয়েছে। যেমন : রাসুল পাক (সা.) বলেছেন, তোমাদের কেউ যখন নেতৃত্বের বোঝা বহন করে, তখন সে যেন ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে। তবে স্বয়ং রাসুল (সা.)-এর একটি ন্যায়বিচারের ঘটনা মুসলিম বিশ্বে ব্যাপকভাবে প্রচারিত। এটা ছিল বিখ্যাত মাখজম গোত্রের এক সম্ভ্রান্ত মহিলা চোরের বিচারের ঘটনা। এ ব্যাপারে কোরাইশের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। কারণ মহিলাদের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের। কিন্তু এ ব্যাপারে রাসুল পাক (সা.)-কে কোনো সুপারিশ করার সাহস ছিল না কারো। তাই তারা রাসুল (সা.)-এর অতিপ্রিয় ওসামা বিন জায়েদ (রা.)-কে সুপারিশ করার জন্য পাঠান।
হজরত ওসামা বিন জায়েদ (রা.) বিষয়টি রাসুল (সা.) অবহিত করেন। তখন নবী (সা.) ওসামা (রা.)-কে বললেন, তুমি কি আল্লাহর সীমালঙ্ঘনকারীর সাজা মওকুফের সুপারিশ করছো? অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে খুতবায় বললেন, তোমাদের আগের জাতি এ কাজ করে ধ্বংস হয়েছে, যখন তাদের মধ্যে কোনো বিশিষ্ট অভিজাত লোক চুরি করত, তখন তাদের বিনা সাজায় ছেড়ে দেওয়া হতো। অন্যদিকে যখন অসহায় গরিব কোনো লোক চুরি করত, তখন তাদের দণ্ডবিধি অনুযায়ী সাজা দেওয়া হতো। আল্লাহর কসম, মোহাম্মদ (সা.)-এর মেয়ে ফাতিমাও যদি চুরি করত, তাহলে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী তার হাত কাটার অনুমতি দিতাম।
এখানে কোরআন ও হাদিসের মূল কথা হচ্ছে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। আমাদের সামনে এমন অনেক দেশের উদাহরণ আছে, সেসব দেশের মানুষ অমুসলিম হয়েও আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। যেমন : আমেরিকা বা ইউরোপের মতো দেশগুলো টিকে আছে সুশাসন ও ন্যায়বিচারের ওপরের ওপর ভিত্তি করে। অথচ একদা অনেক মুসলিম শাসক ও বিচারক সুশাসন এবং ন্যায়বিচারের জন্য ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। আজ মুসলিম দেশগুলো সুশাসন ও ন্যায়বিচার থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। আমরা যদি আমেরিকা ও ব্রিটেনের কথা বলি, এরা বিদেশের মাটিতে যাই করে থাকুক না কেন, অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে তাদের রয়েছে সুশাসন ও ন্যায়বিচারে দীর্ঘ ইতিহাস।
লৌহমানবীখ্যাত মার্গারেট থ্যাচার যখন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী, তখন তার ছেলে ট্রাফিক আইনলঙ্ঘন করার দায়ে জরিমানার শিকার হয়েছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সন্তান বলে রক্ষা পাননি। কারণ ইংল্যান্ডে কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়, প্রধানমন্ত্রী, লর্ড, ব্যারন কিংবা সাধারণ মানুষ যেই হন না কেন। এই তো অতিসম্প্রতি ব্রিটেনের পাশের দেশ ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজির পাঁচ বছরের জেল হয়েছে দুর্নীতির অভিযোগে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, তিনি বেআইনিভাবে নির্বাচনি তহবিল সংগ্রহ করেছিলেন। যে অভিযোগে তার বিরুদ্ধে পাঁচ বছরের সাজা হয়েছে, তা আমলে নিলে বাংলাদেশের কম রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা সাজা থেকে রক্ষা পাবেন।
