
আজিজুর রহমান আজাদ ও তারেক হাসান

জাতিসংঘের ৮০তম সাধারণ অধিবেশনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ‘গ্লোবাল মাইগ্রেশন এজেন্ডা’র বিরুদ্ধে তার ভাষণে সরব হন, তখন সেটি শুধু যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রতিফলন হিসেবে না দেখে এক বৈশ্বিক রাজনৈতিক সংকেত হিসেবে দেখা উচিত, যা জাতীয়তাবাদী ও বর্জনমুখী শাসনব্যবস্থাগুলোর জন্য এক ধরনের নৈতিক অনুমোদন হিসেবে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। ট্রাম্প তার বক্তব্যে দেশগুলোকে আহ্বান করেন সীমান্ত বন্ধ করতে, বিদেশিদের বিতাড়িত করতে এবং এমন অভিবাসী নীতির কথা বলেন, যা নব্য জাতীয়তাবাদী শক্তির পুনরুত্থানে বিশ্বাসীদের খুশি হওয়ারই কথা। এই বক্তব্যের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের ভোট রাজনীতির কৌশল হিসেবে কাজ করতে পারে; কিন্তু তার আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ছিল বহুগুণ গভীরতর। কারণ জাতিসংঘের মতো এক মঞ্চ থেকে এমন বক্তব্য ‘গ্লোবাল হেইট' ডিসকোর্সকে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করতে পারে।
মিয়ানমারের সামরিক জান্তার জন্য এই ভাষণ ছিল এক ধরনের অঘোষিত সমর্থন। দেশটি বহু দশক ধরে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নাগরিকত্ব, বসবাস ও মর্যাদা অস্বীকার করে আসছে। ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের জাতীয় জাতিগোষ্ঠীর তালিকা থেকে বাদ পড়ে। ফলে তারা নিজেদের জন্মভূমিতেই নাগরিকত্ব হারায় এবং রাষ্ট্রবিহীন জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়। এরপর থেকে সামরিক ও বেসামরিক উভয় সরকারই রোহিঙ্গাদের ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে, যদিও ঐতিহাসিকভাবে রোহিঙ্গারা শত শত বছর ধরে রাখাইন অঞ্চলে বসবাস করছে। এই আইনি বঞ্চনা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনিক নিপীড়ন, সহিংসতা এবং অবশেষে সংগঠিত জাতিগত নির্মূল অভিযানে রূপ নেয়।
২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ‘ক্লিয়ারিং অপারেশন’ নামে যে অভিযান চালায়, তা ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস অধ্যায় হয়ে দাঁড়ায়। অসংখ্য গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়, নারী ও শিশুরা ধর্ষণের শিকার হয়, পুরুষদের হত্যা করে গণকবর দেওয়া হয়। মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে, যারা যোগ দেয় আগের দফায় আসা আরো কয়েক লাখ শরণার্থীর সারিতে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল—সবাই একবাক্যে বলেছে, এটি একটি পরিকল্পিত জাতিগত নিধন, যার প্রকৃতি জেনোসাইডের সঙ্গে মিলে যায়। যুক্তরাষ্ট্র নিজেও পরবর্তীকালে এটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
আজ, আট বছর পরও রোহিঙ্গারা নাগরিকত্বহীন, রাষ্ট্রবিহীন ও ভবিষ্যৎহীন অবস্থায় আছে। বাংলাদেশে তারা সীমিত মানবিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল জীবনযাপন করছে, আর রাখাইন অঞ্চলে যারা থেকে গেছে, তারা একপ্রকার অপার্থেইড ব্যবস্থার অধীনে বন্দি। আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার শুরু হলেও, বাস্তব পরিস্থিতির কোনো দৃশ্যমান পরিবর্তন ঘটেনি।
