দিল্লি-ওয়াশিংটন দ্বন্দ্ব কোন পথে

মেহেদী হাসান
প্রকাশ : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২: ৫৮

শুল্ক ইস্যু ঘিরে নয়াদিল্লি-ওয়াশিংটনের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব আকস্মিক শত্রুতায় রূপ নিয়েছে। দুই দেশের সম্পর্ক বর্তমানে যে তলানিতে ঠেকেছে, সেখান থেকে সহজে উত্তরণের সম্ভাবনাও ক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসছে। ওয়াশিংটনের শুল্কবোমার আঘাতে বিধ্বস্ত ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বর্তমানে দিশাহারা। ফলে ভারতের পক্ষ থেকে কূটনীতি ও ভূরাজনৈতিক কৌশলের নামে এখন যা-ই করা হচ্ছে, তার সবই তাদের বিরুদ্ধে যাচ্ছে এবং ক্রমে দুই দেশের সম্পর্ক জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

সাবেক কূটনীতিক প্রফেসর জিতেন্দ্র মিশ্র, বিশ্লেষক সুমিত গাঙ্গুলিসহ অনেক বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দিয়েছিলেন, ওয়াশিংটনের শুল্কযুদ্ধের বিরুদ্ধে ধৈর্যধারণই হতে পারত ভারতের জন্য সবচেয়ে ভালো কূটনীতি। কিন্তু নয়াদিল্লি তা করেনি। তারা যুক্তরাষ্ট্রকে বেশ বড় মাত্রায় চ্যালেঞ্জ করেছে, যে সামর্থ্য আসলে ভারতের আদৌ নেই। ভারতের অর্থনীতির আকৃতি চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ভগ্নাংশ মাত্র। শুল্কযুদ্ধ মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতায় না গিয়ে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টির কৌশল গ্রহণ করেছে ভূরাজনৈতিক ইস্যুতে। এর অংশ হিসেবে তারা যুক্তরাষ্ট্রের ও তাদের নিজেদের চিরশত্রু চীনের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। এর মাধ্যমে মূলত ভারত সবদিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হতে যাচ্ছে বলে মনে করেন তারা।

প্রকাশিত বিভিন্ন খবর অনুসারে শুল্ক ইস্যুতে নয়াদিল্লির অবস্থানকে ঔদ্ধত্য আর বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখছে ওয়াশিংটন, যা ট্রাম্প প্রশাসনকে আরো ভীষণভাবে খেপিয়ে তুলেছে। তাছাড়া চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নতির মাধ্যমে ভারত আপাতত বাণিজ্যিকভাবে তেমন লাভবান হতে পারবে না। কারণ চীনে ভারতীয় পণ্য রপ্তানির সুযোগ খুবই সীমিত। ২০২৩ সালে ভারত চীনে মাত্র ১৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নতির মাধ্যমে এর পরিমাণ সামান্য বাড়তে পারে।

পাকিস্তান যেভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়ের সঙ্গে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করে চলছে, ভারতের পক্ষে তা কঠিন হবে। কারণ ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে চীনের বিরুদ্ধে একটি প্রভাবশালী দেশ হিসেবে গড়ে উঠতে কয়েক দশক ধরে সহায়তা করে আসছে। ভারতের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র অতীতে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার একাধিক দেশের সঙ্গে উপেক্ষার নীতি গ্রহণ করেছে। সেই ভারতের এভাবে চীনের সঙ্গে হাত মেলানোর ঘটনাকে যুক্তরাষ্ট্র বড় ধরনের বিশ্বাসভঙ্গ হিসেবেই দেখছে। ৪ সেপ্টেম্বর ক্ষুব্ধ ট্রাম্প বলেছেন, রাশিয়া ও ভারত চীনের গভীর অন্ধকারে হারিয়ে গেছে।

ভারতীয় অনেক বিশ্লেষক বলেছেন, চীন-রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে ভারত মূলত এ দেশ দুটি কর্তৃক ব্যবহৃত হবে। এতে ভারতের তেমন লাভ হবে না। উল্টো চীন ও রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে স্নায়ুযুদ্ধে ভারতকে পেয়ে গেল তাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে। তাছাড়া ভারত একই সঙ্গে চীনবিরোধী কোয়াড এবং যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী ব্রিক্সের সদস্য হিসেবে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে একটি হযবরল অবস্থার সৃষ্টি করেছে।