অন্যদিকে আমেরিকার কথাই ধরুন, এই দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ হিসেবে টিকে আছে সুশাসন ও ন্যায়বিচারের ওপর নির্ভর করে। এই দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, আইনের শাসন, সাংবিধানিক অধিকার এবং একটি স্বাধীন বিচার বিভাগের মাধ্যমে। এখানে সংবিধান ও আইনের মাধ্যমে নাগরিকের অধিকার সংরক্ষিত হয়, যা বিচার বিভাগকে নির্দেশ করে এবং প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ থেকে রক্ষা করে।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে সব নাগরিকের জন্য আইনি সহায়তা নিশ্চিত করা হয়েছে, যাতে তারা তাদের আর্থিক অবস্থা বা ব্যক্তিগত পরিস্থিতি নির্বিশেষে আইনি সুরক্ষা চাইতে পারে। ঠিক এভাবেই বহু দেশে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হয়েছে।
এই পটভূমিতে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রিফাত আহমেদের ভাষণটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তিনি বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের ন্যায়বিচারহীনতার কথা ভেবে বিচার বিভাগের সংস্কারের কথাও তার বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে প্রশাসনিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ, নৈতিকভাবে সাহসী ও সংবিধানিকভাবে শক্তিশালী বিচার বিভাগ বিনির্মাণ করতে হবে।’
কিন্তু প্রধান বিচারপতি আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী ওই ধরনের একটি বিচার বিভাগ নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই আগামীতে আইনপ্রণেতাদের এটি নিশ্চিত করতে হবে, প্রশাসন কোনো অবস্থাতেই যেন আর বিচার বিভাগে হস্তক্ষেপ করতে না পারে। আর তখনই শুধু একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ কার্যকর হয়ে উঠবে। তা না হলে বিচারের বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কেঁদেই চলবে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

ঢাকা শহরে যাতায়াত মানে এক ধরনের যুদ্ধ। প্রতিদিন অফিসে যাওয়া-আসার পথে এ যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হয় লাখ লাখ মানুষকে। অশেষ বিড়ম্বনার শিকার হতে হয় অন্য যাতায়াতকারীদেরও। যানজটে মূল্যবান সময় অপচয় আর যানবাহনের তেলই শুধু পুড়ছে না; বরং ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে এর নেতিবাচক প্রভাব বহুমাত্রিক। প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী
৮ ঘণ্টা আগে
আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত সংবাদ দেখা যাচ্ছে, ভারতে মুসলিমরা তাদের ধর্মবিশ্বাসের কারণে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এই খবরগুলো দুঃখজনক একটা বাস্তবতা সামনে এনেছে। ভারতের গণতন্ত্র তাদের অন্তর্নিহিত মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলছে। এখন আর এটি বলার উপায় নেই যে, এই ঘটনাগুলো বিরল বিচ্ছিন্ন ঘটনা। হঠাৎ করে
৮ ঘণ্টা আগে
কী করে যেন একই সময়ে দেখা গেল পশ্চিমি গণমাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ভারতে পালিয়ে থাকা বাংলাদেশের পতিত শাসক শেখ হাসিনার বর্বর হত্যাকাণ্ড অস্বীকার করে নির্বিকার সাফাই চেষ্টা এবং জুলাই সনদের বাস্তবায়ন আদেশ নিয়ে দেশে রাজনৈতিক টানাপোড়েন। এটা কি শুধুই কাকতালীয় ব্যাপার?
৮ ঘণ্টা আগে
জাতিসংঘের ৮০তম সাধারণ অধিবেশনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ‘গ্লোবাল মাইগ্রেশন এজেন্ডা’র বিরুদ্ধে তার ভাষণে সরব হন, তখন সেটি শুধু যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রতিফলন হিসেবে না দেখে এক বৈশ্বিক রাজনৈতিক সংকেত হিসেবে দেখা উচিত, যা জাতীয়তাবাদী ও বর্জনমুখী শাসনব্যবস্থাগুলোর জন্য এক
১ দিন আগে