এ অবস্থায় ট্রাম্পের ভাষণ রোহিঙ্গাদের জন্য এক অশনিসংকেত হিসেবে দেখা যায়। কারণ, এটি নীতিভিত্তিক বৈশ্বিক সংহতির ধারণাকেই দুর্বল করে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী যুগে জাতিসংঘের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। জাতিসংঘের মতো মঞ্চ থেকে যখন কোনো নেতা বলেন, শরণার্থীদের জন্য প্রবেশ বন্ধ করা রাষ্ট্র রক্ষার পূর্বশর্ত, তখন এই বক্তব্য এক ধরনের আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী বক্তব্য হিসেবেই বেশি পরিচিতি পায়। এর মাধ্যমে জাতিসংঘের ঐতিহাসিক ভূমিকা—যেখানে নেতারা একসময় বর্ণবাদের বিরুদ্ধে, উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে এবং মানব মর্যাদার পক্ষে কথা বলতেন—আজ যেন উল্টে গিয়ে পরিণত হয়েছে ঘৃণা ও বিভেদের ভাষায়।
ট্রাম্পের এই বক্তব্য পৃথিবীর নানা প্রান্তের জনতাবাদী শাসকদের জন্যও আশাব্যঞ্জক বার্তা বয়ে এনেছে। যখন বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্রের নেতা জাতিসংঘের মঞ্চে বলেন, বহিরাগতরা ‘দেশ ধ্বংস করে’, তখন সেটি এক ধরনের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড তৈরি করে। স্বৈরাচারী সরকারগুলো তখন সহজেই নিজেদের জাতিগত নিপীড়নকে ‘জাতীয় স্বার্থরক্ষা’ বা ‘সাংস্কৃতিক সংহতি’র নামে বৈধতা দিতে পারে। এই বিদ্বেষমূলক ডিসকোর্স নৈতিকতার বিপরীত চিত্র প্রদর্শন করে, যেখানে মানবাধিকারের সর্বজনীন ধারণা ভেঙে পড়ে রাষ্ট্রীয় স্বার্থের সংকীর্ণ সংজ্ঞার নিচে।
রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে স্পষ্ট। মিয়ানমার বহু বছর ধরে আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে থাকলেও তারা জানে, বৈশ্বিক রাজনীতি এখন মানবাধিকারের চেয়ে নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বকে বেশি মূল্য দেয়। পশ্চিমা দেশগুলোও অভিবাসনবিরোধী চাপের মুখে নিজেদের সীমান্ত নীতিকে আরো কঠোর করছে। ফলে মিয়ানমারের মতো রাষ্ট্রের পক্ষে রোহিঙ্গা নিপীড়ন চালিয়ে যাওয়া আরো সহজ হয়ে যায়। ট্রাম্পের মতো নেতাদের বক্তব্য সেই নৈতিক চাপকে আরো দুর্বল করে দেয়। মানবাধিকার লঙ্ঘনের পরও যদি বৈশ্বিক নিন্দা হালকা থাকে, তবে স্বৈরাচারীরা এটিকে নীরব অনুমোদন হিসেবেই গ্রহণ করবে—এটাই স্বাভাবিক।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এই নীরবতার মূল্য অত্যন্ত বেশি। কারণ, বৈশ্বিক মানবাধিকার কাঠামো শুধু আইন বা প্রতিষ্ঠান দ্বারা টিকেনি; এটি টিকে আছে নৈতিক দায়বদ্ধতার ওপর। যখন সেই নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তখন আন্তর্জাতিক আইনও কার্যকর না থাকারই কথা। ট্রাম্পের ভাষণ সেই নৈতিক ভারসাম্যকে নষ্ট করেছে। ফলে বিশ্বজুড়ে অভিবাসী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা আরো বৈধতা পেয়েছে।