মোদি প্রশাসন চিরশত্রু চীনের দিকে হাত বাড়ানোয় প্রথমে মনে করা হয়েছিল এটা ট্রাম্প প্রশাসনকে চাপে ফেলার কৌশল। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে তত স্পষ্ট হচ্ছে শুল্কযুদ্ধ ঘিরে এশিয়াসহ বিশ্ব রাজনীতির নতুন সমীকরণ রেখা। ১ সেপ্টেম্বর চীনের তিয়ানজিন সম্মেলনে ভ্লাদিমির পুতিন ও শি জিনপিংয়ের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির ত্রিপক্ষীয় বৈঠক এবং এরপর ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিবৃতির মাধ্যমে এটা এখন স্পষ্ট যে, ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধ আর কেবল নিছক বাণিজ্যযুদ্ধ নয়, বরং এর প্রভাব হতে যাচ্ছে সুদূরপ্রসারী।

ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ব্যক্তিগত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ভারতের বিরুদ্ধে শুল্ক কমানো হবে না। ট্রাম্প বলেছেন, ভারত যদি রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল কেনা বন্ধ না করে তাহলে আরো দুই দফায় শুল্ক বাড়ানো হতে পারে। ট্রাম্প জানান, ভারতের পক্ষ থেকে তাকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য ভারতে প্রবেশের ক্ষেত্রে শুল্ক শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার। কিন্তু তাতেও রাজি না হয়ে ট্রাম্প বলেছেন, অনেক দেরি হয়ে গেছে।

অন্যদিকে ট্রাম্পের বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারো হোয়াইট হাউসে ভারতকে যেভাবে বিশ্ব গণমাধ্যমের সামনে তুলোধুনো করেছেন, তা নিয়ে তোলপাড় চলছে গোটা ভারতে। পিটার নাভারো বলেছেন, ‘আমি বুঝতে পারছি না বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ হয়েও মোদি কেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে এক বিছানায় যাচ্ছেন। আমি শুধু ভারতীয় জনগণকে বলব, এখানে কী হচ্ছে সেটা বোঝার চেষ্টা করুন। এখানে আমজনতার ক্ষতি করে ব্রাহ্মণরা মুনাফা করছে। এটা বন্ধ করা দরকার।’ নাভারো বলেন, ‘নয়াদিল্লি হলো রাশিয়ার অর্থ তৈরির একটি লন্ড্রি।’

একটি দেশের প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে শীর্ষ নেতাদের পক্ষ থেকে যখন দীর্ঘদিনের একটি বন্ধু দেশের প্রতি এ ধরনের মন্তব্য করা হয়, তখন এটা অনেকটা পরিষ্কার, কোন দিকে যাচ্ছে দুই দেশের সম্পর্ক।

তিয়ানজিন সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং দুই দেশের শত্রুতার অবসান ঘটিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরির বিষয়ে অঙ্গীকার করেছেন। সম্মেলনে বিশ্বের ২০টি দেশের সরকারপ্রধানদের সামনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। এতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য মোকাবিলায় নতুন একটি বিশ্বব্যবস্থা গড়ার রূপরেখা পেশ করেন। ন্যায় ও সমতাভিত্তিক নতুন এ বিশ্বব্যবস্থার মূল বিষয় হলো নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও নিজ নিজ সভ্যতার লালন।

সম্মেলনের সাইড লাইনে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মোদির বিপরীতে মুখোমুখি বসে শি জিনপিং ঘোষণা দেন, ‘আমাদের মধ্যে শত্রুতার পরিবর্তে দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্ব স্থাপন করতে হবে। আর এটাই হলো সবচেয়ে ভালো পছন্দ।’ জবাবে মোদি বলেছেন, ‘শত্রুতা ভুলে দুই দেশের বন্ধুত্ব দীর্ঘ মেয়াদে নিয়ে যেতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ।’

সিএনএনসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন গণমাধ্যমে চীন-ভারতের নতুন বন্ধুত্ব স্থাপনের ঘটনাকে মাইলফলক এবং ঐতিহাসিক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এর ফলে এখন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলে বিশ্লেষণ চলছে—রাশিয়ার তেল আর শি জিনপিংয়ের হ্যান্ডশেক কতটা রক্ষা করতে পারবে ভারতকে। রাশিয়ার সরকারি গণমাধ্যমের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, চলমান বিশ্বব্যবস্থার কবর রচিত হয়েছে চীনের তিয়ানজিনে এবং একই সঙ্গে শি-পুতিনের নেতৃত্বে নতুন একটি বিশ্বব্যবস্থার গোড়াপত্তন হয়েছে সেখানে। নতুন এ বিশ্বব্যবস্থা হবে ন্যায়ভিত্তিক বহুকেন্দ্রিক একটি বিশ্ব, যেখানে থাকবে না যুক্তরাষ্ট্রের ডলারকেন্দ্রিক একক আধিপত্য।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর চীন-রাশিয়ার নেতৃত্বে নতুন করে চাঙা হয়ে ওঠে ব্রিক্স। দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার শিকার ও যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী সব দেশ ব্রিক্সের পতাকাতালে সমবেত হতে শুরু করে। ডলারের বিপরীতে ব্রিক্স মুদ্রা চালুর বিষয়ে বেশ জোরেশোরে উদ্যোগ নেওয়া হয়।