এই বৈধতার প্রভাব সবচেয়ে বেশি অনুভূত হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। আসিয়ান (ASEAN) দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমার ইস্যুতে ‘হস্তক্ষেপহীন’ নীতিতে অটল থেকেছে। কিন্তু রোহিঙ্গাসংকট প্রমাণ করেছে, এই নিরপেক্ষতা আসলে পরোক্ষ সহায়তা। মিয়ানমারের সামরিক শাসকরা জানে, আসিয়ান কখনোই কঠোর অবস্থান নেবে না। এখন যখন জাতিসংঘের মঞ্চেই এই বিদ্বেষমূলক বাণী শোনা যায়, তখন আসিয়ান আরো নীরব হয়ে পড়ে। এই নীরবতা শুধু নীতিগত ব্যর্থতা নয়, এটি নৈতিক দেউলিয়াত্বেরও প্রতিফলন। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একসময় মানবাধিকারের যে সর্বজনীনতা ছিল, আজ তা ক্রমেই রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া, চীন—সবাই নিজেদের স্বার্থে মানবাধিকারকে ব্যবহার করছে। ফলে ‘ইউনিভার্সাল রাইটস’ আর প্রকৃত অর্থে সর্বজনীন নয়। ট্রাম্পের বক্তব্য সেই বাস্তবতাকে আরো দৃঢ় করেছে। তিনি যখন জাতিসংঘের মতো একটি মঞ্চে তার এই নীতি প্রচার করেন, তখন মানবাধিকার ও সার্বভৌমত্বের মধ্যে থাকা সূক্ষ্ম ভারসাম্য ভেঙে পড়ে।
এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন ওঠে—জাতিসংঘ কি তার মৌলিক নৈতিক ভূমিকা হারাচ্ছে? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী যুগে জাতিসংঘ ছিল সেই স্থান, যেখানে বিশ্ব একত্রে বলেছিল ‘Never Again’—কোনো জাতিগত নিধন আর নয়, কোনো রাষ্ট্রীয় বর্জন আর নয়। কিন্তু আজ, সেই একই মঞ্চে বর্জনের ভাষা উচ্চারিত হচ্ছে। এটি মানবতার ইতিহাসে এক ধরনের নৈতিক পশ্চাদপসরণ।
মিয়ানমারের জেনারেলরা এই পরিবর্তনের সুবিধা নিচ্ছে। তারা জানে, আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এখন আর আগের মতো একমুখী নয়। একদিকে পশ্চিমা বিশ্ব মানবাধিকারের কথা বলে, অন্যদিকে নিজেদের সীমান্তে শরণার্থীদের আটক রাখে। এই দ্বৈত মানদণ্ডই মিয়ানমারের মতো রাষ্ট্রগুলোকে আত্মবিশ্বাস দেয়। তারা বোঝে, নৈতিকতার যে বিশ্ব একদিন তাদের বিরুদ্ধে একত্র হয়েছিল, আজ সেই বিশ্ব বিভক্ত। ট্রাম্পের বক্তৃতা এই বিভাজনকেই আরো গভীর করেছে।
এই প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাসংকট দক্ষিণ এশিয়ায় আরো জটিল পরিস্থিতি তৈরি করল। যখন আন্তর্জাতিক নেতৃত্ব নৈতিকভাবে দুর্বল হয়, তখন সবচেয়ে দুর্বল জনগোষ্ঠীই প্রথমে তার মূল্য দেয়। ট্রাম্পের ভাষণ সেই দুর্বলতার প্রতীক হয়ে থাকবে—যেখানে মানবাধিকার নয়, বরং ক্ষমতার রাজনীতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কে মানুষ আর কে নয়।
এই বাস্তবতায় মানবাধিকারের সর্বজনীন ধারণা পুনর্গঠন করা আজকের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। জাতিসংঘ, আসিয়ান কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়ন—সবাইকে পুনর্বিবেচনা করতে হবে, তারা কি সত্যিই সেই নৈতিক অবস্থানে আছে, যা দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানবতার নতুন ভিত্তি তৈরি হয়েছিল। কারণ, যদি রোহিঙ্গাদের মতো একটি জাতিগোষ্ঠী আজও রাষ্ট্রহীন থেকে যায়, তবে সেটি শুধু মিয়ানমারের ব্যর্থতা নয়; এটি পুরো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নৈতিক ব্যর্থতা।
ট্রাম্পের ভাষণ হয়তো নির্বাচনি কৌশলের অংশ ছিল, কিন্তু এর প্রভাব তার সীমারেখা ছাড়িয়ে গেছে। এটি এমন একসময় এসেছে, যখন বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদ এবং অভিবাসী-বিদ্বেষ রাজনৈতিক মূলধন হিসেবে আবার জনপ্রিয় হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে ট্রাম্পের বক্তব্য পৃথিবীর বহু রাষ্ট্রনেতাকে নতুন আত্মবিশ্বাস দিয়েছে যে, তারা সংখ্যালঘু ও শরণার্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে পারে, কারণ বিশ্ব এখন আর একমুখী মানবাধিকার কাঠামোয় বিশ্বাস করে না।
তবু, ইতিহাস বারবার দেখিয়েছে, ঘৃণার ভাষা শেষ পর্যন্ত কোনো রাষ্ট্রকেই রক্ষা করে না। রোহিঙ্গাসংকট আজ সেই সত্যেরই নির্মম প্রতিফলন। যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নীরব থাকে, যদি জাতিসংঘের মঞ্চ থেকে মানবতার ভাষা হারিয়ে যায়, তবে আগামী দিনে আরো অনেক সংখ্যালঘু, আরো অনেক রাষ্ট্রহীন মানুষ, একই পরিণতির মুখোমুখি হবে।
এই পরীক্ষায় ব্যর্থ হলে, হারবে শুধু রোহিঙ্গারা নয়—হারবে সেই বিশ্ব, যে বিশ্ব একসময় বলেছিল—‘মানবতা সবার আগে’। ইতিহাসের আদালতে তখন প্রশ্ন উঠবে—মানবতার পাশে কে দাঁড়িয়েছিল আর কে নীরব থেকে সহিংসতাকে বৈধতা দিয়েছিল।
লেখক : গবেষক

জাতিসংঘের ৮০তম সাধারণ অধিবেশনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ‘গ্লোবাল মাইগ্রেশন এজেন্ডা’র বিরুদ্ধে তার ভাষণে সরব হন, তখন সেটি শুধু যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রতিফলন হিসেবে না দেখে এক বৈশ্বিক রাজনৈতিক সংকেত হিসেবে দেখা উচিত, যা জাতীয়তাবাদী ও বর্জনমুখী শাসনব্যবস্থাগুলোর জন্য এক ধরনের নৈতিক অনুমোদন হিসেবে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। ট্রাম্প তার বক্তব্যে দেশগুলোকে আহ্বান করেন সীমান্ত বন্ধ করতে, বিদেশিদের বিতাড়িত করতে এবং এমন অভিবাসী নীতির কথা বলেন, যা নব্য জাতীয়তাবাদী শক্তির পুনরুত্থানে বিশ্বাসীদের খুশি হওয়ারই কথা। এই বক্তব্যের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের ভোট রাজনীতির কৌশল হিসেবে কাজ করতে পারে; কিন্তু তার আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ছিল বহুগুণ গভীরতর। কারণ জাতিসংঘের মতো এক মঞ্চ থেকে এমন বক্তব্য ‘গ্লোবাল হেইট' ডিসকোর্সকে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করতে পারে।
মিয়ানমারের সামরিক জান্তার জন্য এই ভাষণ ছিল এক ধরনের অঘোষিত সমর্থন। দেশটি বহু দশক ধরে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নাগরিকত্ব, বসবাস ও মর্যাদা অস্বীকার করে আসছে। ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের জাতীয় জাতিগোষ্ঠীর তালিকা থেকে বাদ পড়ে। ফলে তারা নিজেদের জন্মভূমিতেই নাগরিকত্ব হারায় এবং রাষ্ট্রবিহীন জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়। এরপর থেকে সামরিক ও বেসামরিক উভয় সরকারই রোহিঙ্গাদের ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে, যদিও ঐতিহাসিকভাবে রোহিঙ্গারা শত শত বছর ধরে রাখাইন অঞ্চলে বসবাস করছে। এই আইনি বঞ্চনা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনিক নিপীড়ন, সহিংসতা এবং অবশেষে সংগঠিত জাতিগত নির্মূল অভিযানে রূপ নেয়।
২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ‘ক্লিয়ারিং অপারেশন’ নামে যে অভিযান চালায়, তা ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস অধ্যায় হয়ে দাঁড়ায়। অসংখ্য গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়, নারী ও শিশুরা ধর্ষণের শিকার হয়, পুরুষদের হত্যা করে গণকবর দেওয়া হয়। মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে, যারা যোগ দেয় আগের দফায় আসা আরো কয়েক লাখ শরণার্থীর সারিতে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল—সবাই একবাক্যে বলেছে, এটি একটি পরিকল্পিত জাতিগত নিধন, যার প্রকৃতি জেনোসাইডের সঙ্গে মিলে যায়। যুক্তরাষ্ট্র নিজেও পরবর্তীকালে এটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
আজ, আট বছর পরও রোহিঙ্গারা নাগরিকত্বহীন, রাষ্ট্রবিহীন ও ভবিষ্যৎহীন অবস্থায় আছে। বাংলাদেশে তারা সীমিত মানবিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল জীবনযাপন করছে, আর রাখাইন অঞ্চলে যারা থেকে গেছে, তারা একপ্রকার অপার্থেইড ব্যবস্থার অধীনে বন্দি। আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার শুরু হলেও, বাস্তব পরিস্থিতির কোনো দৃশ্যমান পরিবর্তন ঘটেনি।
এ অবস্থায় ট্রাম্পের ভাষণ রোহিঙ্গাদের জন্য এক অশনিসংকেত হিসেবে দেখা যায়। কারণ, এটি নীতিভিত্তিক বৈশ্বিক সংহতির ধারণাকেই দুর্বল করে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী যুগে জাতিসংঘের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। জাতিসংঘের মতো মঞ্চ থেকে যখন কোনো নেতা বলেন, শরণার্থীদের জন্য প্রবেশ বন্ধ করা রাষ্ট্র রক্ষার পূর্বশর্ত, তখন এই বক্তব্য এক ধরনের আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী বক্তব্য হিসেবেই বেশি পরিচিতি পায়। এর মাধ্যমে জাতিসংঘের ঐতিহাসিক ভূমিকা—যেখানে নেতারা একসময় বর্ণবাদের বিরুদ্ধে, উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে এবং মানব মর্যাদার পক্ষে কথা বলতেন—আজ যেন উল্টে গিয়ে পরিণত হয়েছে ঘৃণা ও বিভেদের ভাষায়।
ট্রাম্পের এই বক্তব্য পৃথিবীর নানা প্রান্তের জনতাবাদী শাসকদের জন্যও আশাব্যঞ্জক বার্তা বয়ে এনেছে। যখন বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্রের নেতা জাতিসংঘের মঞ্চে বলেন, বহিরাগতরা ‘দেশ ধ্বংস করে’, তখন সেটি এক ধরনের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড তৈরি করে। স্বৈরাচারী সরকারগুলো তখন সহজেই নিজেদের জাতিগত নিপীড়নকে ‘জাতীয় স্বার্থরক্ষা’ বা ‘সাংস্কৃতিক সংহতি’র নামে বৈধতা দিতে পারে। এই বিদ্বেষমূলক ডিসকোর্স নৈতিকতার বিপরীত চিত্র প্রদর্শন করে, যেখানে মানবাধিকারের সর্বজনীন ধারণা ভেঙে পড়ে রাষ্ট্রীয় স্বার্থের সংকীর্ণ সংজ্ঞার নিচে।
রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে স্পষ্ট। মিয়ানমার বহু বছর ধরে আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে থাকলেও তারা জানে, বৈশ্বিক রাজনীতি এখন মানবাধিকারের চেয়ে নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বকে বেশি মূল্য দেয়। পশ্চিমা দেশগুলোও অভিবাসনবিরোধী চাপের মুখে নিজেদের সীমান্ত নীতিকে আরো কঠোর করছে। ফলে মিয়ানমারের মতো রাষ্ট্রের পক্ষে রোহিঙ্গা নিপীড়ন চালিয়ে যাওয়া আরো সহজ হয়ে যায়। ট্রাম্পের মতো নেতাদের বক্তব্য সেই নৈতিক চাপকে আরো দুর্বল করে দেয়। মানবাধিকার লঙ্ঘনের পরও যদি বৈশ্বিক নিন্দা হালকা থাকে, তবে স্বৈরাচারীরা এটিকে নীরব অনুমোদন হিসেবেই গ্রহণ করবে—এটাই স্বাভাবিক।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এই নীরবতার মূল্য অত্যন্ত বেশি। কারণ, বৈশ্বিক মানবাধিকার কাঠামো শুধু আইন বা প্রতিষ্ঠান দ্বারা টিকেনি; এটি টিকে আছে নৈতিক দায়বদ্ধতার ওপর। যখন সেই নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তখন আন্তর্জাতিক আইনও কার্যকর না থাকারই কথা। ট্রাম্পের ভাষণ সেই নৈতিক ভারসাম্যকে নষ্ট করেছে। ফলে বিশ্বজুড়ে অভিবাসী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা আরো বৈধতা পেয়েছে।
এই বৈধতার প্রভাব সবচেয়ে বেশি অনুভূত হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। আসিয়ান (ASEAN) দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমার ইস্যুতে ‘হস্তক্ষেপহীন’ নীতিতে অটল থেকেছে। কিন্তু রোহিঙ্গাসংকট প্রমাণ করেছে, এই নিরপেক্ষতা আসলে পরোক্ষ সহায়তা। মিয়ানমারের সামরিক শাসকরা জানে, আসিয়ান কখনোই কঠোর অবস্থান নেবে না। এখন যখন জাতিসংঘের মঞ্চেই এই বিদ্বেষমূলক বাণী শোনা যায়, তখন আসিয়ান আরো নীরব হয়ে পড়ে। এই নীরবতা শুধু নীতিগত ব্যর্থতা নয়, এটি নৈতিক দেউলিয়াত্বেরও প্রতিফলন। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একসময় মানবাধিকারের যে সর্বজনীনতা ছিল, আজ তা ক্রমেই রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া, চীন—সবাই নিজেদের স্বার্থে মানবাধিকারকে ব্যবহার করছে। ফলে ‘ইউনিভার্সাল রাইটস’ আর প্রকৃত অর্থে সর্বজনীন নয়। ট্রাম্পের বক্তব্য সেই বাস্তবতাকে আরো দৃঢ় করেছে। তিনি যখন জাতিসংঘের মতো একটি মঞ্চে তার এই নীতি প্রচার করেন, তখন মানবাধিকার ও সার্বভৌমত্বের মধ্যে থাকা সূক্ষ্ম ভারসাম্য ভেঙে পড়ে।
এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন ওঠে—জাতিসংঘ কি তার মৌলিক নৈতিক ভূমিকা হারাচ্ছে? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী যুগে জাতিসংঘ ছিল সেই স্থান, যেখানে বিশ্ব একত্রে বলেছিল ‘Never Again’—কোনো জাতিগত নিধন আর নয়, কোনো রাষ্ট্রীয় বর্জন আর নয়। কিন্তু আজ, সেই একই মঞ্চে বর্জনের ভাষা উচ্চারিত হচ্ছে। এটি মানবতার ইতিহাসে এক ধরনের নৈতিক পশ্চাদপসরণ।
মিয়ানমারের জেনারেলরা এই পরিবর্তনের সুবিধা নিচ্ছে। তারা জানে, আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এখন আর আগের মতো একমুখী নয়। একদিকে পশ্চিমা বিশ্ব মানবাধিকারের কথা বলে, অন্যদিকে নিজেদের সীমান্তে শরণার্থীদের আটক রাখে। এই দ্বৈত মানদণ্ডই মিয়ানমারের মতো রাষ্ট্রগুলোকে আত্মবিশ্বাস দেয়। তারা বোঝে, নৈতিকতার যে বিশ্ব একদিন তাদের বিরুদ্ধে একত্র হয়েছিল, আজ সেই বিশ্ব বিভক্ত। ট্রাম্পের বক্তৃতা এই বিভাজনকেই আরো গভীর করেছে।
এই প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাসংকট দক্ষিণ এশিয়ায় আরো জটিল পরিস্থিতি তৈরি করল। যখন আন্তর্জাতিক নেতৃত্ব নৈতিকভাবে দুর্বল হয়, তখন সবচেয়ে দুর্বল জনগোষ্ঠীই প্রথমে তার মূল্য দেয়। ট্রাম্পের ভাষণ সেই দুর্বলতার প্রতীক হয়ে থাকবে—যেখানে মানবাধিকার নয়, বরং ক্ষমতার রাজনীতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কে মানুষ আর কে নয়।
এই বাস্তবতায় মানবাধিকারের সর্বজনীন ধারণা পুনর্গঠন করা আজকের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। জাতিসংঘ, আসিয়ান কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়ন—সবাইকে পুনর্বিবেচনা করতে হবে, তারা কি সত্যিই সেই নৈতিক অবস্থানে আছে, যা দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানবতার নতুন ভিত্তি তৈরি হয়েছিল। কারণ, যদি রোহিঙ্গাদের মতো একটি জাতিগোষ্ঠী আজও রাষ্ট্রহীন থেকে যায়, তবে সেটি শুধু মিয়ানমারের ব্যর্থতা নয়; এটি পুরো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নৈতিক ব্যর্থতা।
ট্রাম্পের ভাষণ হয়তো নির্বাচনি কৌশলের অংশ ছিল, কিন্তু এর প্রভাব তার সীমারেখা ছাড়িয়ে গেছে। এটি এমন একসময় এসেছে, যখন বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদ এবং অভিবাসী-বিদ্বেষ রাজনৈতিক মূলধন হিসেবে আবার জনপ্রিয় হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে ট্রাম্পের বক্তব্য পৃথিবীর বহু রাষ্ট্রনেতাকে নতুন আত্মবিশ্বাস দিয়েছে যে, তারা সংখ্যালঘু ও শরণার্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে পারে, কারণ বিশ্ব এখন আর একমুখী মানবাধিকার কাঠামোয় বিশ্বাস করে না।
তবু, ইতিহাস বারবার দেখিয়েছে, ঘৃণার ভাষা শেষ পর্যন্ত কোনো রাষ্ট্রকেই রক্ষা করে না। রোহিঙ্গাসংকট আজ সেই সত্যেরই নির্মম প্রতিফলন। যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নীরব থাকে, যদি জাতিসংঘের মঞ্চ থেকে মানবতার ভাষা হারিয়ে যায়, তবে আগামী দিনে আরো অনেক সংখ্যালঘু, আরো অনেক রাষ্ট্রহীন মানুষ, একই পরিণতির মুখোমুখি হবে।
এই পরীক্ষায় ব্যর্থ হলে, হারবে শুধু রোহিঙ্গারা নয়—হারবে সেই বিশ্ব, যে বিশ্ব একসময় বলেছিল—‘মানবতা সবার আগে’। ইতিহাসের আদালতে তখন প্রশ্ন উঠবে—মানবতার পাশে কে দাঁড়িয়েছিল আর কে নীরব থেকে সহিংসতাকে বৈধতা দিয়েছিল।
লেখক : গবেষক

সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তাদের বেসামরিক চাকরিতে কাঙ্ক্ষিত পদ পাওয়া উচিত কি না—এই প্রশ্নটি বেশ জটিল। বহু দৃষ্টিভঙ্গি এখানে উঠে আসবে। প্রাক্তন সামরিক কর্মকর্তাদের কেউ কেউ ভালো মর্যাদা দেওয়ার পক্ষে। অন্যরা মেধা আর কর্মক্ষেত্রের সংস্কৃতি নিয়ে চিন্তিত।
১০ ঘণ্টা আগে
হাসিনাকে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করা কি যুক্তিসংগত? আমার উত্তর হলো, ‘না।’ যারা হাসিনার কর্মকাণ্ড—হত্যা, গুম ও রাষ্ট্রীয় দমনপীড়নের ভেতর দিয়ে গেছেন, তাদের কাছে হয়তো এই তুলনা গ্রহণযোগ্য মনে হতে পারে। কিন্তু এখানে অপরাধের মাত্রা নয়, তুলনা করা হচ্ছে সাংবাদিকতার ফ্রেমিং নিয়ে। জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং
১০ ঘণ্টা আগে
বড়ই খোশ খবর! নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেছেন, এখন পর্যন্ত তিনি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে বড় কোনো চ্যালেঞ্জ দেখছেন না। শুক্রবার পটুয়াখালীতে বক্তৃতায় ডিসেম্বরের প্রথম দিকে নির্বাচনি তফসিল ঘোষণার কথাও জানান তিনি। অবশ্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার আগেই জানিয়েছিলেন, ডিসেম্বরের শুরুতে তফসিল
১১ ঘণ্টা আগে
প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিয়ে কাজ করছে ‘প্রবাসী ভোটাধিকার বাস্তবায়ন পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন। এই সংগঠনের যুক্তরাজ্য শাখার আহ্বায়ক ইউকে ইমিগ্রেশন ট্রাইব্যুনালের একজন বিচারক। তার নেতৃত্বে গঠিত সংগঠনের একজন সদস্য হিসেবে আমার মতো নগণ্য ব্যক্তিকেও রাখা হয়েছে।
১ দিন আগে