ব্রিক্স মুদ্রা চালুর আগেই রাশিয়া, ভারত ও চীন ডলারের পরিবর্তে নিজেদের স্থানীয় মুদ্রা তথা রুবল, রুপি ও ইউয়ানে ব্যাপকভাবে লেনদেন শুরু করে। অন্যান্য অনেক দেশও ডলারের পরিবর্তে স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেনে আগ্রহ প্রকাশ করে। ভারত ব্যাপক পরিমাণ চীনা মুদ্রা ইউয়ানের রিজার্ভ গড়ে তোলে। চীন-রাশিয়ার পক্ষ থেকে তখন বেশ জোরেশোরে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নতুন একটি বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়। এ অবস্থায় বেশ শঙ্কিত হয়ে পড়ে ওয়াশিংটন। ২০২৩ সালে বাইডেন প্রশাসন বাধ্য হয় চীন-রাশিয়ার বিরুদ্ধে সামিট ফর ডেমোক্রেসি সম্মেলন করতে। এর লক্ষ্য ছিল গণতান্ত্রিক দেশগুলোকে চীন-রাশিয়ার বিরুদ্ধে একত্র করা।

ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে চীন-রাশিয়ার নেতৃত্বে ব্রিক্স যখন নতুন মাত্রা লাভ করে, তখনো এর অন্যতম সদস্য ভারত যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য মিত্র ও প্রতিরক্ষা অংশীদার। ফলে ব্রিক্সকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান কী হবে, তা নিয়ে সংশয় ছিল। ভারত প্রকাশ্যেই ব্রিক্স সম্প্রসারণের বিরোধিতা করে। শেষ পর্যন্ত ব্রিক্স আর অগ্রসর হতে পারেনি। সর্বশেষ গত জুন মাসে ডোনাল্ড ট্রাম্প ব্রিক্সকে যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে ঘোষণা করে ব্রিক্স সদস্য রাষ্ট্রের ওপর অতিরিক্ত ১০ শতাংশ শুল্ক ধার্য করেন। আর এর মাধ্যমে মূলত অনেকটা অবসান ঘটে ব্রিক্সের সম্ভাবনার।

তবে ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধ ঘিরে আবার চীন-রাশিয়ার নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী নতুন জোট দানা বেঁধে উঠছে তিয়ানজিন সম্মেলন ঘিরে। তিয়ানজিন সম্মেলনে মোদির যোগদান নিছক কোনো আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দুই বন্ধু দেশের বিপরীত পথে হাঁটার স্পষ্ট বার্তা। আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো মোদির এ বার্তাকে মোটেই পাত্তা দেয়নি ট্রাম্প প্রশাসন।

যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যমন্ত্রী উইলিয়াম লাটনিক সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গকে ৭ সেপ্টেম্বর দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আগামী এক অথবা দুই মাসের মধ্যে ভারত দরকষাকষির টেবিলে বসে যাবে। তারা ক্ষমা চাইবে। আর তারা ট্রাম্পের সঙ্গে চুক্তি করার চেষ্টা করবে। আর ডোনাল্ড ট্রাম্প ঠিক করবেন, তিনি কীভাবে মোদির সঙ্গে চুক্তি করবেন।’

এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিশ্লেষণ চলছে, চীনের সঙ্গে হাত মেলানোয় ভারত কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে যাচ্ছে, চীন কতটা লাভবান হবে, যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে এবং এ অঞ্চলে রাজনীতির নতুন সমীকরণ কেমন হবে, তা নিয়ে। ভারতের অনেক বিশ্লেষকের মতে, মোদির বিরুদ্ধে ক্রমে ফুঁসে উঠছে ভারতের জনগণ। ক্ষুব্ধ বিরোধী রাজনীতিকদের সুর ক্রমে চড়া হচ্ছে মোদির বিরুদ্ধে। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যমন্ত্রীর কথাই শেষ পর্যন্ত সত্য হতে পারে। গদি রক্ষায় শেষ পর্যন্ত নাকে খত দিয়ে মোদি ট্রাম্পের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে বাধ্য হতে পারেন। তবে এর ফলে মোদির গদি রক্ষা হলেও গোটা বিশ্বে ভারতের মানসম্মান বলতে আর কিছুই থাকবে না।

লেখক : সহকারী সম্পাদক, আমার দেশ

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত